বীজের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি : মাহবুব আনাম

>
মাহবুব আনাম। ছবি: প্রথম আলো
মাহবুব আনাম। ছবি: প্রথম আলো
দীর্ঘদিন ধরে বীজ নিয়ে কাজ করছেন লাল তীর সিড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব আনাম। তিনি বলেছেন এ খাতের সমস্যা ও সমাধানের উপায় নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম

প্রথম আলো: বীজের জগৎটা কেমন? 
মাহবুব আনাম: ফসলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বীজ, পানি, মাটি ও আবহাওয়া। কিন্তু বীজের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। বীজ ও বীজহীনতার মাঝামাঝি কিছু নেই। কারণ, বীজ ভালো না হলে ঘরে কোনো ফসলই তুলতে পারবেন না কৃষক। আগে ফসল না ফললে কৃষক দায়ী করতেন তাঁর কপালকে। আল্লাহ দেননি, তাই হয়নি—এমন কথাই বলতেন কৃষকেরা। তাঁরা ফসল না ফলার নেপথ্য কারণ খুঁজতেন না। এখন দিন বদলেছে। এখন তাঁরা কিছুটা হলেও বোঝেন। তাই খাদ্যশস্যে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়েও বাংলাদেশকে বিপুল খাদ্যশস্য আমদানি করতে হতো। এতে আসলে কোনো জাদুর ছোঁয়া নেই। পুরোটাই বিজ্ঞান দিয়েছে। আর কৃষকেরা তা গ্রহণ করেছেন।

প্রথম আলো: আপনারা বীজের ব্যবসার কীভাবে এলেন?
মাহবুব আনাম: ইস্ট ওয়েস্ট সিড বাংলাদেশ লিমিটেড নাম নিয়ে আমরা এলাম ১৯৯৫ সালের দিকে। এর পেছনে একটা সুন্দর গল্প আছে। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদের আমন্ত্রণে সাইমন গ্রুট নামের এক ডাচ নাগরিক এসেছিলেন ঢাকায়। পরে তিনি বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) সর্বোচ্চ কৃষি পুরস্কার পান। তখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আমাদের গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর। সাইমন গ্রুট তাঁকে পরামর্শ দিলেন, মানুষের জন্য রাজনীতি করছেন ঠিক আছে, কিন্তু কৃষক বা জেলেদের মতো মানুষের জন্য কিছু করা উচিত। আমাদের চেয়ারম্যান তাঁকে বললেন, এ ব্যাপারে আমার অদম্য ইচ্ছা আছে, কিন্তু কোনো অভিজ্ঞতা নেই। সাইমন গ্রুট সাহস দিলেন। সেই থেকেই বীজ নিয়ে কাজ করা শুরু।

প্রথম আলো: সে সময় প্রাথমিক ভাবনা কী ছিল?
মাহবুব আনাম: এফএওর ১৯৯৪ সালের একটা গবেষণার ফল আমাদের নজরে আসে। সেটা হচ্ছে ফসল ভালো না হওয়ার বড় কারণ ভালো বীজের অভাব। আরেক কারণ মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে সবজির ফলন হয় না। আমরা চিন্তা করলাম, এই পাঁচ–ছয় মাসের অফলা সময় নিয়ে কী করা যায়। দেখা গেল, অনেক সবজির জাত হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা তখন গবেষণার মাধ্যমে আবহাওয়ানুকূল বীজের উদ্ভাবন ও উন্নয়নের কাজ শুরু করলাম। ডাচ কৃষিবিজ্ঞানীদের সঙ্গে বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে একটি ব্রিডার গ্রুপের নিরলস চেষ্টায় দেখলাম, মার্চ-আগস্টেও সবজি ভালোই হয়। এখন তো সারা বছরই হয়। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিএডিসি) একসময় ২০ শতাংশ বীজের সরবরাহ করত। আর এখন করে মাত্র ১ শতাংশ। বাংলাদেশে সবজিতে নীরব বিপ্লব হয়ে গেল।

বৈশ্বিক উষ্ণতার বিপরীতে গবেষণার মাধ্যমে অনুকূল বীজ উদ্ভাবনই হচ্ছে প্রথম সমস্যার সমাধান। ছবি: আবদুস সালাম
বৈশ্বিক উষ্ণতার বিপরীতে গবেষণার মাধ্যমে অনুকূল বীজ উদ্ভাবনই হচ্ছে প্রথম সমস্যার সমাধান। ছবি: আবদুস সালাম

প্রথম আলো: দেশের বীজের বাজার এখন কতটা বড়?
মাহবুব আনাম: ধানসহ বলাটা খুব মুশকিল। তবে কমবেশি ৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সবজিবীজের বাজার প্রায় ৮০০ কোটি টাকার। লাল তীর ছাড়া সুপ্রিম সিড, ব্র্যাক, এসিআই, মেটাল সিড, ইউনিফাইড সিড ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানও একই কাজ করছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিড উইং থেকে নিবন্ধন নিয়ে ডিলাররা কেনাবেচার কাজে যুক্ত। সিড উইং খুব ভালো কাজ করছে।

প্রথম আলো: বীজ খাতের সার্বিক অবস্থা কেমন দেখছেন?
মাহবুব আনাম: বাংলাদেশের বীজ খাত একটি সন্ধিক্ষণে আছে। খোলা বীজ কেনার পরিবর্তে কৃষকেরা এখন প্যাকেটজাত বীজ কিনে থাকেন। ক্রয়কেন্দ্র থেকেই কৃষক বীজের মান, গুণাগুণ এবং সংক্ষিপ্ত চাষপদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারেন। কৃষক থেকে কৃষকের হাতবদলের মাধ্যমে পাওয়ার পরিবর্তে কৃষকেরা এখন সঠিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত ও সংরক্ষিত বীজ কেনেন। এতে সার্বিকভাবে ফলন বেড়েছে এবং কৃষকেরা সুফল পাচ্ছেন। বাংলাদেশের বর্তমান বীজ আইন কৃষিবান্ধব। কিন্তু বীজকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার কারণে বীজশিল্পে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো শিল্পঋণের সুবিধা পাচ্ছে না। কাজেই বীজকে একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্প খাত হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

প্রথম আলো: এই খাতের মূল চ্যালেঞ্জগুলো এখন কী?
মাহবুব আনাম: বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে বীজের মান সংরক্ষণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের বাজারে নকল বীজ একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। মুদ্রণশিল্পের বিকাশের কারণে মানসম্পন্ন বীজের প্যাকেট হুবহু নকল করা হচ্ছে। কৃষক–সমাদৃত একটি চিহ্নিত বীজের প্যাকেটে নিম্নমানের এবং কম দামের বীজ দিয়ে কৃষকের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। দেশের কৃষি ও বীজের জন্য এই মুহূর্তে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শুল্ক বিভাগ মাঝেমধ্যে কোনো কোনো বীজকে মসলা অথবা খাদ্যদ্রব্যের কোটায় নিয়ে বেশি শুল্ক আরোপ করে। এটাও একটা সমস্যা। বীজশিল্পে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এটি একটি অতি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। বীজ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুতি থেকে বীজ বিক্রি পর্যন্ত পথটি খুব দীর্ঘ। কখনো কখনো ৩০ মাসও 

লেগে যায়। আমাদের দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের বিনিয়োগ কিংবা ঋণব্যবস্থায় অভ্যস্ত নয়।

প্রথম আলো: এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য কী করা দরকার বলে মনে করছেন?
মাহবুব আনাম: বৈশ্বিক উষ্ণতার বিপরীতে গবেষণার মাধ্যমে অনুকূল বীজ উদ্ভাবনই হচ্ছে প্রথম সমস্যার সমাধান। দ্বিতীয়ত, নকল বীজ প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নকল প্রতিরোধ করা যেতে পারে সুস্পষ্ট বাজার তদারকির মাধ্যমে। বীজশিল্পে বিনিয়োগ ও ঋণব্যবস্থার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত।

প্রথম আলো: বীজের ভবিষ্যৎ কী? কী সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন?
মাহবুব আনাম: একজন বয়স্ক ব্যক্তির দিনে ২২৫ গ্রাম খাদ্য গ্রহণ করা দরকার। একসময় বাংলাদেশিরা তা গ্রহণ করত শুধু ৪৫ গ্রাম। সে পরিমাণ এখন একটু বেড়েছে। তবে বিশ্বমান থেকে এখনো অনেক পেছনে আমরা। এখনো আমরা খাওয়ার সময় ভাতের বড় পাত্র সামনে রাখি। তরকারি বা সবজি রাখি কম। এটা তো সুষম খাদ্য নয়। অথচ অনেক দেশেই মানুষ মাত্র এক কাপ ভাত খায়। ভাতের অভ্যাস থেকে বের হতে হবে। এক কেজি চালের দাম যেখানে ৪৫ টাকা, সেখানে সাড়ে ৩ কেজি ওজনের একটি বাঁধাকপির 

দাম ২০ টাকা। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। বিভিন্ন বীজ উৎপাদনে বাংলাদেশের চুক্তিবদ্ধ চাষিরা অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা অর্জন করছেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশ থেকে বীজ
রপ্তানির অপার সম্ভাবনা আছে। ভবিষ্যতে
আমরা হতে পারি এশিয়ার বীজ সরবরাহের অন্যতম কেন্দ্র।