তেঁতুলিয়াপাড়ায় মধুর জীবন

পার্বত্য মৌচাষি কল্যাণ সমিতির অধীনে বান্দরবানের তেঁতুলিয়াপাড়ার বাসিন্দারা আধুনিক উপায়ে করেন মৌ চাষ।  প্রথম আলো
পার্বত্য মৌচাষি কল্যাণ সমিতির অধীনে বান্দরবানের তেঁতুলিয়াপাড়ার বাসিন্দারা আধুনিক উপায়ে করেন মৌ চাষ। প্রথম আলো

কয়েক বছর আগেও বান্দরবানের তেঁতুলিয়াপাড়ার পরিবারগুলোকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। তবে সেই অভাবের জীবন পাল্টে দিয়েছে মৌচাষ। এখন কমবেশি সবাই স্বাবলম্বী। পাড়ার পাহাড়ি-বাঙালি মিলে গঠন করেছেন পার্বত্য মৌচাষি কল্যাণ সমিতি। ওই সমিতির মাধ্যমে মধু বাজারজাত করেন তাঁরা। 

ছিমছাম ৫২ পরিবারের মারমাপাড়া তেঁতুলিয়াপাড়া। পাড়ায় ফলের বাগানে রয়েছে আম, কাঁঠাল, লিচুসহ হরেক রকমের গাছ। চাষের জমিতে ধান, সবজি ও অন্যান্য ফসলের চাষ হয়। ফসলি জমিসংলগ্ন প্রাকৃতিক বনাঞ্চল। সব মিলিয়ে এলাকায় সারা বছর কোনো না কোনো গাছে ও ফসলে ফুল ফোটে। মৌমাছিরা সেখান থেকে মধু সংগ্রহ করে। আবার মৌমাছির কারণে ফল ও ফসলের পরাগায়ণ ঘটে দ্রুত। এ জন্য ফলনও হয় বেশি। ­­­ 

একসময় জুমচাষ করে সারা বছরের খোরাকি জুটত না সাঙ্গু নদের তীরবর্তী এই গ্রামের বাসিন্দাদের। জুমের ফসলের পাশাপাশি করতেন টুকিটাকি সবজির চাষ। কিন্তু কয়েক বছর ধরে মিশ্র সবজির চাষ, ফলের বাগান এবং নার্সারির পাশাপাশি মৌচাষ করে আয় বাড়িয়েছেন তাঁরা। আর এ কাজটি সম্ভব হয়েছে সমিতি গঠন করে মৌচাষ শুরু করার কারণে। এখন সারা বছরের খোরাকি তো জুটছেই, বিদ্যালয়েও যাচ্ছে প্রতিটি পরিবারের শিশুরা। পাশাপাশি বছর শেষে থাকছে কিছু সঞ্চয়ও। সম্প্রতি তেঁতুলিয়াপাড়ায় গেলে সেখানকার কৃষকদের এই কর্মযজ্ঞ চোখে পড়ে। 

বান্দরবান শহরের কেচিংঘাটা থেকে সাঙ্গু নদে আধা ঘণ্টা গেলেই তেঁতুলিয়াপাড়া। হাঁটাপথের দুই পাশে বাসিন্দাদের বাড়ি। প্রায় প্রতিটি বাড়ির পাশে মৌচাষের বাক্স দেখা গেল। পাড়ার বাইরে পাহাড়জুড়ে করা হয়েছে ফলের বাগান। পাহাড়ের নিচে সমতল জায়গায় সবজি খেত। আর একদিকে বনাঞ্চল।

তেঁতুলিয়াপাড়ার মেইগ্য মারমার বাড়িটি আধা পাকা। আগে বাঁশের বেড়ার ঘরে থাকতেন পরিবার নিয়ে। খেতে পরিকল্পিত সবজি চাষ, ফলের বাগান ও মৌচাষ করে তাঁর জীবন বদলে গেছে। মৌচাষের মধু পরিবারের আয় বাড়িয়েছে। আর মৌমাছির কারণে সহজে পরাগায়ণ হওয়ায় সবজি ও ফলের ভালো ফলন হয়েছে। এতে পরিবারে আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। আধা পাকা বাড়ি তারই উজ্জ্বল উদাহরণ। শুধু মেইগ্য মারমা নন তেঁতুলিয়াপাড়ার ৫২ পরিবারেরই আয় বেড়েছে মৌচাষ ও সমন্বিত সবজি ও ফল চাষে। এক-তৃতীয়াংশ পরিবার বাঁশের ঘর থেকে আধা পাকা বাড়ি করেছে।

মেইগ্য মারমা বলেন, পাড়াবাসী মৌচাষ করে। মধু বিক্রি করে আয় বেশি হয় না। কিন্তু মৌমাছির আনাগোনায় সবজি বাগানে, নারকেল, আম, জাম, জাম্বুরাসহ ফল গাছে পরাগায়ণের ফলে আগের চেয়ে ফলন অনেক গুণ বেড়েছে।

পাড়ার কার্বারি (পাড়াপ্রধান) ক্যানুমং মারমা বলেন, মৌচাষ শুধু মধুর জন্য নয়, ফল ও সবজি বাগানের ভালো ফলনেও ভূমিকা রাখছে। মৌচাষের পর কৃষিপণ্যের ফলন বেড়ে গেছে। 

পাড়ার গৃহবধূ মেথুইপ্রু মারমা জানালেন, বনাঞ্চলে মৌমাছির দল খুঁজে পাওয়া গেলে প্রথমে রানি মৌমাছিকে বাক্সে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়। রানির সঙ্গে মৌমাছির দলও বাক্সে ঢুকে যায়। বাড়ির আঙিনায় বাক্স রেখে দিলে বনের মৌমাছি বন থেকে মধু সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। বাক্স থেকে কয়েক মাস পরপর মধু আহরণ করা যায়। কোনো পরিশ্রম করতে হয় না। মৌমাছিদের খাবারও দিতে হয় না। তবে বন থেকে রানি মৌমাছি খুঁজে আনতে হয়।

পরিশ্রম ছাড়া পরিবারে আয় বাড়াতে মধুচাষে পাড়ার নারীরাই বেশি আগ্রহী। তাঁরা বনাঞ্চলে মৌমাছির বাসা খোঁজেন। ক্রাউপ্রু মারমা বলেছেন, তিনি মাটির গর্তে মৌমাছি খুঁজে পেয়ে সেটি সংগ্রহ করে মৌ বাক্সে রেখেছেন। পাড়ার সবাই এভাবে বনের মৌমাছি ধরে এনে পোষ মানিয়ে মধু চাষ করছেন। 

পার্বত্য মৌচাষি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ বলেন, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মধু আহরণ মৌসুম। মৌসুমে তাঁরা তেঁতুলিয়াপাড়া ও আশপাশে পাড়া থেকে প্রতি মাসে ৭০-৭৫ কেজি মধু আহরণ করে বাজারজাত করেন। প্রতি কেজি মধু বিক্রি হয় ১ হাজার টাকায়।

তেঁতুলিয়াপাড়ার কার্বারি ক্যানুমং মারমা বলেছেন, তাঁরা প্রথমে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে মৌচাষ সম্পর্কে জেনেছেন। প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। বনের মৌমাছি দিয়ে মৌচাষে পরিশ্রম নেই। মৌ বাক্স তৈরি, মধু আহরণ যন্ত্র, মুখোশ জাল ও ছুরি কিনতে কিছু পুঁজির প্রয়োজন। 

বান্দরবান সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক বলেছেন, পার্বত্য অঞ্চলের উৎপাদিত মধু সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। প্রাকৃতিক এই মৌচাষে সহায়তা করছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। মৌচাষ সম্প্রসারণ করতে রানি মৌমাছি উৎপাদনের জন্য গবেষণারও উদ্যোগ নিয়েছেন সেখানকার গবেষকেরা। 

 পার্বত্য মৌচাষি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ জানিয়েছেন, পার্বত্য অঞ্চলে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে মৌচাষ করা হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিদেশি ম্যালিফেরা প্রজাতির মৌমাছি উৎপাদন করে মৌচাষ হয়ে থাকে। ওই মৌমাছিকে খাবার দিয়ে পালন করা ব্যয়বহুল। পার্বত্য অঞ্চলে মৌচাষ করা হয় এপিস সেরেনা মৌমাছি দিয়ে। এই জাতের মৌমাছিকে বাড়তি খাবার দিতে হয় না।

আলী আহমদ আরও বলেন, তাঁদের সমিতির উদ্যোগে রুমা, লামা, রোয়াংছড়ি, আলীকদমসহ বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক দরিদ্র পরিবারকে মৌচাষে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। 

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এপিস সেরেনা ও এপিস ডরসাটা দুই প্রজাতির মৌমাছি পাওয়া যায়। ডরসাটা জাতের মৌমাছি পালনে খরচ বেশি। অপর দিকে এপিস সেরেনা মৌমাছি দ্রুত পোষ মানে। এ প্রজাতির মৌচাষে বাড়তি কোনো খরচ ও পরিচর্যার প্রয়োজন নেই। এপিস সেরেনা জাতের রানি মৌমাছি উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। এটি সম্ভব হলে পার্বত্য এলাকায় মৌচাষ আরও সহজ হবে।