আয়ু বাড়ছে, বাড়াতে হবে স্বাস্থ্যসেবাও

.
.

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষে মানুষের গড় আয়ু অনেক বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে। ১৯২১ সালের লোকগণনায় এ দেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ২০ বছর, যা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭২ বছরে। বলা হয়, বার্ধক্য হচ্ছে উন্নয়নের উপজাত। দারিদ্র্য নয়, বরং সচ্ছলতাই বার্ধক্যকে প্রলম্বিত করে। যে সমাজ যত উন্নত, প্রবীণদের সংখ্যা আর ভোগান্তিও সেখানে ততোধিক। নাগরিকেরা যত সচ্ছল হয়, উপযোগী খাদ্য-পুষ্টি, ঘর-বিছানা, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, ওষুধ–পথ্য, বিনোদন-নিরাপত্তা, সুযোগ-সুবিধা, যশ-খ্যাতি ইত্যাদি তত সহজে কিনতে পারে বলে তাদের বার্ধক্য দীর্ঘতর হয়। শিল্পোন্নত দেশগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আরও বেশি দিন বাঁচার কলাকৌশল ও দাওয়াই আবিষ্কারে উন্নত দেশ বেশ জোরেশোরে এগোচ্ছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে আয়ু বাড়ানোর জন্য গবেষণা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের বার্ধক্য পরিস্থিতি খানিকটা ভিন্ন। ভৌগোলিকভাবে খুব ছোট এই দেশে বর্তমানে বাস করছেন প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ প্রবীণ (৬০ বা তদূর্ধ্ব বছর বয়সী)। বিশ্বে এখন এমন ৮০টির মতো দেশ আছে, যাদের নিজেদের মোট জনসংখ্যাই এর চেয়ে কম। এখানেই শেষ নয়, ২০২৫, ২০৫০ ও ২০৬১ সাল নাগাদ এ দেশের প্রবীণদের সংখ্যা যথাক্রমে ১ কোটি ৮০ লাখ, সাড়ে ৪ কোটি ও সাড়ে ৫ কোটিতে দাঁড়াবে বলে জনসংখ্যাবিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন।

বাস্তবে প্রবীণদের অবস্থান তিন ধরনের। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৬০-৭০ বছর বয়সীদের তরুণ-প্রবীণ, ৭০-৮০ বছর বয়সীদের মধ্যম-প্রবীণ ও ৮০ বা তদূর্ধ্ব বছর বয়সীদের অতিপ্রবীণ বলে চিহ্নিত করা হয়। অবস্থানের ভিন্নতায় প্রবীণদের চ্যালেঞ্জ ও চাহিদাও ভিন্নতর হয়। এ ছাড়া লিঙ্গ, স্বাস্থ্যগত ও আর্থসামাজিক অবস্থা, পারিবারিক কাঠামো, গ্রাম-শহরে বসবাস ইত্যাদির প্রভাবও এখানে খুবই সংবেদনশীল।

অবশ্যম্ভাবী বার্ধক্য মোকাবিলায় বাংলাদেশের ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। নিজের বার্ধক্যের ব্যাপারে নাগরিকেরা শুনতে চান না, বুঝতে চান না, মানতে পারেন না। তাঁরা এখনো বড্ড প্রতিক্রিয়াশীল (Reactive); কিন্তু বার্ধক্য মোকাবিলায় সবার পূর্বক্রিয়াশীল (Proactive) হওয়া উচিত। ৭০-৭৫ বছর বয়সের পর আপনি কোথায়, কীভাবে, কার সঙ্গে বসবাস করবেন, তার বাস্তব পরিকল্পনা যুব বয়সেই থাকা সমীচীন। বার্ধক্যে আপনার শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, পারিবারিক, সামাজিক ক্ষেত্রের শক্তি-সামর্থ্য যারপরনাই দুর্বল হয়ে পড়বে, স্বজনদের আদর-সমাদর সব উবে যেতে থাকবে। পাশাপাশি বহুমাত্রিকভাবে আপনার চিকিৎসা, ওষুধ–পথ্য, খাদ্য-পুষ্টি, সেবা-পরিচর্যা, টাকাপয়সা ইত্যাদির একান্ত চাহিদা বেড়ে যাবে।

শেষ বয়সে ব্যক্তির চারটি বিষয় সার্বক্ষণিকভাবে জরুরি হিসেবে দেখা দেয়। উপযোগী খাদ্য-পুষ্টি আর ঘর-বিছানা; হাতের নাগালে চিকিৎসাসেবা; সমবয়সীদের সাহচর্য ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। নিজ বাড়িতে এগুলোর আয়োজন খুব দুরূহ, বিশেষ করে অতিপ্রবীণ ও শয্যাশায়ী প্রবীণদের জন্য। এশীয়, ভারতীয় ও মুসলিম কৃষ্টির সংমিশ্রণে গঠিত আমাদের সংস্কৃতিতে প্রবীণজনের দেখভাল করার কথা পরিবারের। কিন্তু পরিবার পরিকল্পনা অনুসরণের পর আমাদের পরিবারকাঠামোতে পরিবর্তন এসেছে। পরিবারে সন্তান কম জন্মাচ্ছে, মেয়েরা শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত হচ্ছেন, নারী-পুরুষ নানা কর্মে জড়িয়ে বাড়ির বাইরে বেশি সময় কাটাচ্ছেন আর একক পরিবারে অধিকাংশ প্রবীণ-প্রবীণার স্থানসংকুলান হচ্ছে না। আবার স্বাধীনভাবে বসবাসের জন্য এ দেশে পর্যাপ্ত প্রবীণ নিবাস নেই। বর্তমানে দেশে সাকল্যে দু-তিন হাজার প্রবীণের জন্য স্বতন্ত্র আবাসনের ব্যবস্থা আছে। অর্থবিত্ত থাকা সত্ত্বেও আমাদের সমাজে প্রবীণ-প্রবীণাদের জন্য কাঙ্ক্ষিত সেবার ব্যবস্থা নেই। অবিবাহিত, বিধবা, সন্তানহীন, শুধু কন্যাসন্তানধারী, স্বজন-পরিত্যক্ত, সমাজবিচ্ছিন্ন, একক, প্রতিবন্ধী প্রভৃতি প্রবীণ ব্যক্তিদের অবস্থা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। উপরন্তু তাঁরা নারী ও অসচ্ছল হলে ভোগান্তির কোনো সীমা থাকে না।

প্রত্যেকের স্মরণে রাখা দরকার, যেকোনো প্রকারেই হোক, আপনার বার্ধক্য কিন্তু আপনাকেই সামলাতে হবে। জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগামী ২০২০-৩০ সালকে স্বস্তিময় বার্ধক্য দশক ঘোষণা করেছে। বার্ধক্যে ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত কর্মক্ষমতা সচল রাখা এবং তাঁর বহিঃস্থ পরিবেশ অনুকূল রাখার ব্যবস্থাই হচ্ছে স্বস্তিময় বার্ধক্য। জুতসইভাবে বার্ধক্য মোকাবিলায় এ বছর ১ অক্টোবর প্রকাশ করেছে প্রবীণদের জন্য সমন্বিত সেবাদান কৌশল পুস্তিকা।

উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও সুযোগ–সুবিধার কারণে বার্ধক্য দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো
উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও সুযোগ–সুবিধার কারণে বার্ধক্য দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো

ব্যক্তি প্রবীণ হন শরীরে। বার্ধক্য মূলত শারীরিক বা স্বাস্থ্যগত ক্ষয়িষ্ণু প্রক্রিয়া। বয়স ৪০ পেরোলেই মানবচোখের দৃষ্টিতে বার্ধক্যের আগমন ঘটে। এরপর ধীরে ধীরে শরীরের সব অঙ্গ বার্ধক্য গ্রাস করে ফেলে। বয়স ৮০ পার হলে গোটা শরীরকাঠামো কোনোক্রমেই ন্যূনতম স্তরে সচল থাকে না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ভিন্ন আর সব মন্ত্রণালয় বার্ধক্য বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। এমনকি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রবীণকল্যাণের জন্য স্বতন্ত্র কোনো কর্মসূচিই নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কাজ করে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। বাংলাদেশে ১ কোটি ৪০ লাখ প্রবীণ আছেন, যাঁদের ৯০ শতাংশ অসুস্থ বা নানা রোগশোকে আক্রান্ত। অথচ এ দেশে হাতে গোনা পাঁচজন বার্ধক্যজনিত রোগের চিকিৎসক নেই। এ বিষয়ে নেই প্রবীণদের সেবাদানে দক্ষ নার্স, থেরাপিস্ট, দন্তচিকিৎসক, আইনজীবী, বিমা ব্যবস্থাপক প্রভৃতি অত্যাবশ্যকীয় পেশাজীবী।

ক্ষুধা ও খাদ্য-পুষ্টি বিষয়ে আমরা শিশুদের কথাই প্রধানত চিন্তা করি। প্রবীণ ব্যক্তিদের বেলায় থাকি খুবই উদাসীন। তাঁদের একান্ত চাহিদা, বাসনা, সাধ-আহ্লাদ, আগ্রহ, আকুতি, অগ্রাধিকার ইত্যাদি বিষয় আমরা তেমন আমলে নিই না।

এ দেশের মুসলিম প্রবীণ নারীকে তাঁর প্রাপ্য দেনমোহর এবং পিতা ও স্বামীর সম্পত্তির অংশ থেকে নিজের স্বামী, আপন ভাই এবং পুত্রেরাই বঞ্চিত করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। পরিবারের অভ্যন্তরে প্রবীণজনেরা আজ নানাভাবে অবহেলিত, বঞ্চিত, নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হচ্ছেন বলে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে। হাজারো এনজিওসমৃদ্ধ বাংলাদেশে হাতে গোনা দু-চারটি এনজিও প্রবীণকল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। কারণ, এ ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি অর্থায়নের চরম সংকট।

প্রবীণজন, বিশেষ করে অতিপ্রবীণদের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যসেবা এবং পেলিয়েটিভ সেবাব্যবস্থা। ক্লিনিক ও হাসপাতালে রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়; রোগীর নয়। বাস্তবে রোগ নিরাময়ের পর রোগীকে হাসপাতাল ছাড়তে হয়। কিন্তু নানা ধরনের রোগ প্রবীণদের ছেড়ে তো যায়ই না, বরং দিন দিন আরও জেঁকে বসে। বাংলাদেশে এখনো এ ধরনের সেবা কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তা ছাড়া জীবনের অন্তিমলগ্নে প্রবীণজন যতটা সম্ভব কম কষ্টে, কম ব্যথা অনুভবে, যাতনা লাঘবে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন, সে লক্ষ্যে পেলিয়েটিভ সেবার আয়োজন করা খুবই জরুরি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি খুব স্বল্প পরিসরে এই সেবা চালু করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সম্প্রতি একটি জেরিয়েট্রিক ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। তবে সম্মানিত প্রবীণদের জন্য সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে স্বতন্ত্র সেবা গ্রহণের নির্ঝঞ্ঝাট তেমন কোনো আয়োজনই নেই।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান প্রবীণজনের কল্যাণে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সরকার কিছুটা ইতিবাচক। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগগুলো এ ক্ষেত্রে খুব আশাব্যঞ্জক। তাঁর নেতৃত্বে এসেছে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি, জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩, পিতামাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩, অবসর গ্রহণের বয়স বৃদ্ধি, পেনশনব্যবস্থা পুষ্টকরণ, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতাসহ অন্যান্য ভাতাব্যবস্থা। প্রবীণদের সেবাকাজ সুবিন্যস্ত করায় একটি ফাউন্ডেশন গঠনের লক্ষ্যে সরকার প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া ১৯৬০ সালে স্থাপিত বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের সব শ্রেণির প্রবীণের কল্যাণে সরকার গোড়া থেকেই পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। সাম্প্রতিক কালে সরকারি সহযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঢাকার আগারগাঁওয়ে গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র প্রবীণ হাসপাতাল, প্রবীণ নিবাস, জেরিয়েট্রিক ইনস্টিটিউট। সমাজকল্যাণ এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতায় দেশব্যাপী ৮২টি শাখার মাধ্যমে এই সংঘ প্রবীণদের কল্যাণে যৎকিঞ্চিৎ ভূমিকা রেখে চলেছে। দেশের বিরাটসংখ্যক প্রবীণের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করতে সবাইকে নিজ স্বার্থে সক্রিয় হতে হবে। পেশাগত ও সাধারণ শিক্ষা পাঠ্যক্রম, গণমাধ্যম, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সব দেশের সব মন্ত্রণালয়ের চলমান কার্যক্রমে বার্ধক্য ও প্রবীণকল্যাণ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এসডিজির আলোকে কাউকে ফেলে রেখে নয়, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য নিতে হবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লাগসই কর্মসূচি।

ড. এ এস এম আতীকুর রহমান, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাসচিব, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ