বিলেতে বড়দিনের গান

অক্টোবরের শেষ দিকে হ্যালোইনের ভূত কেটে পড়ার পর থেকেই বিলিতি বাজার সরগরম করে রাখে ক্রিসমাসের আগমনী, সুপারশপে চলে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে হিমায়িত পশুপাখি, রাতের শহর প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে লাল-নীল দীপাবলিতে, শীতের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে তাদের দেখতে হয় আরক্ত চোখের মতো। অনেককাল আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম একটি দরিদ্র লোকের গল্প, এমনি কোনো শপে টুপির তলায় তেমনি একটি হিমায়িত পাখি লুকিয়ে সে পালাচ্ছিল, মাথায় অত হিম পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। গৃহহীনদের ভিড় লন্ডনে এখন খুবই পরিচিত দৃশ্য।

গৃহহীনদের কথা প্রথম শুনেছিলাম ইশকুলে, সাদা সন্ন্যাসিনীদের মুখে, ওসাকার মতো শহরে কার্ডবোর্ডে মাথা গুঁজে শীতে কাঁপে সেই গৃহহীনেরা, সেই গল্প শুনে শিউরে উঠেছিলাম আমরা, আমাদের ধারণা ছিল কেবল আমাদের মতো গরিব দেশেই এমন অনিকেত মানুষের ঝাঁক চোখে পড়ে। 

স্যালভেশন আর্মির লোকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তাদের দিকে, সেবা সংস্থাগুলো স্যুপ কিচেন খোলে তাদের জন্য। খোলা আকাশের নিচে শহরের চত্বরে জমে ওঠে ক্রিসমাসের বাজার, প্রগাঢ় শীত যাদের শীতনিদ্রার কোটরে টেনে নিতে পারেনি সেই সব প্রাণীর মতোই আমরা মায়েপোয়ে সেই সব আলো-জ্বলা বাজারে ঘোরাঘুরি করি, এই মৌসুমের উদ্ভিজ্জ সম্রাজ্ঞীরা বাজারে এসেছে—যেমন কমলা-দারুচিনি-ক্র্যানবেরি, বাজারের এককোণে সোনালি ট্রমবোন বাজিয়ে কে সুর তুলছে—‘গড রেস্টইয়ে মেরি জেন্টেলমেন’। 

এখানে শীতকালে সূর্য ওঠে না সহসা, আকাশ ব্লটিং পেপারের মতো ভেজা আর পর্ণমোচী গাছের নিষ্পত্র শাখায় চেরা। তবু কখনো মেঘ চিরে দেখা দেয় নির্মল নীল, আছড়ে পড়ে সামান্য রোদ। ভিড়ের বাসে দুজন মানুষের সঙ্গে দুটো ক্রিসমাস ট্রি উঠেছে গুঁড়িসহ। তাদের মাথা সব্বাইকে ছাড়িয়ে, নাইলনের প্যাকেটের স্ট্রেইটজ্যাকেটে ঠাসা শাখাগুলো আর তাতে সবুজ পাতার ছুঁচ। তা সেই ছুঁচকুমারদের গায়ের তীব্র ভেষজ ঘ্রাণে বাসে জমে থাকা ঘামের গন্ধ ডুবে গেল। কী যেন ছিল গাছগুলোর গায়ে, একরকম প্রতিবাদের মতো ঝাঁজালো। আমরা বাসের জানালায় মাথা হেলিয়ে মিহিদানা রোদে আর সবুজ গন্ধে ভেসে যেতে যেতে টের পেলাম, উন্মূলও বড় বেশি চ্যাঁচামেচি করে, শেষ পর্যন্ত। ভাবতে ভাবতে চমকে উঠলাম।

আমার বাস যাবে আমার বন্ধুদের বাড়ি, এরা কাছাকাছি কয়েকটি বাড়ির বাঙালি খ্রিষ্টান। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই ঘরে ঘরে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে, জরির মালায় সেজে উঠেছে সিঁড়ি আর জানালা, দেয়ালের যিশু ধুলিহীন, কাচের রঙিন বাতিতে সেজেছে ক্রিসমাস ট্রি। আমার বাঙালি মুসলমান বন্ধুদের অনেকেই ক্রিসমাস যাপন করে হালাল টার্কি কিংবা রাজহাঁস দিয়ে, রোস্ট ডিনার। বাঙালি খ্রিষ্টানের বাড়িতে রান্না হয় ভাত-ডাল-তরকারি-পোলাও-মাছ-মাংসের ভালো পদ আর পিঠাপুলি। 

একদিকে সংস্কৃতির সংক্রমণ, আরেকদিকে ভক্তিভরে উদ্‌যাপন, দুইই সুন্দর। এদের কারও সঙ্গে আমি ইশকুলে পড়েছি, বড়দিনের ছুটিতে চ্যাপেলের ক্রিসমাস ট্রি সেজে উঠতে দেখেছি, চিরকুমারী সন্ন্যাসিনীদের পরিবেশিত কুকি আর পিঠা খেয়েছি। বিলেতে এসে পরিচয় হয়েছে এমন মানুষও আছে, স্মৃতি বুকে করে চলে এসেছিল, এরপর একদিন ফিরে গিয়ে দেখেছে, গ্রাম-শহর-জঙ্গল-আকাশ-মানুষ সব বদলে গেছে। 

আমার বন্ধুর একটা নাম দেব কি এখানে? তার নাম হোক রোজমেরী গোমেজ। বাড়ি হোক গোবিন্দপুরে, হাসনাবাদ চার্চের সামনে যখন শুধুই ধুধু ফুটবলের মাঠ ছিল তখন সে বেণিদোলানো কিশোরী। রাজধানী থেকে ফিরে এসেছিল সে এই গ্রামে, আবার। যেমন ফিরে এসেছিল তার বাবা, উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়। তারপর একদিন সে নিজেও পাড়ি জমিয়েছে মাটির চুলোর ধার ছেড়ে। শিশুকে গর্ভে নিয়ে মা-বাবা কত গোয়ালেই না আশ্রয় খোঁজে, আজও। গোবিন্দপুরের রোজমেরীকে বিলেত আনা যায় সত্য, তুলে ফেলা যায় না রোজমেরীর বুক থেকে গোবিন্দপুরকে, সেই ধুলিরঙা মাঠ, মাঠের কিনারে শান্ত বিষণ্ন গির্জা, খ্রীষ্টজাগ, ঘরে ঘরে গিয়ে সেই যে যিশুর নামসংকীর্তন। 

এখানেও দিব্যি কীর্তন হয়, রোজমেরীরা সহর্ষে যোগ দেয়, আয়োজন করে। ঢোল-বাঁশি-খঞ্জনি-করতাল নিয়ে বের হয়ে পড়ে পরিচিত ঘরে ঘরে। ঠিক আগেকার মতো। মহোল্লাসে হেসে হেসে গলা ছেড়ে ক্যারল গায়—‘ওড়াও জয়পতাকা’, কিংবা ‘ধরো লও রে ঈশ্বরের প্রেম যিশু ডাকে আয়’। শুধু পরনে রঙিন ক্রিসমাস জাম্পার, মাথায় সান্তা ক্লজের লাল-সাদা টুপি, এইটুকু আগেকার মতো নয় হয়তো। 

জীবিত মা-বাবাকে হাজার মাইল দূরে রেখে এসে উৎসব করা বড় কঠিন, বড় যাতনার, তবু প্রকৃতির শূন্যতা পরিহারী নিয়মে আরও পরবাসী মানুষ জুটে যায় তো। দুপুরবেলা কারও বাড়িতে সবাই মিলে হয় ভোজ, দিশি মুরগির স্বাদ ধরতে রাঁধা হয়েছে হার্ড-চিকেন, রোজমেরী গোমেজ বড় উদ্‌গ্রীব মনোযোগে বানিয়েছে ৫০ জনের পাতে দেওয়ার পাটিসাপটা। শুধু সেই যে ইছামতী নদীর ঝিনুক কাটাই করে হাতার মতো গড়ত তার মা, যা দিয়ে সবচেয়ে ভালো করে পাটিসাপটার পাটিটুকু গুটিয়ে তোলা হতো, তা আর নেই. . . বলতে বলতে বিজলিবাতির হলদে আলোয় রোজমেরীর চোখ ছলছল করে। কেউ বলবে সেই অশ্রু আসন্ন উৎসবের খুশিতে, কেউ বলবে পুরোনো দিনের টানে, কিংবা হয়তো হলুদ আলোর কারসাজি। 

 ‘কেমনে চিনিব তোমারে মুর্শিদ ধন হে’র সুরের আদলে কারা গায় যিশুর নামে ‘তোরা যাবি চল দায়ূদনগর প্রেমে টলমল’, সুর যত সহজে মিশে যায় আরেক বাণীতে, কুকি যত সহজে পরিবেশিত হয় পুলির পাশে, তত সহজে মানুষ কি মেশে আরেক মানুষে? মেশার সুযোগ হতে পারে ভেবেই কি এত অবারিত আয়োজন মানুষের উৎসবের? 

মনে ভাবি, কত জাত মানুষের, রঙের জাত, ধর্মের জাত, দেশের জাত. . . অত অসমতল প্রান্তরে যে ভালবাসা বিলাতে এসেছিল, ইসা কিংবা যিশু, সে শিশুটির জন্ম তুচ্ছ গোশালে, আজ সারা পৃথিবীর কোটি কোটি লোকে তার জন্মদিন পালন করে, আহা তারা শিশুটির মতো বিভোর হয়ে মানুষকে ভালোবাসুক। শিশুটির জন্মমুহূর্তে ধাত্রেয়িকার মতো ঘিরে ধরা পশুপাখিকে ভালোবাসুক। বিপদে আশ্রয় না পেয়ে শিশুটির অনিকেত মা-বাপের মতো করে ‘কেহ যেন দুঃখভোগ না করে’। 

সাগুফতা শারমীন তানিয়া যুক্তরাজ্য প্রবাসী কথাসাহিত্যিক