ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ কমাতে হলে

.
.

গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব হ্রাসসহ স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু সবার জন্য গুণগত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ্যসেবার খরচ (আউট-অব-পকেট-পেমেন্ট) হ্রাস, স্বাস্থ্য ব্যয়জনিত দারিদ্র্য হ্রাসসহ বাংলাদেশ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারসাধন জরুরি। আলোচনায় আমরা কেবল বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নে যে ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, তার একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরব।

আলোচনার শুরুতে স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন বলতে কী বোঝায়, তা একটু জেনে নেওয়া দরকার। স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নের তিনটি দিক রয়েছে। প্রথমত, ন্যায্যতা ও উৎকর্ষের ভিত্তিতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা। দ্বিতীয়ত, সংগ্রহ করা তহবিলকে এক করা। তৃতীয়ত, এই তহবিলের সুষ্ঠু বরাদ্দ ও সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসুবিধা প্রদান করা। এ ক্ষেত্রে কৌশলগত ক্রয় (স্ট্র্যাটেজিক পার্চেজিং) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উল্লেখ্য, স্বাস্থ্য খাতে কৌশলগত ক্রয় হলো এমন একটি ব্যয়, যেখানে সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান (যাকে পার্চেজার বলা হয়) দেশে বিদ্যমান সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর কাছ থেকে জনগণের জন্য ন্যায্যমূল্যে সঠিক পরিমাণ স্বাস্থ্যসেবা ক্রয় করে। এ ক্ষেত্রে পার্চেজার স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান এবং উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে সংগ্রহ করা অর্থের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসুবিধা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ব্যবস্থাকে সেবাদাতা ও সেবাগ্রহীতা (প্রোভাইডার-পার্চেজার) স্পিরিট বলা হয়।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে ৬৭ শতাংশ আসে ব্যক্তিগত উৎস থেকে, ২৩ শতাংশ সরকারের কাছ থেকে, ৭ শতাংশ উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে এবং অবশিষ্ট ৩ শতাংশ গোষ্ঠী স্বাস্থ্যবিমাসহ অন্যান্য উৎস থেকে। ব্যক্তিগত উৎস থেকে যে বিপুল অর্থ খরচ করা হয়, তা ন্যায্যতা ও উৎকর্ষের ভিত্তিতে সংগ্রহ এবং একীভূত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে মানুষ তার নিজের পকেট থেকে যে অর্থ খরচ করে, তার সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত করা যায় না। সরকার যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, তা জনগণের দেওয়া কর থেকে আসে। এই অর্থ একীভূত করা সহজ, কিন্তু এ অর্থের সুষ্ঠু বরাদ্দ ও সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একই সঙ্গে সেবাদাতা ও গ্রহীতার ভূমিকা পালন করে। ফলে সরকারি হাসপাতালগুলো নানা ধরনের অপচয়, স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মানের ঘাটতিসহ বহু সমস্যায় জর্জরিত। অন্যদিকে সরকারের যথাযথ নিয়ন্ত্রণের অভাবে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো স্বাস্থ্যসেবার জন্য উচ্চমূল্য নিয়ে থাকে। এরপরও এই বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৩ নম্বর লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে ব্যক্তির স্বাস্থ্যসেবার খরচ ২০৩০ সালের মধ্যে বর্তমান ৬৭ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামাতে হবে এবং ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, শহুরে-গ্রাম্যনির্বিশেষে সবাইকে প্রয়োজন অনুযায়ী সব ধরনের (অর্থাৎ প্রতিরোধ, প্রতিকার ও পুনর্বাসনমূলক) স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় কমাতে হলে হয় সরকারের বরাদ্দ বাড়াতে হবে, নতুবা অন্য কোনো বিকল্প খুঁজতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার হয় যে শতকরা হিসাবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারের ব্যয় গত কয়েক বছরে ২৬ শতাংশ থেকে কমে ২৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্যের জন্য ৪ দশমিক ৯১ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরের শতকরা হিসাবে বরাদ্দের তুলনায় কম। হিসাব করলে দেখা যাবে যে ব্যক্তির স্বাস্থ্যসেবার খরচ ২০৩০ সাল নাগাদ ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হলে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় ১৪ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে এই বিশাল আকারের বরাদ্দের সামর্থ্য সরকারের নেই। অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিমা একটা কার্যকরী বিকল্প ব্যবস্থা হলেও বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে অদূর ভবিষ্যতে সবার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন করা সম্ভব নয়। কারণ, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের ভিত্তি অনেক ছোট (প্রায় ১২ শতাংশ)। যেসব উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন আছে (যেমন ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, ঘানা, চিলি), সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের পরিধি বেশ বড়।

৪২ লাখ পোশাকশ্রমিকসহ অন্যান্য সেমি-ফরমাল খাতের শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা সম্ভব। ছবি: প্রথম আলো
৪২ লাখ পোশাকশ্রমিকসহ অন্যান্য সেমি-ফরমাল খাতের শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা সম্ভব। ছবি: প্রথম আলো

তা ছাড়া এসব দেশে ট্যাক্স-জিডিপি-অনুপাত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। তবে বিমাব্যবস্থা চালুর ধারণাকে একেবারে বাদ না দিয়ে যেসব ক্ষেত্রে বর্তমানে বিমাব্যবস্থা চালু করা সম্ভব, সেখানে এ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম প্রজাতন্ত্রের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক কন্ট্রিবিউটরি স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা যেতে পারে। এ ব্যবস্থা চালু হলে পর্যায়ক্রমে বেসরকারি খাতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ এক কোটির ওপরে জনগণকে অবিলম্বে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা সম্ভব।

তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত প্রায় ৪২ লাখ শ্রমিকসহ অন্যান্য সেমি-ফরমাল খাতে কর্মরত শ্রমিকদেরও পর্যায়ক্রমে বিমার আওতায় আনা সম্ভব। তা ছাড়া মোবাইল ফোনের কল রেটের ওপর সামান্য লেভি আরোপের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে ক্যানসার, কিডনিসহ ব্যয়বহুল রোগের প্রত্যেক রোগীর জন্য বছরে পাঁচ লাখ টাকা চিকিৎসা খরচ প্রদান করা সম্ভব।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, আমাদের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক কার্যকর করার ওপর বেশ জোর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমে গুরুত্ব দিতে হবে ক্রয় বা পার্চেজিংয়ের উৎকর্ষের ওপর। বর্তমানে আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে উপকরণভিত্তিক লাইন আইটেম বরাদ্দ ব্যবস্থা প্রচলিত (ইনপুট বেইজড লাইন আইটেম অ্যালোকেশন)। এ ব্যবস্থা মূলত অর্থ খরচের ওপর বেশি জোর দেয়, স্বাস্থ্যসেবা উৎপাদনের ওপর নয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রচলিত বরাদ্দ ব্যবস্থার সঙ্গে আউটপুটভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ চালু করতে হবে, যার একটা অংশ চিকিৎসকসহ হাসপাতালে কর্মরত জনবলের মধ্যে যৌক্তিক ভিত্তিতে বণ্টন করতে হবে এবং অপর অংশ হাসপাতালের সেবার মানোন্নয়নে খরচ করতে হবে। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ডায়াগনসিস গ্রুপ অনুযায়ী বিভিন্ন ক্ষেত্রে কতসংখ্যক রোগীকে গুণগত সেবা দেওয়া হয়েছে, তা আউটপুটভিত্তিক বরাদ্দের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

তা ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বাড়তি বরাদ্দের ওপর জোর দিতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতানুগতিক পদ্ধতিতে তৈরি বাজেট চাওয়ার কারণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দিতে পারে না। এ ক্ষেত্রে একদিকে যেমন টিকাদান কর্মসূচি, বিদ্যালয়ভিত্তিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম চালুকরণ, ধূমপান, তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিসহ বিভিন্ন প্রতিরোধ ও প্রচারমূলক স্বাস্থ্যসেবা জোরদারকরণের জন্য বাজেট চাওয়া প্রয়োজন; অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিদ্যমান শূন্য পদে নিয়োগ প্রদানের নিমিত্তে বাজেট চাওয়া জরুরি। তা ছাড়া বিভিন্ন জেলা হাসপাতালের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ প্রদানের জন্য বাজেট চাওয়া যুক্তিযুক্ত। ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অর্গানোগ্রাম পুনর্বিন্যাস করে সৃষ্ট পদে নিয়োগদানের ব্যবস্থার জন্যও বাড়তি অর্থ বরাদ্দ চাওয়া দরকার। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দু-তিনজন মেডিকেল অফিসারসহ অন্যান্য সহায়ক জনবলসংবলিত বৈকালিক বহির্বিভাগ স্বাস্থ্যসেবা চালুর জন্য বাজেট বরাদ্দ চাওয়া সময়ের দাবি। এর বাইরে বয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা (জেরিয়াটিক কেয়ার) ও পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্যসেবা চালু করার জন্য বাজেট চাওয়া যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে ক্যানসার, কিডনি হাসপাতাল নির্মাণসহ উপযুক্ত লোকবল নিয়োগের জন্য বাজেট চাওয়া প্রয়োজন। এ রকম আরও অনেক বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যৌক্তিকভাবে অর্থ বরাদ্দ চাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

উল্লিখিত সংস্কারগুলো সম্পন্ন করার নিমিত্তে একটি আইন প্রণয়ন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সম্প্রতি ফিলিপাইন সংস্কার প্রস্তাবসহ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এ ধরনের একটি আইন প্রণয়ন করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। 

ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ: (অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।)