গবেষণায় ঘাটতি মানেও পেছনে

.
.

একজন প্রকৌশলীর করা ডিজাইনে ভুল হলে তা সংশোধনের সুযোগ আছে, একজন বিচারপতির দেওয়া রায়ে ভুল হলে উচ্চতর আদালতে আপিলের মাধ্যমে তা শুধরে নেওয়ার সুযোগ থাকে, কিন্তু চিকিৎসা পেশায় ভুলের কারণে কারও মৃত্যু হলে তা শোধরানোর কোনো উপায় নেই। একটি মৃত্যু শুধু একটি পরিবারকে নয়, একটি প্রতিষ্ঠানকে পর্যন্ত বিপন্ন করতে পারে। মানুষের সেই মৃত্যু, সুস্থভাবে বেঁচে থাকা নিয়ে নিরন্তর যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা চিকিৎসক। তাই অন্য সব পেশার পড়াশোনার চেয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পড়াশোনাকে সব সময়ই আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে।

বাংলাদেশে গুটিকয় মানুষের সামর্থ্য আছে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার। তাই সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ মিলিয়ে প্রতিবছর ১০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী, যাঁরা চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন, তাঁদের হাতেই আমাদের অধিকাংশের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্ভর করছে। সেরাদের সেরা ছাত্রদের শুধু মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির বিষয়টি নিশ্চিত হলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। মেডিকেল কলেজগুলোর শিক্ষকদের বড় ভূমিকা থাকে তাঁদের সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে দায়িত্ববান এবং চৌকস চিকিৎসক হিসেবে তৈরি করতে।

বাংলাদেশের চিকিৎসাশিক্ষায় এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিক্ষকসংকট। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর তুলনায় জোড়াতালি দিয়ে চলতে থাকা বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অবস্থা বেশি নাজুক। মেধাবী চিকিৎসকেরা শিক্ষকতার চেয়ে রোগ সারানোর দায়িত্বে নিজেকে দেখতে বেশি পছন্দ করছেন। বিশেষ করে বেসিক বিষয়গুলোর পর্যাপ্ত এবং মেধাবী শিক্ষকের ঘাটতির কারণে ছাত্রছাত্রীদের ভিত্তিটি সঠিকভাবে তৈরি হচ্ছে না, যা প্রকারান্তরে ভালো চিকিৎসক হওয়ার অন্যতম অন্তরায়। পরিস্থিতি বিবেচনায় বেসিক বিষয়গুলোর শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা সময়ের দাবি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেরা ছাত্রদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের যে রীতি, তা মেডিকেল কলেজগুলোতে অনুপস্থিত। মেডিকেল কলেজের পেশাগত পরীক্ষাগুলোতে সেরা ফল করা মেধাবীদের মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতায়, বিশেষ করে বেসিক বিষয়গুলোর শিক্ষকতায় আগ্রহী করতে তাঁদের চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষা এবং ইন্টার্নশিপের পর সরাসরি বেসিক বিষয়গুলোর শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করার বিষয়টি বিবেচনায় আনা যেতে পারে।

চিকিৎসাশিক্ষায় অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে রোগী। পড়াসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের রোগী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে না থাকার ফলে ছাত্রছাত্রীদের যথাযথ শিক্ষায় বাধা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে হাতে–কলমে শিক্ষার জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক রোগীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি আলাদা করে নজর দেওয়া প্রয়োজন মেডিকেল কলেজ লাইব্রেরিগুলোর দিকে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য সর্বশেষ এডিশনের বইগুলো সহজলভ্য করার পাশাপাশি ডিজিটাল লাইব্রেরি আধুনিক জ্ঞানের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে আমাদের মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের।

সঠিক চিকিৎসাশিক্ষার আরেকটি বড় বাধা হচ্ছে ভাষা। মেডিকেলের সব টেক্সট বই ইংরেজিতে বলে পড়াশোনাও ইংরেজিতেই করতে হয়। ইংরেজিতে দুর্বলতার কারণে অনেক ছাত্রছাত্রীই সঠিক জ্ঞানটি আহরণে পিছিয়ে পড়েন। এ সমস্যা সমাধানে চিকিৎসা–শিক্ষা কারিকুলামে শুরু থেকেই ইংরেজি শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা যেতে পারে অথবা ভর্তি পরীক্ষায় যোগ্যতা নির্ধারণে ইংরেজি দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে। মূলত মানুষ নিয়েই চিকিৎসকদের কাজ বলে পাঠ্যসূচিতে কমিউনিকেশন বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানোর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্য রোগ সারানোর জন্য নয়, এসেছে মূলত রোগ প্রতিরোধ বিষয়ে সাফল্যের জন্য। কিন্তু এমবিবিএস কারিকুলামে কমিউনিটি মেডিসিন বিষয়টিকে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়, যা মেধাবী চিকিৎসককে ভবিষ্যতে এ বিষয়ে পেশাদার হতে নিরুৎসাহিত করে। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য বিষয়টিকে আরও জনপ্রিয় করে তোলা প্রয়োজন। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ গবেষক তৈরি করতে এমবিবিএস পর্যায়েই গবেষণা বিষয়ে মৌলিক শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা উচিত।

এমবিবিএস ডিগ্রি লাভের পর বিপুলসংখ্যক চিকিৎসক এখন বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আমাদের দেশে কোনো বিষয়ে বর্তমানে কিংবা ভবিষ্যতে কতজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজন, তার সঠিক তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই চলছে বিষয়গুলোতে সিটসংখ্যা নির্ধারণ। স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিষয়ে গবেষণাই আমাদের এ ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে।

আশার কথা হচ্ছে, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞানেও গবেষণার গুরুত্বকে বিবেচনায় নিয়ে এর ওপর জোর দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত হলেও প্রতিবছরই সরকারি খাতে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়ছে। গবেষণা খাতে বরাদ্দ অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের উচিত বাংলাদেশের জন্য কোন কোন গবেষণা বর্তমানে এবং নিকট ভবিষ্যতের জন্য জরুরি, সেই খাতগুলো চিহ্নিত করা এবং চিকিৎসা–গবেষণা খাতের সিংহভাগ অর্থ সেই সব গবেষণার জন্য বরাদ্দ রাখা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) চিকিৎসা–গবেষণার প্রাধিকার খাত নির্ধারণে একটি নির্দেশক হতে পারে।

ছাত্রছাত্রীদের জন্য সর্বশেষ এডিশনের বইগুলো সহজলভ্য করা জরুরি। ছবি: প্রথম আলো
ছাত্রছাত্রীদের জন্য সর্বশেষ এডিশনের বইগুলো সহজলভ্য করা জরুরি। ছবি: প্রথম আলো

আমাদের চিকিৎসকেরা যখন রোগীদের চিকিৎসা দেন, তখন তাঁদের বিবেচনা থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়ে যায়। সেটা হচ্ছে, আমাদের পরিবেশদূষণ। রোগের কার্যকারণ খোঁজার সময় বা রোগীকে পরামর্শ দেওয়ার সময় পরিবেশদূষণের বিষয়টি মাথায় রাখলে তাঁদের দেওয়া চিকিৎসা আরও কার্যকর হতে পারে। অবশ্য আমাদের এখানে পরিবেশ বিষয়ে গবেষণার স্বল্পতা প্রধানত এর জন্য দায়ী। উন্নত গবেষণার জন্য উন্নত মানের ল্যাবরেটরির বিকল্প নেই বলে বিশ্বমানের ল্যাবরেটরি স্থাপনেও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

অটোমেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা–সম্পর্কিত আমাদের সব তথ্য-উপাত্ত ডিজিটালাইজড করতে পারলে তা উন্নত চিকিৎসাসেবা এবং প্রয়োজনীয় গবেষণায় সহায়ক হবে। বাংলাদেশে বিশাল ওষুধের বাজার। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ, যারা ইউরোপ–আমেরিকার জনগণের চেয়ে আলাদা, তাদের ওপর এসব ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। সরকারের ঔষধ প্রশাসন এ বিষয়ে গবেষণাকে বাধ্যতামূলক করতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশে চিকিৎসা–গবেষণায় অবহেলিত মানসিক স্বাস্থ্য, হেলথ ইকোনমিকস, হেলথ পলিসি নিয়েও গবেষণা প্রয়োজন।

চিকিৎসা–গবেষণায় অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে চিকিৎসকদের গবেষণামুখী করা। এখনো চিকিৎসকেরা গবেষণা করেন মূলত তাঁদের পদোন্নতির উদ্দেশ্য সামনে রেখে, যা পর্যাপ্তসংখ্যক রিসার্চ আর্টিকেল ছাপার পরই থেমে যায়। চাকরিক্ষেত্রে পদোন্নতি ছাড়াও অন্যান্য প্রণোদনা বা স্বীকৃতির প্রয়োজন তাঁদের গবেষণায় উৎসাহিত করার জন্য।

চিকিৎসা–গবেষণা নিয়ে পিছিয়ে পড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে আমাদের গবেষকদের করা গবেষণার ফলাফল আমাদের স্বাস্থ্যনীতিতে প্রতিফলিত না হওয়া। এ ক্ষেত্রে দায় মূলত আমাদের গবেষকদের। তাঁরা আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁদের গবেষণার ফল প্রকাশ করেই দায় শোধ করেন, যার তথ্য আমাদের সাধারণ জনগণ বা নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছায় না বললেই চলে। আমাদের খ্যাতিমান গবেষকদের উচিত সংবাদমাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের গবেষণাপ্রাপ্ত জ্ঞান সাধারণ জনগণ ও নীতিনির্ধারকদের জানানো।

পুষ্টি, প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা ও স্বাস্থ্য—বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্যের তিনটি খাত। এসব খাতে অর্জন একের পর এক বিশ্ব স্বীকৃতির পাশাপাশি বাংলাদেশকে তৃতীয় বিশ্বের জন্য রোল মডেলে পরিণত করেছে। এই সাফল্যকে ধারাবাহিক করতে চিকিৎসাশিক্ষা এবং চিকিৎসা–গবেষণার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাবে এবং অব্যাহত থাকবে, এটাই আশাবাদ। 

ড. রোমেন রায়হান: (শিক্ষক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)