'ওষুধের দাম সরকার নিয়ন্ত্রণ করুক'

>ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, ওষুধনীতির অন্যতম প্রণেতা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
.
.

প্রথম আলো: স্বাস্থ্যনীতি ও ওষুধনীতির সঙ্গে আপনি যুক্ত ছিলেন। এখন কী ভাবছেন?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: ১৯৯০ সালে এরশাদের আমলে স্বাস্থ্যনীতি সংসদে উঠেছিল। এটাই একমাত্র নীতি, যা নিয়ে সংসদে বিতর্ক হয়েছিল, কিন্তু তা অকার্যকর রয়ে গেছে। এর আগে ১৯৮২ সালে ওষুধনীতি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হয়। এর মূল কথা ছিল, ওষুধের মান নিশ্চিত করবে কোম্পানি। নজরদারি ও সব ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার। ওষুধ অন্যান্য পণ্য থেকে আলাদা, ক্রেতা যার কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যা মালিক ও পরে চিকিৎসকেরা নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই ৫০০ মিলি গ্রামের একটি ট্যাবলেট ৩০ টাকাও আছে। আবার ৩ টাকাও আছে। উৎপাদন খরচ যার ৮০ পয়সার কম, তা–ও বিক্রি হয় ৫ টাকা। আমরা বলেছি, সরকার উৎপাদককে পর্যাপ্ত বেনিফিট দেওয়া সাপেক্ষে জনস্বার্থের সুরক্ষা দেবে। ডব্লিউএইচওর প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকা অনুযায়ী ওষুধ তৈরি করায় মান নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়েছে। একাধিক ওষুধের সংমিশ্রণ ক্ষতি ডেকে আনে। যেমন ডেঙ্গুর একক ওষুধ প্যারাসিটামল। কিন্তু বাজারে এখন প্যারাসিটামল বহু। ১৯৯৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া একটি ভুল করেন। এর ফলে ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা সরকার থেকে কোম্পানির হাতে চলে যায়। ওষুধের দাম বাড়লে মুনাফা বাড়ে, একই সঙ্গে খারাপ ওষুধও বাড়তে থাকে। এখন বাজারে নকল ও ভেজাল ওষুধের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাই অবিলম্বে দাম নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারকে নিতে হবে। একই সঙ্গে একই ধরনের ওষুধের উৎপাদনে রাশ টানতে হবে। যত দূর সম্ভব, ওষুধের কাঁচামাল বাংলাদেশে তৈরি করতে হবে। কারণ, ২০২৫ সালে বাংলাদেশ যখন উন্নত দেশের মর্যাদার দিকে অগ্রসর হবে, তখন তাকে নানাবিধ নিয়মকানুনের সম্মুখীন হতে হবে। তখন যাতে জনগণের অসুবিধা না হয়, তার প্রস্তুতি নিতে হবে। সরকারের ওষুধ কোম্পানি এসেনসিয়াল ড্রাগস। এর উৎপাদন বাড়িয়ে তার দামের প্রতি সরকারি নজরদারি লাগবে। সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহে তাকেও দরপত্রে যেতে হবে, তাহলে তার দামটাও নিয়ন্ত্রিত থাকবে। আমি মনে করি, ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ সরকার হাতে তুলে নিলে এক সপ্তাহের মধ্যে সমাজে এর বিরাট ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটা করতে পারলে বোঝা যাবে, সরকার কার স্বার্থ রক্ষা করে। মানুষের, নাকি ব্যবসায়ীদের?

প্রথম আলো: ওই ভুল শোধরাতে আপনি কী করেছেন?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকতে বারবার তাঁকে মনে করিয়েছি। তখন তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ভ্রান্ত পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন। দাবি করা হয়েছিল, ওষুধ রপ্তানির আয় সবজি বা পান রপ্তানির চেয়ে কম হয়। এটা বাড়বে। অথচ সেটা হয়নি।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

১৯৮২ সালে সালমান সাহেবদের ব্যবসা বছরে ৩৪ লাখ টাকা ছিল। সেটা এখন কয়েক হাজার কোটি টাকা হয়েছে। প্যারাসিটামলের দাম সরকার নির্ধারণ করে। সেটা চিকিৎসকেরা এখন লেখেন না। কিন্তু প্যারাসিটামলের সঙ্গে প্লাস বা অন্য একটি নাম যুক্ত করে আর তাতে ২৫ পয়সার সঙ্গে ৩ পয়সা খরচ বাড়িয়ে প্রায় আড়াই টাকায় বিক্রি করছে। সেখানে ভেজালও ঘটছে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকেও বলেছি, আপনারা কেন বিএনপির ভুল চালু রাখছেন? এটা সংশোধন করুন। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতিতে ফিরে যান। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সঠিকভাবেই চিকিৎসকদের এক বছরের জন্য গ্রামে রাখতে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিলেন। সেটা ছিল যথার্থ। অথচ দুই সপ্তাহের পর সেটা প্রত্যাহার করা হলো। এটা পুনর্বহাল করতে হবে। বুঝতে হবে, চাপটা কারা দেন। যাঁরা বলছেন, ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ সরকার নিলে গবেষণায় বিনিয়োগ কমবে, তাঁদের কথা সত্য নয়।

প্রথম আলো: এই মুহূর্তে আপনার চাওয়া কী?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: সরকার যাতে দ্রুত স্বাস্থ্যনীতি কার্যকর করে আর তার চলমান শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবেই ১৯৮২–এর ওষুধনীতিতে পুরোপুরি ফিরে যায়। আমি ব্যবসায়ীদের লাভের বিরুদ্ধে নই। আমি বলছি, ওষুধ উৎপাদনকারীদের পর্যাপ্ত লাভ দিতে হবে। তবে লাভ যেন লোভে পরিণত হয়ে পাপে পরিণত না হয়। ওষুধের দাম নির্ধারণ এখন দুর্নীতিতে পৌঁছে গেছে। শুধু দাম নয়, ল্যাব টেস্ট, অস্ত্রোপচার খরচ ইত্যাদি নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। বড় চিকিৎসকের বেতন ১০ লাখ টাকা ধরতে হবে।

সারা বিশ্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিলে জনগণের কল্যাণ হয় না। বণিক বার্তা লিখেছে, চিকিৎসা বাবদ দেশের বাইরে যাচ্ছে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। একটা উদাহরণ দিই। কিডনি প্রতিস্থাপনে বহু মানুষ ভারতে যায়। এটা রোধ করতে হলে বিদ্যমান আইনে দরকার একটি ছোট্ট সংশোধনী আনা। আইন বলছে, শুধু নিকটাত্মীয়রা কিডনি দিতে পারবেন। আইন সংশোধন করে বলতে হবে, যেকোনো সুস্থ ব্যক্তি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিতে পারবেন। সরকারি একটি তহবিল থেকে দাতারা পুরস্কৃত হবেন। এই সংশোধনী আনলেই বছরে অন্তত ১০ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপিত হবে। বিদেশেও রপ্তানি করতে পারবে। বাংলাদেশ একটি রোল মডেল হবে।