অসহায় রোগীর পাশে সব সময়

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী কল্যাণ সমিতির পক্ষে অসহায় এক রোগীর হাতে ওষুধ তুলে দিচ্ছেন সমাজসেবা কর্মকর্তা তানজিনা আরেফিন।  জুয়েল শীল
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী কল্যাণ সমিতির পক্ষে অসহায় এক রোগীর হাতে ওষুধ তুলে দিচ্ছেন সমাজসেবা কর্মকর্তা তানজিনা আরেফিন। জুয়েল শীল

কক্সবাজারের মাহবুবুল আলম টমটম চালাতেন। ২০১৬ সালে রমজান মাসে এক দুর্ঘটনায় দুমড়েমুচড়ে যায় টমটমটি। গুরুতর আহত হন মাহবুব। মেরুদণ্ডে আঘাতের কারণে চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েন। তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। রোগী কল্যাণ সমিতির সহযোগিতায় দীর্ঘ চিকিৎসা হয় তাঁর। পরে ঢাকায় পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে আরও এক দফা চিকিৎসা নেন তিনি। সুস্থ হলেও এখন হুইলচেয়ারেই চলাচল করতে হয় তাঁকে। শারীরিক সামর্থ্য নেই, আয়–উপার্জনের কী হবে ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন মাহবুবুল আলম। কিন্তু চিকিৎসার সময় যেমন পাশে দাঁড়িয়েছিল রোগী কল্যাণ সমিতি, তেমনি পুনর্বাসনেও এগিয়ে এল এই সমিতি। তাদের আর্থিক সহযোগিতায় নিজের গ্রামের বাড়িতে একটি দোকান চালান মাহবুবুল। 

এভাবে চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি দুস্থ মানুষের পুনর্বাসনেও কাজ করে যাচ্ছে এই সংগঠন। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত রোগী কল্যাণ সমিতি এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ২০ হাজার দুস্থ রোগীকে সাহায্য করেছে। এর মধ্যে ২ লাখ ২২ হাজার ২০৩ জন রোগীকে ওষুধ টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছে। বাকি এক লাখের বেশি রোগীকে দেওয়া হয় কাউন্সেলিং। অভিভাবকহীন সাতটি শিশুকে পুনর্বাসনও করেছে তারা।

কিছু কান্না–হাসি

ক্যালেন্ডারের পেছনের দিকে তাকালে এ রকম অনেক চিত্র চোখে ভেসে উঠবে। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরোসার্জারি বিভাগে অসুস্থ এক শিশুকে ফেলে রেখে চলে যান অভিভাবকেরা। এরপর পাশের শয্যায় অপর এক রোগীর স্বজন রুমা আকতার শিশুটিকে বুকে আগলে নেন। রুমা পড়ে যান মেলিনগোমাইলেসিস আক্রান্ত এই শিশুর মায়ায়। ফলে রুমার স্বজনেরা বাড়ি ফিরলেও তিনি রয়ে যান হাসপাতালে। শিশুটির নাম রাখা হয় আরাফাত। দীর্ঘ চিকিৎসার সময় রুমাই ছিল আরাফাতের মূল অভিভাবক। রোগী কল্যাণ সমিতি এবং চিকিৎসকদের আন্তরিকতায় আরাফাতের চিকিৎসা চলে। আরাফাতের কিছু দরকার হলেই রুমা ছুটে যেতেন রোগী কল্যাণ সমিতিতে। এ ছাড়া চমেক হাসপাতালে অজ্ঞাত রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সাইফুল ইসলামের সাহায্যও নিতেন রুমা। একাধিকবার অস্ত্রোপচারের পর একপর্যায়ে আরাফাত মোটামুটি সুস্থ হয়। এরপর আরাফাতকে পুনর্বাসনের জন্য রৌফাবাদের ছোটমণি নিবাসে পাঠানোর ব্যবস্থা করে রোগী কল্যাণ সমিতি। কিন্তু তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ান রুমা। রুমা কোনোভাবেই আরাফাতকে ছাড়তে রাজি নন। পরে সমিতির তৎপরতায় রুমাকেও ছোটমণি নিবাসে একটি অস্থায়ী কাজ জুটিয়ে দেওয়া হয়। এখন আরাফাত ও রুমা ওখানেই রয়েছে।

চন্দনাইশের মোহাম্মদ শফি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিজের চিকিৎসা ও ওষুধ পত্রের খরচ মেটাতে ধারদেনায় জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। তাঁকে ওষুধ এবং পথ্য দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন সংস্থার ঋণের কারণে তিনি বিপর্যস্ত ছিলেন। এরপর রোগী কল্যাণ সমিতির তৎপরতায় ওই ঋণ পরিশোধ করা হয়। 

ফেনীর রেহেনা বেগম দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রীরোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। তাঁর চিকিৎসায় সাহায্যের হাত বাড়ায় রোগী কল্যাণ সমিতি। এখন অনেকটা সুস্থ রেহেনা। এখনো তাঁকে সমিতির কাছ থেকে ওষুধপথ্য নিতে হয়। রেহেনা জানান, রোগী কল্যাণ সমিতি না থাকলে তাঁর চিকিৎসা সম্ভব হতো না। 

>চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত রোগী কল্যাণ সমিতি এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ২০ হাজার দুস্থ রোগীকে সাহায্য করেছে।

২০১৮ সালে ২০ হাজার ২২২ জন রোগীকে সমিতি সাহায্য দিয়েছে। সমিতির সদস্যসচিব ও চমেক সমাজসেবা কর্মকর্তা অভিজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, গত জুন পর্যন্ত এক বছরে ১ কোটি ৩৯ লাখ ১৪ হাজার টাকা সাহায্য করা হয়। ওষুধপথ্য এবং টাকা দিয়ে সহযোগিতার পাশাপাশি রোগীকে কাউন্সেলিং করা হয়। সাহায্যপ্রাপ্ত মোট রোগীর সংখ্যা তিন লাখের বেশি হবে।

হাসপাতালে সরঞ্জাম দান

তিন বছর ধরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে রোগী কল্যাণ সমিতি। সম্প্রতি প্রসূতি বিভাগে সরবরাহ দিয়েছে জরায়ু ক্যানসার নিরূপণের মেশিন। এ ছাড়া দুটি লেবার টেবিল এবং দুটি হুইলচেয়ার কিনে দিয়েছে রোগী কল্যাণ সমিতি। 

 অভিজিৎ সাহা বলেন, গত বছর ৫০ জন প্রসূতিকে ২ হাজার টাকা করে ১ লাখ টাকা সাহায্য দেওয়া হয়। এ ছাড়া অন্যান্য ওয়ার্ডেও রোগীদের পাশাপাশি কিছু যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় সহযোগিতা করা হয়। 

জানা গেছে, রেডিওথেরাপি বিভাগে একজন টেকনিশিয়ানকে এক বছর ধরে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে বেতন দিচ্ছে সমিতি। ওই ওয়ার্ডে কোনো টেকনিশিয়ান ছিলেন না। এখন টেকনিশিয়ান থাকায় ক্যানসার রোগীদের থেরাপি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া বার্ন ইউনিটের বারান্দা থাই গ্লাস দিয়ে ঘেরা দেওয়া হয়েছে সমিতির অর্থায়নে। 

এর ফলে বারান্দায় থাকা রোগীরা রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাচ্ছে। সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া হৃদ্‌রোগ বিভাগের ১৫টি করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) শয্যা দিয়েছে রোগী কল্যাণ সমিতি। তাহের ব্রাদার্সের সহযোগিতায় এই শয্যা দেওয়া হয়।