ফলে ভরা বাংলাদেশ

১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে বছরপ্রতি ফলের উত্পাদন গড়ে ১১ শতাংশ হারে বেড়েছে। ছবি: প্রথম আলো
১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে বছরপ্রতি ফলের উত্পাদন গড়ে ১১ শতাংশ হারে বেড়েছে। ছবি: প্রথম আলো

ফল উত্পাদনে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুসারে ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে বছরপ্রতি ফলের উত্পাদন গড়ে ১১ শতাংশ হারে বেড়েছে, যা বিশ্বের আর কোনো দেশে সে হারে বাড়েনি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে কাঁঠাল উত্পাদনে দ্বিতীয়, আমে সপ্তম, পেয়ারায় অষ্টম, পেঁপেতে চতুর্দশতম। গত এক দশকে এ দেশের মানুষের ফল খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

বাজারে এখন প্রায় সারা বছর পেয়ারা ও তরমুজ পাওয়া যাচ্ছে, যা এক দশক আগেও ছিল কল্পনার বাইরে। ফল চাষের জমি বৃদ্ধি, ফলের বাণিজ্যিক বাগান সৃজন, বসতবাড়িতে ফল গাছ সম্প্রসারণ, ফল গাছের উত্তম ব্যবস্থাপনা, গবেষণা, দেশি ফল খাওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি, নতুন নতুন বিদেশি ফলের প্রবর্তন ইত্যাদি এ দেশের সামগ্রিক ফল উত্পাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

শত ফলের দেশ
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশকে খুব ছোট দেখালেও তা ফলসম্ভারে পরিপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় চার শতাধিক প্রজাতির ফল জন্মে, এর মধ্যে শতাধিক প্রজাতির ফল এ দেশেই জন্মে। বলা হয়, এ দেশে চাষ করা ফলের প্রজাতির সংখ্যা ৭০। চাষ করা হয় না অথচ খাওয়া হয়, এমন বুনো ফলের সংখ্যা ৬০। সব মিলিয়ে এ দেশে খাওয়ার যোগ্য ফল জন্মে ১৩০টি। এর মধ্যে ১০-১২টি প্রজাতির ফল প্রধান, যেগুলোর চাষ বাণিজ্যিকভাবে করা হয়। যেমন আম, কাঁঠাল, কলা, পেয়ারা, আনারস, পেঁপে, তরমুজ, লিচু, কুল, নারকেল, বিভিন্ন লেবু ইত্যাদি। এগুলোকে বলা হয় প্রচলিত ফল।

অপ্রচলিত ফলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বেল, কতবেল, তেঁতুল, আমড়া, জলপাই, জাম, জামরুল, গোলাপজাম, কমলা, চিনার, লুকলুকি, ডেউয়া, কামরাঙা, করমচা ইত্যাদি। বিভিন্ন বুনো ফল হলো বেতফল, চাপালিশ কাঁঠাল, তিমতোয়া, আঁকুরা, বুটিজাম, পুতিজাম, কাউফল, বঁইচি, কাঠবাদাম, জংলি বাদাম, বন আম ইত্যাদি।

এ দেশে চাষ করা জমির ১ শতাংশের কম জমিতে ফল চাষ করা হয়, যা থেকে বছরে ৫০ লাখ টনের কিছু বেশি ফল উত্পাদিত হয়। সব ফলের মধ্যে শুধু আম, কাঁঠাল ও কলা মিলে উত্পাদিত হয় মোট উত্পাদনের ৬৩ শতাংশ, শুধু আম ২৫ শতাংশ। বিভিন্ন অরণ্যে ও গ্রামীণ বনে বুনো ফলগুলো জন্মে, যা অধিকাংশই পাখি ও বন্য প্রাণীদের আহার।

চাষ করা ফলের উত্পাদন হিসেবে আমাদের দৈনিক বর্তমান ফলের প্রাপ্যতা ৮২ গ্রাম, খাওয়া উচিত ২০০ গ্রাম। অর্থাৎ আমরা এখন রোজ আমাদের চাহিদার ৪৩ শতাংশ মেটাতে পারি, বাকিটুকু যদি খাওয়ার অভ্যাস করতে পারি, তাহলে ফলের উত্পাদন বাড়াতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০৩০ সালে আমাদের ফল উত্পাদন করতে হবে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টন।

দেশের মাটিতে বিদেশি ফল
লিচুকে আমরা বলি দেশি ফল। কিন্তু এই লিচু ফলটিও এসেছিল একসময় সুদূর চীন থেকে, এমনকি লিচু নামটাও আমাদের বাংলা নাম নয়, চীনা শব্দ। এভাবে এখন আমরা যেসব ফলকে দেশি ফল বলে চিনি, এর অনেক ফলই বিদেশ থেকে এসে আমাদের দেশের মাটিতে ঠাঁই করে নিয়েছে। ধীরে ধীরে সেগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সে ধারা অব্যাহত আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।

গত এক দশকে অন্তত কুড়িটি বিদেশি ফলের এ দেশে আগমন ঘটেছে। এগুলো হলো স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুট, মাল্টা, রামবুটান, সাওয়ার সপ বা টক আতা, আলুবোখারা, ম্যাঙ্গোস্টিন, ক্যানিস্টেল বা জামান ফল, প্যাশন ফল, পার্সিমন, অ্যাভোকাডো, কোকো, আঙুর, পিচফল, চেরি, লংগান, সৌদি খেজুর, ব্রেডফ্রুট, শানতোল, রক মেলন ইত্যাদি। এর আগেও এসেছে অনেক বিদেশি ফল, যেমন কাজুবাদাম। এ ছাড়া এমন কিছু ফল, যা এ দেশে ছিল, কিন্তু সেগুলো বেশ কিছু নতুন জাতের আগমন ঘটায়, সেসব ফল চাষে ও উত্পাদনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। থাই পেয়ারা এর অন্যতম উদাহরণ। থাইল্যান্ড থেকে পেয়ারার এ জাতগুলো আসায় এখন আমরা সারা বছরই সুস্বাদু পেয়ারা খেতে পারছি।

একই রকমভাবে এসেছে প্রায় সারা বছর বা অমৌসুমে ধরা সুস্বাদু সুমিষ্ট আমের জাত কাটিমন, দু-তিন কেজি ওজনের আম ব্রুনাই কিং, লাল টুকটুকে বাহারি আম আমেরিকার পালমার, হলদে রঙের কলার মতো লম্বা জাতের আম ব্যানানা ম্যাংগো, এমনকি দেশের মাটিতে সয়লাব হয়ে যাওয়া আম্রপালি, থাই জামরুল, মিষ্টি অরবরই, মিষ্টি তেঁতুল, মিষ্টি করমচা, মিষ্টি কামরাঙা, রঙিন শরিফা, ডোয়ার্ফ নারকেল, অমৌসুমি তরমুজ ইত্যাদি।

ফল নিয়ে গবেষণা
এ দেশে এ পর্যন্ত বিভিন্ন গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক ৪০ প্রজাতির ফলের মোট ১৭৭টি আধুনিক জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবন করেছে ৩৫ প্রজাতির ফলের ৮৪টি জাত, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবন করেছে ২৪ প্রজাতির ফলের ৮৪টি জাত, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবন করেছে ৫ প্রজাতির ফলের ৭টি জাত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবন করেছে ২ প্রজাতির ফলের ২টি জাত। এ ছাড়া উদ্ভাবিত হয়েছে ফল চাষের বেশ কিছু প্রযুক্তি। এসব জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও ব্যবহারে ফলের উত্পাদন দিন দিন বাড়ছে।

ফল আমদানি হ্রাস
ফলের ঘাটতি ও চাহিদা থাকায় বর্তমানে এ দেশের বাজারে বেশ কিছু বিদেশি ফল পাওয়া যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আপেল, আঙুর, কমলা, নাশপাতি, বেদানা, কিউই, ড্রাগন ফ্রুট, পার্সিমন, আম, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি। দেশে উত্তরোত্তর ফলের উত্পাদন ও মানুষের দেশি ফলের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির কারণে বিদেশি ফলের আমদানি ধীরে ধীরে কমছে। ২০১৭-১৮ সালে বিদেশ থেকে ফল আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩ লাখ ৫৬ হাজার টন, ২০১৮-১৯ সালে তা কমে ৩ লাখ টনের কাছাকাছি হয়েছে।

বারো মাসের ফল
সারা বছর আমরা সমানভাবে ফল পাই না। এক পুরোনো হিসাবে দেখা যায়, মে থেকে আগস্ট—এই চার মাসে উত্পাদিত হয় মোট ফলের ৫৪ শতাংশ, বাকি আট মাসে উত্পাদিত হয় ৪৬ শতাংশ। আসলে সাম্প্রতিক পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ফল উত্পাদনের এ হিসাবচিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। কেননা, এখন অমৌসুমে, বিশেষ করে সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ পেয়ারা, তরমুজ, মাল্টা, কমলা ইত্যাদি ফল উত্পাদিত হওয়ায় প্রধান ফলমৌসুম ছাড়া অন্য মৌসুমেও বাজারে আমরা ফল পাচ্ছি। কলা ও পেঁপের প্রাপ্যতা রয়েছে সারা বছর। আধুনিক কিছু জাত উদ্ভাবন ও প্রবর্তনের ফলে এখন বছরে প্রায় সাত মাস ধরে আম পাওয়া সম্ভব হচ্ছে, যা আগে দু-তিন মাসের বেশি ছিল না।

বাগানের চেয়ে এ দেশে বসতবাড়ির আঙিনা ও তার পার্শ্ববর্তী জমিতে ফল বেশি উত্পাদিত হয়। তাই বারো মাস ফলের প্রাপ্যতার জন্য সম্ভব হলে প্রতিটি বসতবাড়িতে পরিকল্পনা করে কিছু ফল গাছ লাগানো যায়। সাধারণভাবে বসতবাড়িতে লাগানোর জন্য মাল্টা (জানুয়ারি), কুল (ফেব্রুয়ারি), বেল (মার্চ), শরিফা ও আতা (এপ্রিল), জাম (মে), আম, লিচু (জুন), কাঁঠাল (জুলাই), পেয়ারা (আগস্ট), আমড়া (সেপ্টেম্বর), জলপাই (অক্টোবর), ডালিম (নভেম্বর), কমলালেবু (ডিসেম্বর) নির্বাচন করা যেতে পারে। এভাবে পরিকল্পিত ফল চাষে দেশে ফলের উত্পাদন ও সারা বছর ধরে প্রাপ্যতা আরও বাড়তে পারে।

মৃত্যুঞ্জয় রায় কৃষিবিদ ও লেখক