যিশুখ্রিষ্টের মহা আবির্ভাব

যিশুখ্রিষ্টের উদ্দেশে ভক্তের প্রার্থনা। গতকাল তেজগাঁওয়ে হলি রোজারি চার্চে।  ছবি: সাইফুল ইসলাম
যিশুখ্রিষ্টের উদ্দেশে ভক্তের প্রার্থনা। গতকাল তেজগাঁওয়ে হলি রোজারি চার্চে। ছবি: সাইফুল ইসলাম

কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন বা জন্মতিথিকে প্রথম ‘বড়দিন’ নামে আখ্যায়িত করেন। সময়ের সীমারেখায় বড়দিন বড় নয়। কিন্তু মহামানব যিশুখ্রিষ্টের জন্মের মধ্য দিয়ে দিনটির তাৎপর্য বড় হয়ে উঠেছে। খ্রিষ্টবিশ্বাসীদের কাছে যিশুর জন্মদিনটি খুবই আনন্দের, কেননা এদিন ঈশ্বরপুত্র যিশুখ্রিষ্ট মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে। তাই যিশুর জন্মদিন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার দিন। এটি সবচেয়ে আনন্দের দিন হিসেবে চিহ্নিত ও পরিগণিত। আনন্দের এই দিনটি সবার কাছে ‘বড়দিন’। 

গোটা বিশ্বেই ‘বড়দিন’ উৎসব আনন্দময় ব্যঞ্জনায় ও ঘনঘটা পরিবেশের মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপন করা হয়। ইউরোপ-আমেরিকার দ্বার অতিক্রম করে বড়দিন এখন গোটা বিশ্বেই পরিচিতি লাভ করেছে। বড়দিন উদ্‌যাপিত হয় আধ্যাত্মিক চেতনা ও উপাসনার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে বড়দিনের উৎসব উদ্‌যাপিত হয় কীর্তন-বৈঠক, পিঠাপুলি তৈরি, বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট সাজানো, পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়, উপহার প্রদানে, নতুন পোশাক পরিধানসহ নানাবিধ আয়োজনে। 

বড়দিনের মুখপাত্র প্রবক্তা ইসাইয়া
প্রবক্তা ইসাইয়া যিশুখ্রিষ্টের আগমনকে উদ্দেশ করে প্রাবন্ধিক বাণীতে বলেন, ‘ওই দেখো তোমার পরিত্রাতা আসছেন এখন’ (ইসাইয়া ৬২:১১)। ঈশ্বরের মনোনীত ইসরায়েল জাতি নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। স্বয়ং ঈশ্বর উদ্যোগী হয়ে একজন ত্রাণকর্তাকে জগতে পাঠাতে চাইলেন, যিনি আলোকবর্তিকাস্বরূপ জগতের মানুষকে আলোর নিশানা দেখাবেন। প্রবক্তা ইসাইয়া তাঁর বাণীতে বলেন, ‘অন্ধকারে পথ চলছিল যারা, সেই জাতির মানুষেরা দেখেছে এক মহান আলোক; ছায়াচ্ছন্ন দেশে যারা বাস করছিল, তাদের ওপর ফুটে উঠেছে একটি আলো’ (ইসাইয়া ৯:১)। যিশু নিজেও বলেছেন ‘আমি জগতের জ্যোতি’। প্রবক্তা ইসাইয়ার ভাষায় যিশুর পরিচয় হলো, ‘কেননা আমাদের জন্য একটি শিশু যে জন্ম নিয়েছেন, একটি পুত্রকে আমাদের হাতে যে তুলেই দেওয়া হয়েছে। তাঁর কাঁধের ওপর রাখা হয়েছে সবকিছুর আধিপত্য ভার। তাঁকে ডাকা হবে অনন্য পরিকল্পক, পরাক্রমী ঈশ্বর, শাশ্বত পিতা, শান্তিরাজ, এমনই সব নামে’ (ইসাইয়া ৯:৫)। তাই যিশুখ্রিষ্ট হলেন শান্তিরাজ, ধর্মরাজ ও ন্যায়ের জ্যোতি। 

দীক্ষাগুরু যোহন: প্রভুর আগমনের পথ প্রস্তুতকারী
দীক্ষাগুরু যোহন পুরোনো এবং নতুন নিয়মের মধ্যস্থতাকারী বা সংযোগকারী। তিনি মন পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তোমরা মন ফেরাও: স্বর্গরাজ্য এখন খুব কাছেই!’ (মথি ৩:২)। তিনি তাঁর প্রচারে জোর দিয়েই বলেন, ‘যার দুটো জামা আছে সে বরং যার কোনো জামা নেই, তাকেই একটা দিক! তেমনি যার খাবার আছে, সে–ও তা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে দিক।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে কর ধার্য আছে, তার চেয়ে বেশি আদায় কোরো না।’ তখন কয়েকজন সৈনিকও তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘আর আমরা? আমাদেরই বা এখন কী করা উচিত?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমরা কারও ওপর জোরজুলুম চালিয়ে কিছু পাওয়ার চেষ্টা কোরো না! কারও নামে মিথ্যা অভিযোগও এনো না। তোমাদের মাইনেটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থেকো’ (লুক ৩:১১-১৪)। দীক্ষাগুরু যোহন তাঁর প্রচারের মধ্য দিয়েই যিশুর আসার পথ প্রস্তুত করেন তথা মানুষের মনের পরিবর্তনের আহ্বান জানান। যিশুর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি যে তাঁর জুতোর বাঁধন খুলে দেব, সেই যোগ্যতাও আমার নেই। তিনি কিন্তু পবিত্র আত্মা ও অগ্নিতেই অবগাহন করিয়ে তোমাদের দীক্ষাস্নাত করবেন’ (লুক ৩:১৬)। যোহন যিশুকে মহান ও মুক্তিদাতা হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দেন।

বড়দিন উদ্‌যাপন ও তাৎপর্য
একজন ঐশ্বতত্ত্ববিদ যিশুর জন্মরহস্যের অনুধ্যানে বলেন, ‘ঈশ্বরপুত্র মানুষ হয়েছেন আমরা যেন ঈশ্বরপুত্রের মতো হয়ে উঠি।’ যিশুর জন্মদিন দীক্ষিত ভক্তের কাছে অতি আনন্দের একটি দিন। তাঁর জন্ম হয়েছে দীনহীন জীর্ণ গোয়ালঘরে। বিনম্র সেবক বেশে তাঁর জন্মের ঘটনা হয়ে উঠেছে অনন্য এক দৃষ্টান্ত, কেননা তাঁর মতো দীনহীন পরিবেশে এখন পর্যন্ত কোনো মহামানব জন্মগ্রহণ করেননি। 

গোটা বিশ্বেই বড়দিন আজ একটি আনন্দময় ঘটনা ও উৎসব। বড়দিন আজ জাতি–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সর্বজনীন উৎসব হয়ে উঠেছে। এই দিনে খ্রিষ্টানুসারীরা কীর্তন গান ও নৃত্য করে। সান্তা ক্লজ সেজে একে অপরকে উপহার দেয়। পরস্পরের মধ্যে শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময় করে। নানা রকম কেক, পিঠা ও সাজসজ্জার আয়োজন করতে দেখা যায় অনেক স্থানে। পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে বড়দিন উপলক্ষে নানা রকমের বিশেষ আয়োজন দেখা যায়। মিলন ও ভ্রাতৃপ্রেমের উৎসব বড়দিন মানুষে মানুষে মিলনের নিমন্ত্রণ জানায়। দীন-দুঃখী, উঁচু-নিচু ও অভাবী মানুষেরা এদিন এক কাতারে দাঁড়ানোর সুযোগ লাভ করে। যিশুর জন্মোৎসব মানুষকে সহযোগিতা করতে শেখায়। 

যিশুর জন্মোৎসবকে ঘিরে খ্রিষ্টভক্তদের মধ্যে অনেক আনন্দ, সহভাগিতা ও মিলন পরিলক্ষিত হয়। যিশুর আগমনবার্তা পৃথিবীকে শান্তি ও প্রেমের সংকীর্তনে মুখরিত করে। তাঁর আগমনের স্বর্গীয় সংগীত হলো: 

‘জয় ঊর্ধ্বলোকে পরমেশ্বরের জয়!

ইহলোকে নামুক শান্তি তাঁর অনুগৃহীত মানবের অন্তরে!’ (লুক ২:১৪)

শিশু যিশুর জন্মদিন আমাদের সবার আনন্দের দিন। তাঁর জন্মদিন সবার বড়দিন। শুভ বড়দিন! 

ফাদার দিলীপ এস কস্তা ক্যাথলিক ধর্মযাজক, মথুরাপুর ধর্মপল্লি, চাটমোহর, পাবনা