একুশের একটি জরুরি কাজের কথা

পুরান ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে ইডেন কলেজের িবজ্ঞান িবভাগের ছাত্রীেদর স্মৃতিস্তম্ভ িনর্মাণ, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩। ছবি: রফিকুল ইসলাম
পুরান ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে ইডেন কলেজের িবজ্ঞান িবভাগের ছাত্রীেদর স্মৃতিস্তম্ভ িনর্মাণ, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩। ছবি: রফিকুল ইসলাম

বরাবরের মতো এবারও একুশে ফেব্রুয়ারিতে সামগ্রিক কার্যক্রমে থাকছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক করণীয় নির্ধারণ। এটাই হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারির ধারা। শহীদদের বুকের খুনে আঁকা পথচিহ্ন ধরে গত ছত্রিশ বছর গণ-অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে, স্থাপিত হয়েছে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে যে জয় অর্জিত হয়েছে, তার পরিসর ও মান কোনো দিক দিয়েই কম নয়। এসব সাফল্যই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত দায়দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়ে চলেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার করণীয় এবার অগ্রাধিকার দাবি করছে। এরই পাশাপাশি এখানে সাংস্কৃতিক করণীয়ের চৌহদ্দির মধ্য থেকে একটি জরুরি কাজকে সামনে রাখছি। এটা হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র তৈরি করা। এই করণীয়ের প্রাথমিক বিন্যাসের ক্ষেত্রে একটা প্রয়োজন পূরণ করবে। এই প্রয়োজন হচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকে যারা প্রথম থেকেই বাধা দিয়ে আসছে, তারা একই উদ্দেশ্যে আজ সংস্কৃতির দিক দিয়ে শূন্যতা ও মত্ততার পরিবেশ সৃষ্টি করার যে প্রয়াস চালাচ্ছে, তাকে প্রতিহত করা।

একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে তৈরি একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ ও শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলার লড়াইকে একটা গুণগত উত্তরণে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে। উল্লেখ্য, মুনীর চৌধুরী ১৯৫৩ সালে জেলখানায় বসে কবর নাটক লিখেছিলেন একুশের শহীদদের নিয়ে। এই নাটক বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রচণ্ড অস্ত্র হিসেবে কাজ করে এসেছে। এই প্রসঙ্গে আরও মনে রাখা দরকার, একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে, একুশের শহীদদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশেও নানা কারণে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়নি। এ ব্যাপারে আর কালক্ষেপণ চলতে পারে না। 

আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের এই জরুরি কাজটি সম্বন্ধে প্রথম কথাই হলো এই, একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২–কে কেন্দ্র করে এবং তাতেই নিবদ্ধ রেখে এই চলচ্চিত্র তৈরি হবে। ১৮ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারির উত্তাল ঘটনাধারার মণিমালার মধ্যে গাঁথা হবে নিষেধাজ্ঞা ভাঙার রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারিকে। এর লোক মহাকাব্যিক নায়কেরা হবে ছাত্রজনতা ও ছাত্রজনতার প্রতিনিধি শহীদ সালাম বরকত রফিক শফিক জব্বার। তাঁদের সহায় হিসেবে থাকবে বিরোধী নামে অখ্যাত রাজনৈতিক দলসমূহ। এরপরই আসবে সেই সাতটি দিনের কথা, যে দিনগুলোতে ঢাকায় ছাত্র-জনতার সমান্তরাল সরকার স্থাপিত হয়েছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। আজ যেখানে শহীদ মিনার গড়া হয়েছে, সেখানে কীভাবে ইটের মিনার গড়া হয়েছে, সেখানে কীভাবে ইটের মিনার গড়েছিল ছাত্রজনতা লড়াই করে, সেই ঘটনা আসবে সঙ্গে সঙ্গে। কীভাবে আজিমপুরের কবরখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শহীদদের লাশ, তার চলন্ত চিত্র আসবে এর পাশাপাশি। 

ঢাকার নারীসমাজ এই সর্বপ্রথম যেভাবে সমস্ত জড়তা ভেঙে একুশে ফেব্রুয়ারির পরের সাত দিন পথে পথে নিঃসংকোচে নির্ভয়ে রাত বারোটার পরেও খবরাখবর বহন করলেন, সে দাবি থাকবে। থাকবে চিরধিক্কৃত কেরানিরা কীভাবে গণ-অভ্যুত্থানের পুরোভাগে দাঁড়িয়েছিল, তার ছবি। থাকবে গাড়োয়ান, রিকশাশ্রমিক, ছোট দোকানদারেরা, ফেরিওয়ালারা একই ভূমিকায়। এর সঙ্গেই আসবে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়া অভ্যুত্থানের ছবি। আসবে সামাজিক, রাজনৈতিক পালাবদলের কয়েকটা দিনে কীভাবে চাষি হালচাষ বন্ধ রেখেছিল, তার ছবিও। কীভাবে ছাত্রসমাজ দলে দলে কারাবরণ করেছিল, কীভাবে তাদের সঙ্গে ছিল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলসমূহ, কীভাবে একুশের গান আর কবিতার জন্ম হলো, কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ এক টুকরা কালো কাপড় মহাবিদ্রোহের প্রতীক হয়ে উঠল ইত্যাদি ইত্যাদি। এই চলচ্চিত্রেই থাকবে ঢাকা নগরীতে দুই বছরের জন্য যে বিরতি নেমে এল, তার কথা। দুই বছর পর কাটল এ বিরতি যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নিয়ে। এই ইশারা দিয়ে ছবি শেষ হতে পারে। 

যাতে একুশের ঘটনাকে ছবিটিতে কেন্দ্রীভূত করা হয়, সে জন্য ওপরে একটা ধারণা দেওয়া হলো মাত্র। যাঁরা তৈরি করবেন, তাঁরা গত ৩৬ বছরে একুশের ঘটনা নিয়ে গড়ে ওঠা সমস্ত তথ্য—সংগীত, চিত্র সাক্ষাৎকার, সাহিত্য ঘেঁটে যথাবিহিতভাবে চিত্রনাট্য রচনা করবেন। ছবি তৈরি বিশেষজ্ঞদের কাজ, কিন্তু ছবির ফরমাশ সর্বসাধারণের। সেই হিসেবে এখানে করণীয় সম্পর্কে কয়েকটা প্রস্তাব তুলে ধরছি। 

এই ছবির মালিক হবে বাংলাদেশের জনগণ। ছবির প্রযোজনা হবে যৌথ। যৌথ এই প্রয়াসের উদ্যোগ নেবে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় (চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ), জয়নুল আবেদিন প্রতিষ্ঠিত চারুকলা মহাবিদ্যালয়, চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং অন্য শিল্পীদের সংঘ, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, ছায়ানট, উদীচী প্রভৃতি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জাতীয়কৃত ব্যাংকসমূহের নতুন নামকরণ হয়েছে, তাতে যে মাতৃভাষার ভান্ডার ব্যবহার করা হয়েছে, তার নব উন্মোচন ঘটেছিল একুশে ফেব্রুয়ারিতে। এ কথা মনে রেখে ব্যাংকগুলো যৌথভাবে তদারকির প্রয়োজনীয় ব্যয় রেখে আলোচ্য ছবিটির অর্থের সংস্থান করবে। 

বাংলাদেশের আলোকচিত্রশিল্পী, চিত্রশিল্পী ও চলচ্চিত্রশিল্পীরা যৌথভাবে ছবিটি তৈরি করবেন। এই চলচ্চিত্র প্রযোজক যৌথ সংস্থার আহ্বায়ক হিসেবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের যেকোনো উদ্যোগ নিতে পারেন। কিন্তু আহ্বান হবে যৌথ। প্রথম আহ্বানে দেশের ছাত্রসমাজ, বুদ্ধিজীবী সমাজ, নারীসমাজ, শ্রমিক সংঘসমূহের কাছে সহযোগিতার জন্য আবেদন রাখবেন। সহায়তা চাইবেন সংবাদপত্রসমূহের এবং সংবাদপত্র মারফত জনগণের কাছে। ৩৬ বছর আগে যে ঘটনা ঘটেছিল, তার স্মারক হিসেবে যার কাছে যা আছে, তা জানার জন্য। অবশ্য ছবিটি কীভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি এবং তার আগের ও পরের দশ দিনের ঘটনাবলিতে কেন্দ্রীভূত ও নিবদ্ধ থাকবে, সেটা সব জনসাধারণকে জানানো হবে। তাহলে সর্বসাধারণ তাঁদের করণীয় নির্দিষ্ট করতে পারবেন। 

যৌথ সংস্থা অবশ্যই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গত ৩৬ বছরের কর্মী লেখক-লেখিকা তথা কবি, সংগীত–রচয়িতা, নাট্যরচয়িতা, নিবন্ধকার এবং লোকশিল্পীদের সহায়তা চাইবেন। 

বাংলা একাডেমি ১৯৭২ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে যে গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল, তার নিবন্ধসমূহকে অনুসরণ করে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। 

আগামী ’৮৯-এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে যাতে চিত্রনাট্য রচনা সম্পূর্ণ করে একুশের চলচ্চিত্রের মহরত অনুষ্ঠান করা যায়, সেটাই হবে উদ্যোক্তা কর্মী, শিল্পী ও সংশ্লিষ্ট সবার লক্ষ্য। 

এই ছবি তৈরি করতে এক বছর সময় লাগবে। ১৯৮৯ সাল দূরে নয়। এই দুই বছর বাংলাদেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একুশের ছবি তৈরি নিয়ে গড়ে উঠুক সেই প্রয়াস, যাতে সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য ও নৈরাশ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জনগণ প্রতিনিয়ত উৎসাহ-উদ্দীপনা পাবে। 

জয় একুশে ফেব্রুয়ারি, জয় বাংলার জনগণ। 

মতিউর রহমান সম্পাদিত রণেশ দাশগুপ্তর বই যদিও হাওয়া উল্টোপাল্টা (২০১৭) থেকে সংগৃহীত

রণেশ দাশগুপ্ত
লেখক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক। ভারতের আসাম প্রদেশের ডিব্রুগড় শহরে ১৯১২ সালে জন্ম। রাজনৈতিক কারণে প্রায় নয় বছর কারাভোগ করেন। দৈনিক সংবাদসহ দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কাজ করেন। ছিলেন একুশের চেতনায় সঞ্জীবিত। এ নিয়ে লিখেছেনও অনেক। ১৯৭৫ সালে কলকাতায় গিয়ে আর দেশে ফিরতে পারেননি। উল্লেখযোগ্য বই: উপন্যাসের শিল্পরূপ, শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে, ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রাম, সেদিন সকালে ঢাকায়, রহমানের মা ও অন্যান্য ইত্যাদি। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর কলকাতায় মৃত্যু। তাঁর সৎকার হয় ঢাকায়। ১৯৯৮ সালে সম্মানিত হন মরণোত্তর একুশে পদকে।