বইয়ের ঝোলা নিয়ে ঘরে ঘরে

রাউজানের কুণ্ডেশ্বরী গ্রামে এক বাড়িতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিচ্ছেন বেগম রোকেয়া পাঠাগারের সদস্যরা।  এস এম ইউসুফ উদ্দিন
রাউজানের কুণ্ডেশ্বরী গ্রামে এক বাড়িতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিচ্ছেন বেগম রোকেয়া পাঠাগারের সদস্যরা। এস এম ইউসুফ উদ্দিন

অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মিঠু দাশ। সপ্তাহের শুক্রবারের অপেক্ষায় থাকে সে। সাপ্তাহিক ছুটি। স্কুলে যাওয়ার তাড়া নেই। সকাল সকাল গল্প-কবিতার বই নিয়ে তার বাড়িতে হাজির হন ‘ভাইয়ারা’। কখনো একটি, কখনো দুটি বই—পড়ার জন্য দিয়ে যান। পাঠ্যবইয়ের বাইরে পুরো সপ্তাহে ভাইয়াদের দেওয়া ছোটদের গল্প ও ছড়ার বইয়ে ডুবে থাকে এই কিশোর। 

মিঠুর বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান পৌরসভার কুণ্ডেশ্বরী এলাকায়। পড়ে পৌরসভার গহিরার এ জে ওয়াই এম এস বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে। তার মতো আরও অনেক ছাত্রছাত্রী, পেশাজীবী, এমনকি গৃহিণীদের কাছে বই নিয়ে ছুটে যান কয়েকজন তরুণ। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে দিয়ে আসেন পছন্দের বই। ফেরত নেন আগের সপ্তাহে দেওয়া বই। এক-দুই বছর নয়, এভাবে ছয় বছর ধরে পৌরসভার বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায় বই বিতরণ করে যাচ্ছেন তাঁরা।

এই তরুণেরা বই পড়ার কর্মসূচিকে সাংগঠনিকভাবে পরিচালনার জন্য গড়ে তুলেছেন পাঠাগার। বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্মরণে এই পাঠাগারের নাম দিয়েছেন বেগম রোকেয়া পাঠাগার। এর সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বর্তমানে ব্যাংকার রিপন দেব।

শুধু বই বিতরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় পাঠাগারের কার্যক্রম। জাতীয় দিবসগুলোতে আলোচনা সভা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও কুইজ প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয়। নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় পাঠচক্র। এ ছাড়া বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জগৎমল্ল পাড়া বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে সভার আয়োজন করা হয়।

পাঠক থেকে সমন্বয়কারী
বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজপড়ুয়া কিছু শিক্ষার্থী ২০০৬ সালে রাউজান সদরের একটি কক্ষে চালু করেছিলেন এই পাঠাগার। মূল উদ্দেশ্য ছিল মানবিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন, বিজ্ঞানমনস্ক ও অসাম্প্রদায়িক পাঠক তৈরি। তবে জীবন বাস্তবতায় একসময় প্রতিষ্ঠাতাদের সবাই কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ চলে যান বিদেশে। প্রতিষ্ঠার ছয় বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ২০১২ সালের দিকে পাঠাগারের কার্যক্রম থমকে যায়। 

বইগুলো নষ্ট হতে থাকে। এই দৃশ্য অসহনীয় হয় উঠছিল এই পাঠাগারের পাঠক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রিপন দেবের কাছে। কার্যক্রম শুরু করার তাগিদ অনুভব করেন তিনি। আলোচনা করেন প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে। এরপর ২০১৩ সালে পুনর্যাত্রা হয়। সমন্বয়কের দায়িত্ব নেন একসময়কার পাঠক রিপন দেব। যিনি শিক্ষাজীবন শেষ করে এখন একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। 

দায়িত্ব নিয়ে বই বিতরণের কার্যক্রমে পরিবর্তন আনেন রিপন দেব। আগে বই নিতে পাঠকই পাঠাগারে আসতেন। 

এবার তাঁরাই পাঠকের কাছে যেতে থাকেন। এ জন্য একদল স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করেন। দলে দলে বিভক্ত হয়ে পাড়ায় পাড়ায় ছুটতে থাকেন তাঁরা। ধীরে ধীরে পাঠক বাড়তে থাকে। বাড়ে বইয়ের সংগ্রহও। নিজের পেশাগত ব্যস্ততার মধ্যেও পাঠাগারের কাজেও সমান তৎপর তিনি।

পাঁচ শ বই, দেড় শ পাঠক
২০১৩ সালে নব উদ্যমে যখন পাঠাগারের কার্যক্রম শুরু হয়, তখন বই ছিল মাত্র ১০০। এখন রয়েছে প্রায় ৫০০ বই। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটকসহ প্রায় সব ধরনের বই রয়েছে। বছরের বিভিন্ন সময়ে বই সংগ্রহের জন্য নানাজনের কাছে ছুটে যান পাঠাগারের সংগঠকেরা।  

পাঠাগারের সমন্বয়কারী রিপন দেব জানান, দায়িত্ব নেওয়ার সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই সময় সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করতেন। এলাকার মানুষের কাছেও গেছেন। অনেকেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের সংগ্রহে থাকা বই পাঠাগারে জমা দিয়েছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী নূতন চন্দ্র সিংহের নাতি বাসুদেব সিংহ ও তাঁর স্ত্রী সুবর্ণা চৌধুরী ১০০ বই উপহার দিয়েছেন। 

পাঠাগারের তালিকাভুক্ত পাঠক আছেন ১৫০। তাঁদের মধ্যে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আছেন। আছেন শিক্ষক, চাকরিজীবীরাও। পাঠক হয়েছেন গৃহিণীরাও। প্রতি মাসে তিন-চারবার এসব পাঠকের কাছে যান স্বেচ্ছাসেবকেরা। তাঁরা দলে দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন পাড়ায় যান। পাঠকদের কাউকে একটি, কাউকে দুটি বই দেন। আগ্রহ অনুযায়ী দেওয়া হয় বই। পরের সপ্তাহে ফেরত নিয়ে আসেন। তালিকায় থাকা ৫০ শতাংশ পাঠকই নিয়মিত। অন্যরাও কম-বেশি পড়েন। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেশি। 

পাঠাগারের কার্যক্রম এবং পাঠকের সাড়ায় সন্তুষ্ট সংগঠকেরা। তাঁরা বলছেন, এই কার্যক্রমের ফলে পাঠকের জানার জগৎ বিস্তৃত হচ্ছে। নিজের চারপাশ, সমাজ, জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে। বিশেষ করে স্কুলের শিক্ষার্থীরা উচ্চতর পড়াশোনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। 

পাঠাগারের নিয়মিত পাঠকদের একজন স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রেজাউল করিম। রাউজান পৌরসভার শরতের দোকান এলাকার এই বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালে তিনি পাঠাগারের সদস্য হয়েছিলেন। নিয়মিত বই নেন। পড়েন। এতে তিনি বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছেন। শুরুতে বই ছিল কম। এখন অবশ্য সে সংকট নেই।   

যেভাবে চলে পাঠাগারের কার্যক্রম
পাঠাগারের কার্যক্রমের পরিধি বেড়েছে। তাই কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য ১৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। যার দায়িত্বে আছেন স্কুলশিক্ষক ও বইপ্রেমী প্রিয়ম দে। 

কমিটির সদস্যরা প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে থাকেন। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে যান। মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। কেউ আগ্রহী হলে তাঁকে দিয়ে আসেন একটি বা দুটি বই। পরের সপ্তাহে তা ফেরত দিয়ে নতুন বই নিতে পারেন যে কেউ। এভাবে প্রত্যেক পাঠকের কাছে প্রতি মাসে তিন-চারবার যান। কমিটির সদস্যরা প্রতি দুই মাস অন্তর সভা করেন। পর্যালোচনা করেন কার্যক্রমের। 

পাঠাগারের বই বিতরণ কার্যক্রম দেখতে ১ নভেম্বর সঙ্গী হই রিপন দেবদের সঙ্গে। ওই দিন সকাল সাড়ে ১০টায় তাঁরা যান পৌরসভার দায়রাঘাটা এলাকার উত্তর বণিক পাড়ায়। এই পাড়ার কয়েকজন নিয়মিত পাঠক রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে মিল্টন ঘোষকে সেলিনা হোসেনের যাপিত যাপন বইটি দেন পাঠাগারের সদস্যরা। আগের সপ্তাহে দেওয়া আনিসুল হকের মা উপন্যাস শেষ করেছেন তিনি। এ ছাড়া পাশের ঘরের নীলয় ধর নেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের যে গল্পের শেষ নেই। বই বিতরণ শেষে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মেতে ওঠেন তাঁরা। পরের সপ্তাহের জন্য পছন্দের বইয়ের তালিকাও দেন। এরপর অন্য পাড়ায় চলে যান সদস্যরা।

আছে তিক্ত অভিজ্ঞতা, সীমাবদ্ধতাও
পাঠকদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেলেও অভিভাবকদের কাছ থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা পেয়েছেন কখনো কখনো। রিপন দেব বলেন, অনেক পাঠক মনে করেন পাঠ্যবইয়ের বাইরে এসব বই পড়ার প্রয়োজন নেই। এতে শুধু শুধু সময় নষ্ট। তবে এই ধরনের অভিভাবকের সংখ্যা খুব কম। অধিকাংশ অভিভাবকই তাঁদের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন। এমনকি অনেক পাঠক তো অনুযোগ করেন, তাঁরা একটু বেশি দেরিতে আসেন। অনেকে এমন কিছু বই খোঁজেন, যা অনেক সময় তাঁদের কাছে থাকে না। 

সীমাবদ্ধতা নিয়ে কিছুটা হতাশা কাজ করে তাঁদের মধ্যে। এখন অনেক পাঠক হয়ে গেছে। এসব পাঠকের বই বিতরণ কার্যক্রম সমন্বয় করা মাঝেমধ্যে কঠিন হয়ে পড়ে। আবার কার্যালয় না থাকায় বইগুলো সংরক্ষণ করা যায় না।   

তবে এসব তিক্ততা ও সীমাবদ্ধতাকে জয় করার দৃঢ় প্রত্যয়ী পাঠাগারের সমন্বয়ক রিপন দেব। তিনি বলেন, বই বিতরণ নিয়ে পলান সরকারের কাজ তাঁদের অনেক বেশি উজ্জীবিত করে। 

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রও সাহস জোগায়। এসবের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা আরও বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখছেন। 

আগামী দিনে তাঁদের স্বপ্ন, এলাকার সব শিক্ষার্থীকে পাঠাগারের সদস্য করবেন। তাদের হাতে তুলে দেবেন বই। বইয়ের ঘ্রাণে তারাও জীবন জয়ের স্বপ্ন দেখবে—এটাই এখন আশা। 

তরুণ প্রজন্মের এই কর্মসূচি খুবই প্রশংসনীয় বলে মন্তব্য করেছেন পৌরসভার সুলতানপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখন বই পড়ার চেয়ে ফেসবুকে বেশি সক্রিয়। ঠিক এই সময়ে একদল তরুণ মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে বই পৌঁছে দিচ্ছেন। তা অভাবনীয়। তাঁদের কারণে মানুষ বই পড়ছে। বইয়ের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ।