'আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে...'

বিশ্বের সর্বাধিক আলোচিত নাম যিশুখ্রিষ্ট। সন্দেহ নেই, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্প-সাহিত্য, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র তাঁকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে। খ্রিষ্টের অগণিত সাধু-ভক্ত, মহামনীষী, নাস্তিক-আস্তিক, কে না লিখেছেন— ঐশী সন্তানরূপে কুমারী জননীর কোলে জন্মগ্রহণ করে যাতনা ভোগ করে ক্রুশবিদ্ধ জীবনদান ও পরিকল্পিত পুনরুত্থান পর্যন্ত! খ্রিষ্টের সমগ্র জীবনটাই তো অলৌকিক সমারোহে পূর্ণ। ফলে বিশ্বের বহু জ্ঞানী–গুণী, মহাকবিরাই শুধু লেখেননি, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ত্রৈদিকপাল—রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দের লেখায়ও খ্রিষ্টের প্রসঙ্গ এসেছে। 

আধ্যাত্মিক আরাধনায় রবীন্দ্রনাথের লেখার পাল্লাটাই একটু বেশি ভারী। তিনি লিখলেন, ‘দিক হতে দিগন্তরে মহামানবের স্তবগান’...আরও লিখলেন, ‘ওই মহামানব আসে।/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/ মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে।/ সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ, নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক—/ এল মহাজন্মের লগ্ন।’ 

কবিগুরু এভাবেই খ্রিষ্টকে মহামানবরূপে উপলব্ধি করেছেন অন্তরাত্মায়। স্বাগত জানিয়েছেন মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে আধ্যাত্মিক পরাবাস্তবতায় খ্রিষ্টকে উপলব্ধি করলেন, ঠিক তার বিপরীত অবস্থানে গিয়ে কবি নজরুল তাঁর বিদ্রোহী স্বভাবের উচ্চ স্বরে উচ্চারণ করলেন, ‘বড়লোকদের “বড়দিন” গেল, আমাদের দিন ছোটো,/ আমাদের রাত কাটিতে চায় না, খিদে বলে নিবে ওঠো।/ পচে মরে হায় মানুষ, হায়রে পঁচিশে ডিসেম্বর।/ কত সম্মান দিতেছে প্রেমিত খ্রীষ্টে ধরার নর।/ ধরেছিলে কোলে ভীরু মানুষের প্রতীক কি মেষ শিশু?/ আজ মানুষের দুর্গতি দেখে কোথায় কাঁদিছে যীশু!’

পঁচিশে ডিসেম্বর খ্রিষ্টভক্তদের বড় উৎসব বড়দিন। রবীন্দ্রনাথের পূজিত ভাষায় সেদিন তো ‘ওই মহামানব আসে’ আর নজরুলের উচ্চারণে ফুটে ওঠে সেই উৎসবের দিনে মানুষের দুর্গতির কথা এবং কোথায় কাঁদিছে যিশু? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে কি? আমাদের একবার উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেতে হবে? যেখানে চরম সহিংসতায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে লাখ লাখ মানুষ। যাদের বাংলাদেশ মানবিক আশ্রয় দিয়েছে, কিন্তু ক্যাম্পগুলোতে গর্ভবতী নারী ও শিশুর দুর্গতি অনেক। গরম, ঠান্ডা আর বৃষ্টির মধ্যে প্রতিনিয়ত জ্বর, ডায়রিয়া আক্রান্ত অগণিত শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। ফলে সেই সব শিশুর দুর্গতির মধ্যেই কি নজরুলের কবিতার কল্পিত খ্রিষ্টের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠেনি? 

যদিও কবি এ-ও লিখেছেন, ‘তব কলভাষে খল খল হাসে বোবা ধরণীর শিশু,/ ওগো পবিত্রা, কূলে কূলে তব কোলে দোলে নব যীশু।’...হয়তো জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এমন আধ্যাত্মিকতার ভায়োলিন নেই, নজরুলের বিদ্রোহী ভাষার মতো অন্যানুভূতিও নেই। তবু জীবনানন্দ খ্রিষ্টকে পরিত্রাণ ভেবে বললেন, ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবু মানব/ থেকে যায়;’...কিংবা গসপেলের মথি-সুসমাচারে যা লেখা ছিল— ‘কারণ তিনিই সেই মহান পুরুষ, যিনি তাঁর জাতিকে তাদের পাপ থেকে পরিত্রাণ করবেন।’ 

হয়তো জীবনানন্দ এই বাণীকে ধারণ করেই তাঁর অরেক কাব্যভাবনায় বললেন, ‘...একদিন সৃষ্টির পরিধি ঘিরে কেমন আশ্চর্য এক আভা/ দেখা গিয়েছিল: মাদালীন দেখেছিলো আরো কেউ কেউ;/ অম্বাপালী সুজাতা ও সঙ্ঘমিত্রা পৃথিবীর অলৌকিক সূর্যের/ আড়ালে আর এক আলো দেখেছিলো;’ কবির উল্লিখিত ‘অলৌকিক সূর্যের’ আলোই কি তাহলে সব মানুষের জন্য সত্য, শান্তির নিরপেক্ষ সুসমাচার? 

হেনরী স্বপন: কবি ও লেখক