রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের স্বপ্নদ্রষ্টা

ছিলেন বিমানবাহিনীর পাইলট। কিন্তু দুর্ঘটনার কারণে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিমানবাহিনী ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন অর্থশাস্ত্রের পড়াশোনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ার সময় যুক্ত হন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গেও। ১৭ বছর বয়সে অংশ নেন ভাষা আন্দোলনে। পাকিস্তান সরকারের অধীনে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন মোহাম্মদ নুরুল কাদের। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পাবনার জেলা প্রশাসক। এই সময়ে সরাসরি অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। খান সেনাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের অংশ হিসেবে নুরুল কাদের নিজের নাম থেকে ‘খান’ পদবিটি বাদ দেন। তাঁর

নুরুল কাদের, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
নুরুল কাদের, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

যুদ্ধকালীন গঠিত মুজিবনগর সরকারের তিনি ছিলেন সংস্থাপনসচিব। অতএব তিনিই বাংলাদেশের প্রথম সংস্থাপনসচিব। নুরুল কাদেরের স্বাক্ষরে বাংলাদেশ সরকার নামাঙ্কিত রাবার ট্যাম্প ব্যবহার করেই বাংলাদেশ সরকারের দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হয়। ছিলেন বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের প্রথম চেয়ারম্যান। যদিও তখন সেটি ছিল পর্যটন ব্যুরো। নুরুল কাদেরই এটিকে করপোরেশনে রূপ দেন। বর্তমানে করপোরেশনের যে লোগোটি রয়েছে, সেটি সম্প্রতি প্রয়াত চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারকে দিয়ে করিয়েছিলেন তিনি।

স্বাধীন দেশে খুব বেশি দিন সরকারি চাকরি করা হয়নি তাঁর। ১৯৭৩ সালে ইস্তফা দিয়ে ব্যবসায় উদ্যোগী হন। শুধু পোশাকশিল্পের পথিকৃৎ নয়, বাংলাদেশের অনেক শুরুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নুরুল কাদেরের নাম। প্রথমে শুরু করেন ইনডেনটিং ব্যবসা। এরপর ছোটখাটো আরও কিছু ট্রেডিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ১৯৭৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু করপোরেশনের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন দেশের প্রথম তৈরি পোশাক রপ্তানির কারখানা ‘দেশ গার্মেন্টস’। তাঁর হাত ধরে শুরু হয় এ দেশে তৈরি পোশাকের বিদেশযাত্রা। বর্তমানে এ দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের, যার ভিত তৈরি করেছিল ‘দেশ গার্মেন্টস’। 

আশির দশকের শেষ ভাগে এসে যুক্তরাষ্ট্র পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে কোটাপ্রথা চালু করে। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশের রপ্তানি সীমিত হয়ে পড়ে। ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু করপোরেশনের উৎপাদন ও রপ্তানি। ওই সময় দাইয়ু করপোরেশনের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি করেন নুরুল কাদের।

দ্বিপক্ষীয় ওই চুক্তিতে বলা হয়, দাইয়ু করপোরেশনের হয়ে বাংলাদেশে পোশাক বানাবে দেশ গার্মেন্টস। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় কারখানা চালু করতে গিয়ে। কারণ এ দেশে তখনো পোশাক তৈরির দক্ষ কোনো জনবল ছিল না। আর তাই চুক্তি অনুযায়ী, কারখানা শুরু করতে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির জন্য এ দেশ থেকে কিছু লোককে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে শ্রমিক হিসেবে কাজের জন্য সংগ্রহ করা হয় ১৩৬ জন কর্মী, যার মধ্যে ১৬ জন ছিলেন নারী। এই ১৩৬ জনকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণে পাঠানো হয় কোরিয়ায়। 

রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানায় কাজ চলছে। ছবি: হাসান রাজা
রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানায় কাজ চলছে। ছবি: হাসান রাজা

বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মিবাহিনী তৈরির পরও দেশ গার্মেন্টসের যাত্রাটি মসৃণ ছিল না। উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে অর্থসংকটে পড়েন নুরুল কাদের। কারখানাটি শুরুর জন্য ১৮ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করেছিল ব্যাংক। কিন্তু কারখানা শুরু করতে গিয়ে তিনি ব্যাংক থেকে পান মাত্র ২৪ লাখ টাকা। এ টাকায় কারখানা সচল রাখা ছিল প্রায় অসম্ভব। তখন নুরুল কাদেরের মাথায় আসে ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধার বিষয়টি। ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ছিলেন এম নূরুল ইসলাম, যিনি ছিলেন নুরুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।তাঁরই সহায়তায় ব্যাক টু ব্যাক এলসি–সুবিধা চালুর ব্যবস্থা করেন। তাতেই টিকে যায় তাঁর ব্যবসা। কেবল ব্যাক টু ব্যাক এলসি নয়, বন্ডেড ওয়্যার হাউস, আমদানি প্রাপ্যতা বা ইউডি সনদ ইত্যাদি ব্যবস্থার ওপর ভর করে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। আর এসব ব্যবস্থাই চালু হয় নুরুল কাদেরের হাত ধরে।

১৯৯৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নুরুল কাদেরের সব স্বপ্নজুড়ে ছিল ‘দেশ’ আর এ দেশের তৈরি পোশাক খাত। বর্তমানে ‘দেশ গার্মেন্টস’ চলছে দেশ গ্রুপের অধীনে। যার চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন প্রয়াত নুরুল কাদেরের স্ত্রী রোকেয়া কাদের। আর একমাত্র পুত্র ওমর কাদের খান এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও একমাত্র মেয়ে ভিদিয়া অমৃত খান পালন করছেন পরিচালকের দায়িত্ব। গ্রুপের পক্ষে দেশ গার্মেন্টসের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন বিদ্যা অমৃত খান।

দ. কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ চলাকালে তৈরি প্রথম শার্ট
দ. কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ চলাকালে তৈরি প্রথম শার্ট

নুরুল কাদেরের জন্ম ময়মনসিংহে। কিন্তু ‘দেশ’ গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করেছেন চট্টগ্রামের কালুরঘাটে। চট্টগ্রামে কারখানা করার কারণ সম্পর্কে ভিদিয়া জানান, রপ্তানির ক্ষেত্রে বন্দর–সুবিধার কারণেই চট্টগ্রামে কারখানাটি গড়ে তোলা হয়েছিল। বর্তমানে ৯০০ শ্রমিক কাজ করেন এ গার্মেন্টস কারখানায়।

দেশের প্রথম রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস হলেও গত প্রায় ৪১ বছরে এটির উৎপাদন কার্যক্রমের তেমন একটা সম্প্রসারণ হয়নি। কারণ হিসেবে ভিদিয়ার অভিমত, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূল কারখানাটি। তখন কারখানার কার্যক্রম আগ্রাবাদে স্থানান্তর করা হলেও মূল কারখানাটি বন্ধ ছিল প্রায় পাঁচ বছর। ধাক্কা কাটিয়ে ১৯৯৬ সালে পুনরায় উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হলেও দুই বছরের মাথায় এসে ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে কারখানার স্বপ্নদ্রষ্টা মোহাম্মদ নুরুল কাদের মারা যান। আবারও ধাক্কা খায় প্রতিষ্ঠানটি। আর্থিকভাবে চরম দুর্দিনের পাশাপাশি নুরুল কাদেরের মৃত্যুর পরও কারখানাটি বন্ধ করেনি তারা। কারণ এটির সঙ্গে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ইতিহাস জড়িত। সব প্রতিকূলতা জয় করে এখন কারখানাটি একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এখন নতুন করে সম্প্রসারণে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।

দেশ গ্রুপের চেয়ারম্যান রোকেয়া কাদের বলেন, শুরুতে যেসব কর্মীকে কোরিয়ায় প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছিল তাঁদের অনেকে এখন নিজেরাই পোশাক খাতের উদ্যোক্তা। 


সুজয় মহাজন বাণিজ্য সম্পাদক, প্রথম আলো