পাহাড়ের মোনঘর

প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই রাঙামাটি শহরের উপকণ্ঠে রাঙাপানি এলাকায় ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠে। ভোরবেলার এ ঘণ্টাধ্বনি নতুন আগন্তুকদের কাছে ধাঁধা মনে হতেই পারে। আদতে তা জুম পাহাড়ের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত ‘মোনঘর’–এর দিন শুরুর বার্তাধ্বনি। এই ঘণ্টাধ্বনির শব্দে মোনঘরের বিশাখা ভবন, সিদ্ধার্থ ভবন, মৈত্রী ভবন, করুণা ভবন, প্রজ্ঞা ভবনসহ সেখানকার ১২টি আবাসিক ভবনের শিক্ষার্থীরা জেগে ওঠে। ওরা সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে সমস্বরে গেয়ে ওঠে প্রাতঃসংগীত—‘আমা জাগা আমা ঘর, আমা বেগ মোনঘর, সুঘে-দুঘে ইধু থেই, বেক্কুন আমি ভেই ভেই…।’ এ গানের অর্থ হলো, ‘আমাদের জায়গা আমাদের ঘর, আমাদের সবারই মোনঘর, সুখে-দুঃখে থাকি এখানে, মোরা সবাই ভাই ভাই।’ এ সংগীতে দিন শুরু হয় শিক্ষার্থীদের।

সবুজ ছায়ায় ঘেরা মোনঘর শিশুসদনটি প্রায় ৪০ একর পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। ১৯৭৪ সালে সমাজহিতৈষী কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর উদ্যোগে মোনঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের সুবিধাবঞ্চিত গরিব, এতিম ও দুস্থ শিশুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় এবং শিক্ষা নিশ্চিত করা। মূলত ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের বড় একটি অংশ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। বাস্তুচ্যুত হওয়ার ফলে তারা আর্থিকভাবে যেমন চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, তেমনি তাদের সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনও ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গিয়েছিল। যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একে তো পার্বত্য চট্টগ্রামে সে সময় শিক্ষার বিস্তার তেমন ছিল না, তার ওপর কাপ্তাই বাঁধের নেতিবাচক প্রভাব সেখানকার অধিবাসীদের উদ্​ভ্রান্ত করে ফেলেছিল। কাপ্তাই হ্রদের পানিতে তলিয়ে যাওয়া ঘরহারা, ভিটেহারা এসব দুঃখী মানুষ এ ক্রান্তিকাল কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে করতেই আবার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ফলে বাস্তুচ্যুত এ মানুষগুলো নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে থিতু করার মতো সময়, পরিবেশ ও পরিস্থিতি—কোনোটাই পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকায় পাহাড়ের শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে যেন আরও দূরে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল। 

বিশেষ করে আশির দশকের শেষের দিকে পার্বত্য অঞ্চল থেকে বিরাট একটি অংশ (পাহাড়ি) যখন ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, তখন বহু শিশু-কিশোর আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। নিরাপদ আশ্রয় ও সন্তানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে সে সময় অনেক অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের মোনঘরে রেখে পড়াশোনা করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফলে আবাসিক এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভিড় ক্রমশ বাড়তে থাকে। এভাবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, সুবিধাবঞ্চিত, এতিম শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষায় গড়ে তুলে পাহাড়ি সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই গুরু ভান্তে নামে খ্যাত শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী ভিক্ষুর নেতৃত্বে শ্রীমৎ বিমল তিষ্য ভিক্ষু, শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষুসহ পাঁচজন ভিক্ষু মোনঘর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

মোনঘরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা ১৯৭৪ সালে শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন ঘটে আরও আগে। শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী ভিক্ষু ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ির ‘গৌতম বিহার’-এ গিয়ে অবস্থান শুরু করেন। কাপ্তাই হ্রদের জলে সেই বিহার ডুবে যাওয়ার পর তিনি খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার বৌদ্ধ দায়ক-দায়িকাদের আমন্ত্রণে ‘বোয়ালখালী দশবল বৌদ্ধবিহারে’ অধ্যক্ষ হিসেবে চলে যান। জ্ঞানশ্রী ভিক্ষু বিহার এলাকার শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষায় গড়ে তোলার লক্ষ্যেই ১৯৬১ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’। এ আশ্রম মূলত এলাকাবাসীর সহায়তায় পরিচালিত হতো। ১৯৬৮ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক এটি নিবন্ধিত হয়। স্বাধীনতার পর সারা দেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও পাহাড়িদের বিরাট একটি অংশ অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকার শিশুদের এই অনাথ আশ্রমে আশ্রয় নেওয়ার হার অনেক বেড়ে যায়। সে সময় দীঘিনালা ছিল অত্যন্ত দুর্গম এলাকা এবং যোগাযোগব্যবস্থা নাজুক হওয়ার কারণে প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ অন্যান্য কাজে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। তাই ১৯৭৪ সালে এ অনাথ আশ্রম দীঘিনালা থেকে রাঙামাটি শহরের কাছে রাঙাপানির মিলন বিহারকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। সাড়ে চার দশক ধরে সেই ‘মোনঘর’টি তার শিক্ষার আলো পাহাড়, সমতল ও সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। 

ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তার বৈচিত্র্যময় নানা সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ে তোলাই মোনঘর শিশুসদনের লক্ষ্য। ছবি: প্রথম আলো
ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তার বৈচিত্র্যময় নানা সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ে তোলাই মোনঘর শিশুসদনের লক্ষ্য। ছবি: প্রথম আলো

মোনঘর প্রথম দিকে অনাথ ও দুস্থ শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এটির পরিসর অনেক বেড়ে গেছে। মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়, মোনঘর শিশুসদন ছাড়াও মোনঘরের অধীন ভোকেশনাল স্কুল, পালি কলেজ, কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার, রিসোর্স সেন্টার, মিনি হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বর্তমানে মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ে প্রায় ১ হাজার ১০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৬৫০ জন আবাসিক। মেয়েদের জন্য ‘বিশাখা ভবন’ নামে আলাদা কম্পাউন্ডসহ আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য ১২টি আবাসিক ভবন রয়েছে। আবাসিক শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দানের জন্য মোনঘরের কম্পাউন্ডেই ১২ বেড–সংবলিত একটি মিনি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ হাসপাতালে সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য একজন খণ্ডকালীন ডাক্তার (এমবিবিএস), একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট, একজন নার্স ও একজন আয়া কর্মরত রয়েছেন। 

সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মোনঘরের ছাত্রছাত্রীরা যাতে তথ্যপ্রযুক্তি ও বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষায় পিছিয়ে না থাকে, সে জন্য কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার, ভোকেশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মোনঘরের ছাত্রছাত্রীরা যাতে বিশ্বের ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে, সে জন্য মোনঘর রিসোর্স সেন্টারে রয়েছে নানা সাময়িকী, প্রামাণ্যচিত্র, চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন লেখক ও প্রকাশনীর বই। 

আগেই উল্লেখ করেছি, মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়টি মূলত সুবিধাবঞ্চিত গরিব, এতিম ও দুস্থ শিশু-কিশোরদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। মোনঘরের আরেকটি অনন্য ভূমিকার কথা হয়তো অনেকে জানেন না, তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া অনেক কন্যাশিশুকে মোনঘর পরম মমতা ও ভালোবাসায় আশ্রয় দিয়েছে। এ কন্যাশিশুদের আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি পড়া শোনা এবং তাদের জীবনের ওপর ঘটে যাওয়া দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে এসে আগামীর স্বপ্ন দেখাচ্ছে মোনঘর। শুধু শিশুরা নয়, অনেক অসহায় নারীও মোনঘরের নিরাপদ ছায়ায় আশ্রয় খুঁজে নেয়। এ যেন অসহায় আশ্রয়হীনদের এক মিলনক্ষেত্র ‘মোনঘর’। 

মোনঘরের বর্তমান নির্বাহী পরিচালক অশোক কুমার চাকমা। তিনি মোনঘরেরই একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী। অশোক চাকমা মোনঘর আবাসিক স্কুলে পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরে বৃত্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করে দেশে ফিরে বর্তমানে মোনঘরের হাল ধরেছেন। উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে তিনি নিঃসন্দেহে বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে ভালো অবস্থানে চাকরি করতে পারতেন! কিন্তু তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, যে মোনঘর তাঁকে ছায়া-অন্ন, শিক্ষা দিয়ে এ পর্যায়ে আসতে সহায়তা করেছে, এবার সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রতিদান দেওয়ার সময় এসেছে। মোনঘরকে টিকিয়ে রাখতে হলে দূরদর্শিতাসম্পন্ন একজন দক্ষ প্রশাসকের প্রয়োজন। তাই তিনি সেই দায়বদ্ধতা থেকেই মোনঘরের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। অশোক চাকমা বলেন, ‘মোনঘর না হলে আমার পড়াশোনা করার সুযোগই হতো না। পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে আমাকে ভারতে শরণার্থী হিসেবে দিন কাটাতে হয়েছে। সেখান থেকে মোনঘরে এসে আবার পড়াশোনা করার সুযোগ তৈরি হয়। তাই এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমি যেমন চিরকৃতজ্ঞ, তেমনি এই প্রতিষ্ঠানকে দেশের অন্যতম শীর্ষ আবাসিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার প্রচেষ্টা সর্বদা আমার মনে মধ্যে কাজ করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার চেয়েও প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা পাহাড়ের আনাচ-কানাচে পড়ে রয়েছে। তাদের জন্য ন্যূনতম শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা আমাদের মোনঘর অতীতে যেমন করেছিল, তেমনি ভবিষ্যতেও সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’

বর্তমানে মোনঘরের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছেন। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বেসরকারি ও বিদেশি সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ পদেও মোনঘরের শিক্ষার্থীরা দক্ষতার সঙ্গে তাঁদের কর্মজীবন পালন করে যাচ্ছেন। 

১৯৮৯ সালে মোনঘরের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ‘দ্য মনোঘরিয়ান্স’ নামের একটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলেন। ২০১১ সাল থেকে এই অ্যাসোসিয়েশন ‘হায়ার এডুকেশন লোন প্রোগ্রাম (হেল্প) নামে একটি প্রোগ্রাম চালু করে। এ প্রোগ্রামের মাধ্যমে মোনঘরের মেধাধী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য ঋণ নিতে পারেন। সুদবিহীন এ ঋণের শর্ত হলো, যখন সেই শিক্ষার্থী তাঁর কর্মজীবন শুরু করবেন, তখন এ প্রোগ্রাম থেকে প্রাপ্ত ঋণ ধীরে ধীরে পরিশোধ করে দেবেন, যাতে পরবর্তী সময়ে অন্য শিক্ষার্থীরা এ সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন। 

মোনঘর একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এটি বিভিন্ন সংস্থার অর্থায়ন ও অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে আর্থিক ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও মোনঘর নিবেদিতচিত্তে আর্তমানবতার সেবা দিয়ে সব জাতিসত্তার মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধনের মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে চলেছে। মোনঘরের লক্ষ্যই হলো, এ দেশের ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তার বৈচিত্র্যময় নানা সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা। 


ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকারকর্মী ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক