বাঙালি খাওয়ার জন্য বাঁচে

ঢাকার রাস্তাঘাটে চোখকান খোলা রাখলেই পাওয়া যায় বৈচিত্র্যময় খাবার। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ঢাকার রাস্তাঘাটে চোখকান খোলা রাখলেই পাওয়া যায় বৈচিত্র্যময় খাবার। ছবি: সাইফুল ইসলাম

যতটা নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে বলা সম্ভব, সেভাবেই বলছি, পৃথিবীর প্রায় ৪০–৪৫টি দেশের খাবার খাওয়ার পরও আমার মনে হয়েছে, বাংলা খাবারের কোনো তুলনা হয় না। আমাদের মাছ, আমাদের সবজি, আমাদের টক, আচার, আমাদের মুরগির ঝোল, আমাদের পিঠা, পুলি, পায়েস, আমাদের রান্নার ধরন ও রকম—সব মিলিয়ে বাঙালির রোজকার খাবার পৃথিবীর যেকোনো দেশের খাবারের পাশে অনায়াসে অহংকার নিয়ে দাঁড়াতে পারবে। শুধু তা–ই নয়, আমরা ইতিহাসের পথ ধরে যেসব বিদেশি খাবারকে আপন করে নিয়েছি ও নিচ্ছি, আবার সেসব খাবারের মধ্যে আমাদের নিজস্ব যেসব গুগলি দিচ্ছি, সেগুলোও কিন্তু লাজবাব। যে কারণে আমাদের কাবাব কিংবা কাচ্চি দিনের শেষে একান্তই আমাদের। নিজের ঐতিহ্য যখন অনেক ঋদ্ধ হয়, তখন অন্যেরটাকে ধারণ করতেও কোনো দ্বিধা হয় না। আর তাই বোধ হয় ঢাকায় এত রকম দেশের খাবারের এত সব সমারোহ। লোকে খাচ্ছে, বাহ্বা দিচ্ছে এবং নিজের করে নিচ্ছে। আবার সময় ও চাহিদামতো মাছ-ভাতও কম খাচ্ছে না। কখনো আবার সাদামাটা মাছ-ভাত ভালো না লাগলে তার মধ্যে একটুখানি ফিউশন ঢুকে যাচ্ছে। মাছের ঝোল হঠাৎ ভোল পাল্টে লেমন ফিশ হয়ে যাচ্ছে। সে যা–ই হোক, মোদ্দা কথা হচ্ছে, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ বাঁচার জন্য খায়, আর বাঙালি খাওয়ার জন্য বাঁচে।

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ তরুণ বলে বার্গার কিংবা পিৎজার মতো ফাস্ট ফুডের বাজারও বেশ সরগরম। ঢাকা শহরে যত কাক, তার কাছাকাছিসংখ্যক ফ্রােয়ড চিকেনের দোকান আছে। কিন্তু ভেতো বাঙালি এত সব থিন ক্রাস্ট, থিক ক্রাস্ট পিৎজা চিনল কীভাবে? কে চেনাল এই সব? চারদিকে তাকিয়ে মনে হয়, ইন্টারনেট, মিডিয়া আর হলিউডের মিলিত ষড়যন্ত্রে এগুলো হয়েছে। হতেই পারে, আজকের এই বৈশ্বিক দুনিয়ায় সবকিছুই সবার। বার্গার কিং যতটা আমেরিকার, ততটুকুই ঢাকার। তাই বলে আমাদের টেক আউট কিংবা বেলা ইতালিয়ার পিৎজার ডিমান্ড কিন্তু একটুও কম নয়। ঝাল ঝাল মরিচের সস দিয়ে হাতিরপুলের শর্মা হাউসের শর্মার সঙ্গে পৃথিবীর কোনো ফাস্ট ফুডের তুলনা চলে না। তবে এসব বার্গার–পিৎজার আগেও কিন্তু ফাস্ট ফুড ছিল। আমাদের বাপ-চাচারা ইস্কাটনের কফিহাউসে বসে কিন্তু আলুর চপ আর চিকেন প্যাটি খেয়েছেন। তখন ওই আলুর চপ আর চিকেন প্যাটিই ছিল ফাস্ট ফুড। আর এখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে ক্যাফে। কফি বিনসই আছে চৌদ্দ রকমের—অ্যারাবিয়াটা, কলম্বিয়ান, ইথিওপিয়ান, ব্রাজিলিয়ান এমন আরও নানান রকম। তারপর যখন বিন্সের ঝামেলা শেষে কফি চাইতে গেলেন, তখন আরও ১২ পদ—ক্যাপাচিনো নাকি লাটে নাকি এসপ্রেসো ইত্যাদি। চাইলে সঙ্গে মুখরোচক পেস্ট্রি কিংবা চিকেন পাফ অর্ডার করতে পারেন।

তবে আধুনিক ছেলেমেয়েদের অর্ডারে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, যেন মায়ের পেট থেকে পড়েই সোজা ক্যাফেতে এসেছিল। বিশ্বায়নের গল্পটাই অমন। ঢাকা টু নিউইয়র্ক সবাইকে এক করে ফেলেছে। তবে বাঙালির সুবিধা হচ্ছে, এই বিশ্বায়নের ঘূর্ণিঝড়েও সে নিজেরটুকু ভোলেনি। তাই তো ওই ক্যাফে থেকে দু–পা বাড়ালেই ছোট্ট একটা দোকান, দোকানের সামনে উপচানো ভিড়। ভিড় ঠেলে সামনে এগোলেই, ‘চা চাই’—একদম চিরচেনা বাংলা চয়ের দোকান। কড়া দুধ–চা থেকে শুরু করে মালাই–চা, আদা–চা সবই পাওয়া যাচ্ছে বাহারি কাপে আর লোকেও হুড়মুড় করে খাচ্ছে। ঠিক পাশেই পাওয়া যাচ্ছে জিবে জল আনা নানা রকমের রোল, চাইলে চায়ের সঙ্গে সেটাও খেয়ে দেখতে পারেন।

চাইলে এখন ঢাকাতে ব্রেকফাস্টেরও বেশ বাহারি ব্যবস্থা আছে। বিশ্বাস না হলে গুলশান ২–এর মোড়টা পেরিয়ে হোলি বেকারিতে চলে যান সকাল সকাল। শুক্রবারে তো আগে থেকে না বলে গেলে জায়গাই পাবেন না। ধরে নিন, জায়গা পেয়ে গেলেন, এখন বলুন কী খাবেন? ফ্রেঞ্চ অমলেট, এগ বেনেডিক্ট নাকি ফ্রেঞ্চ টোস্ট? একই ধরনের ব্যবস্থা আপনি বিস্ত্রো ই কিংবা গ্লোরিয়া জিনসের যেকোনো শাখাতেও পেয়ে যাবেন। তবে কখনো যদি লুচি কিংবা পরোটা দিয়ে আলুর দম, মগজ ভুনা আর ডিম অমলেট খেতে মন চায়, তখন কিন্তু চলে যেতে হবে বেঙ্গল ক্যাফেতে। আর তা না হলে নিদেনপক্ষে স্টার কাবাবের সকালের নাশতা তো আছেই, সেটাই–বা কারও চেয়ে কম কিসে? আমি আমার ১৫ বছরের ছেলে রাজর্ষি আর ১২ বছর বয়সের অন্নপূর্ণার মতো ইংরেজি মিডিয়ামের বাচ্চাদেরও দেখেছি, সাধারণত হয়তো হোলি বেকারিতেই ব্রেকফাস্টটা করতে যেতে চায়, কিন্তু হঠাৎ এক শুক্রবার সকালে বলে বসবে, ‘চলো না বেঙ্গল ক্যাফেতে যাই, আজ লুচি আলুর দম খেতে মন চাইছে।’

ঢাকা আসলেই হয়ে উঠছে বিশ্ব খাবারের গর্বিত মঞ্চ। ইতালিয়ান রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে অ্যারাবিয়ান কিংবা টার্কিশ খাবারের দোকান, কী নেই এই শহরটায়। সেদিন কোথায় যেন দেখলাম গ্রিক খাবারের রেস্তোরাঁ। কোরিয়ান খাবারের দোকান তো গুনে শেষ করা যাবে না। আমার ছেলে বাড়িতে মাছ না খেলে কি হবে জাপানি রেস্টুরেন্টে গিয়ে দিব্যি সুশি খেয়ে নিচ্ছে। বাড়িতে শাক দেখে ওয়াক ওয়াক করলেও কোরিয়ান রেস্টুরেন্টে গিয়ে বেশ কিমচি খেয়ে ফেলছে। কিন্তু তাতে কি পাবদার ঝোলের কদর একটুও কমেছে? কিংবা শর্ষে ইলিশের দাবি? পাতুরিতে চলে যান, বুঝতে পারবেন। দেশি–বিদেশি লোকজন হাত ডুবিয়ে ভাত আর বুটের ডাল ও খাসির মাংস খাচ্ছে। এর বাইরেও ঢাকার রাস্তাঘাটে, বিভিন্ন কোনায় একটু চোখকান খোলা রাখলেই বছরের বিভিন্ন সময়ে পাওয়া যাবে ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠার হাঁড়ি, জিবে জল আনা চটপটি-ফুচকার গাড়ি অথবা চৌদ্দ পদের ভর্তার সঙ্গে চিতই পিঠার ঠেলাগাড়ি। মিরপুরের ১৪ নম্বরের কিংবা মোহাম্মদপুরের মোস্তাকিমের কাবাব আর বিফ চাপ যাঁরা খাননি, তাঁদের জন্য রইল আমার সহানুভূতি। সুযোগ পেলে খেয়ে নেবেন, তা না হলে এই মানবজনম অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

কিন্তু বাঙালি তার খাবারকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, সেটা বুঝতে হলে অনলাইন ফুড সাইটগুলোর দিকে তাকাতে হবে। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন লিঙ্গের মানুষ রোজ হাজারো পদের খাবার রান্না করছে, অর্ডার নিচ্ছে, বিক্রি করছে, অন্য অনেকে আবার সেসব খাবারের রিভিউ লিখছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামভর্তি মুখরোচক সব খাবারের ছবি। লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়েরা আজকাল বিদেশে গিয়ে রান্নাবান্নার ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছেন। আর ওই ছেলেমেয়েদের মা–বাবারা বিদেশে তাঁদের জন্য ব্যাগে করে নিয়ে যাচ্ছেন গরুর মাংসের ভুনা, ভুনা খিচুড়ি আর ইলিশভাজা।

শেষ কথা হচ্ছে, বাঙালি খাবারের গোড়া এত শক্ত যে তার ডালপালা পৃথিবীময় বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লেও দিনের শেষে এক থালা ভাত, মসুর ডাল, আলুভর্তা আর ডিমভাজিতেই পরিশ্রান্ত বাঙালির দুচোখ বোজা প্রশান্তি।

গাওসুল আলম শাওন গ্রে অ্যাডভারটাইজিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক