মুক্তিযুদ্ধে লেখা উর্দু কবিতা

বাংলাদেশে বসবাসকারী যে কজন প্রখ্যাত উর্দু কবি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন, নওশাদ নুরী ও আহমদ ইলিয়াস তাঁদের অন্যতম। নওশাদ নুরীর (১৯২৬-২০০০) জন্ম বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলায়। ছিলেন প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের বিহার শাখার সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫১ সালে জওহরলাল নেহরুর জোট নিরপেক্ষতা ছেড়ে মার্কিন সাহায্য নেওয়ার সিদ্ধান্তকে শ্লেষ করে কবিতা লিখে হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে আসেন ঢাকায়। সেই থেকে আমৃত্যু ঢাকাবাসী। এখানে মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কমরেড আবদুল হকের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির পরপরই বাংলা ভাষার পক্ষে ‘মহেঞ্জোদারো’ কবিতা লিখে পাকিস্তান সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে আবার কলকাতায় নির্বাসনে যান। ফিরে এসে ছয় দফার উর্দু অনুবাদ করে প্রচার করেন। বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের পর লেখেন ‘টুঙ্গিপাড়া’ শিরোনামে কবিতা । এখানে অনূদিত কবিতা দুটো তিনি লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুরতায় বেদনাহত হয়ে।
আহমদ ইলিয়াস জন্মগ্রহণ করেন কলকাতায়, ১৯৩৪ সালে। পড়ালেখা ঢাকা ও কলকাতায়। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে ঢাকায় আসেন। সেই থেকে এই ভূমির বাসিন্দা তিনি। প্রগতিশীল লেখক আন্দোলন আর রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। পেশায় সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী। ঢাকা প্রেসক্লাবের ম্যানেজার ছিলেন। এখন পর্যন্ত ছয়টি উর্দু কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, সব কটিই ঢাকা থেকে। ভারতের কর্ণাটক উর্দু একাডেমি তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে। কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে মিলে তিনি বাংলা-উর্দু সাহিত্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। পত্রস্থ কবিতাটি ইলিয়াস লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা সময়ে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের এই দুই উর্দু কবির তিনটি কবিতায় ধরা আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন উত্তাল সময়ের উত্তাপ।

নওশাদ নুরীর কবিতা

রক্তে ভেজা দিন
এই যে অন্ধকার ঝুলে আছে সন্ধ্যে হওয়ার আগে
কোন সে মজলুমের আলুথালু চুলের মতো
তোপের অন্ধকার ধোঁয়ায় দিগন্তে উঠছে চাঁদ
সুর্মারঙা ছাইমাখা কোনো সাধুর মতো
কেন আজানের ছন্দ এমন হঠাৎ গেল ভেঙে
মসজিদে হালাকু খানের মতো কে পড়ল ঝাঁপিয়ে
চুপচাপ দিগন্ত থেকে নেমে এল রোদ
নিষ্পাপ চোখের কোণ বেয়ে ঝরা অশ্রুর মতো
পাছে কারও চোখে পড়ে মানুষ লুকিয়ে ফেরে
শ্বাপদের ভয়ে পালানো অসহায় হরিণের মতো

এই যে চারদিকে ছোটে রক্তের ফোয়ারা
এই যে স্তব্ধ সব জিভ, এই যে মৃত্যুর নীরবতা
কাগমারি, সন্তোষ অথবা টুঙ্গিপাড়া
এই যে উজাড় নীরবতা কথা বলে ফিসফিস করে

আমার ভাবনা আঁতিপাঁতি করে খুঁজে ফেরে
আমার ভাবনা চারদিকে দেখে শুধু বুটের নিশান
দোহাজারী, সিলেট বা ঝালকাঠি
গোলার ক্ষতচিহ্ন দেখি শুধু দেয়ালের গায়ে
আঙিনায় পড়ে আছে দেখি রামের বোতল
ফৌজির বেলেল্লা চুমোচাটি ঘরের ভেতর
জানালায় দেখি আমি বেয়নেটের নিশানা
রক্তের স্রোতে ভেসে যায় শীতলপাটি
তীক্ষ্ণ ক্ষতের মতো ঢাকায় এখন করাচির কথা
কাগান থেকে রাঙামাটি এখন অনেক দূর

এ প্রেমের ভাঙন ছাড়া পথ নেই আর
যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো পথ নেই বাকি
আর কিছু নেই দেওয়ার শুধু ঘৃণা ছাড়া

(‘লোহু মেঁ শারাবোর দিন’, কবিতার অনুবাদ; পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ ১৯৭১–এ রচিত)

সশস্ত্র সৈনিকেরা
(পাকিস্তানি ফৌজি নীতি)
হাতিয়ার হাতে হে সৈনিকেরা
কল্পনাই তো সেই সীমান্ত
তোমাদের যত দাবানো রায়ত
শুনি নেমে গেছে লড়াই করতে

বাঙালি–শরীর কোমল পেলব
বাঙালির লোহু আলোকমাল্য
রক্তধারাই আঁকছে এখন
দেখায় বাংলা নয়া সীমানার

এত যে সবুজ ধীরে ধীরে আজ
রক্তের লালে হচ্ছে ঘেরাও
অন্ধ তোমরা চোখেও পড়ে না
যত আছে ভিত নিচ্ছে ভাসিয়ে

অস্ত্রহীনের রক্তফোয়ারা
দিনে দিনে হয় অঙ্গার–হ্রদ
অন্ধ তোমরা চোখেও পড়ে না
লাশেরা এখন তুলছে দেয়াল

অন্ধ তোমরা চোখেও পড়ে না
যুদ্ধকুশল দক্ষ সবার
পালাবার কোনো পথ নেই আর
হাতিয়ার হাতে হে সৈনিকেরা

(‘মাসসালাহ ফৌজ’ কবিতার অনুবাদ)

আহমদ ইলিয়াসের কবিতা

কালবৈশাখী
আমি দেখছি
কালো ঝড়ের পেছনে কালো চেহারা, কালো লশকর
কালো বল্লম, কালো বর্শা
কাতারে কাতারে হাতে তুলে কালো পতাকা
আসছে আমাদের গ্রামে
আমি শুনি কালো ঘোড়াদের খুরের আওয়াজ
কানে বাজে কালো বুটের ধ্বনি

আমি দেখছি
গ্রামে আমাদের প্রলয় বয়ে যায়
উপড়ে পড়ে গাছ, ধসে যায় দরজা
কালো ঝড় হাতে নিয়ে কালো পতাকা
বসিয়ে দিচ্ছে মাটির বুকে
সেই বুক ঘোড়ার পায়ে হচ্ছে ক্ষত

আমি দেখছি
ঘর দরজা দেয়ালের চিহ্নমাত্র নেই
জমির বুক আঘাতে রক্তিম
কোথাও বর্শা কোথাও বল্লম
কোথাও বিঁধেছে তার তির

আমি দেখছি ঘরের তরুণ সব মুখ
কালো ঝড়ের সঙ্গে লড়তে লড়তে
ভোরের আগে চুপচাপ পড়েছে শুয়ে
পলকে পলকে অশ্রু হয়ে

আমি জানি, তবু আমি জানি
কালো ঝড়, এই কালো লস্কর
দুইয়েরই নিয়তি পরাজয়
আমি জানি, আমি জানি
প্রদীপ নিভেছে যে ঘরে
সূর্য সেখানে উঠবেই

(‘কাল ব্যায়সাখি’ কবিতার অনুবাদ)

ভূমিকা ও অনুবাদ: জাভেদ হুসেন