বজ্রমানব

পাকিস্তানি সেনারা আবার আগুন দিয়েছে শহরের বিভিন্ন এলাকায়। আবার গুলি চালাচ্ছে। তবে আশপাশে কোথাও বলে মনে হচ্ছে না। একটু দূরে দূরে। বোধ হয়, গতকাল তাঁদের এলাকার কাজ শেষ করে আজ অন্য এলাকা ধরেছে। এমনি চলতেই থাকবে নাকি! আচ্ছা জাঁতাকলে ফেলেছে রে বাবা! সারা শহরে কারফিউ দিয়ে রেখে দিব্যি এখন একটা একটা করে ধরে সাবাড় করবে সবাইকে। মানে, সব বাঙালিকে? এত ঔদ্ধত্য ওই পশ্চিম পাকিস্তানিদের!

পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্ধত কণ্ঠস্বর রেডিওতে বেজে উঠল—শেখ মুজিবুর রহমান দেশের শত্রু, বিশ্বাসঘাতক...। কে বলছে এ কথা? স্বয়ং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। কিন্তু বাংলাদেশের প্রত্যেকটি ছেলেবুড়ো জানে, শেখ মুজিবুর রহমান তাদের বন্ধু। বাংলার বন্ধু শেখ মুজিব। কিন্তু বাংলার শত্রুরা কী বলে শোনো।...দেশকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সে জন্য তাঁর শাস্তি না হয়ে যায় না।...শেখ মুজিবুর রহমানের শাস্তি! দেবে ইয়াহিয়া খান! অভিযোগ? পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ কথা শুনে এখন মুখ খিস্তি করতে ইচ্ছে করে,—ওরে খবিশের বাচ্চারা, পাকিস্তান বানিয়েছিল কারা? তোরা তখন তো ইংরেজ সরকারের বন্দুকের নল সাফ করতিস। আর শেখ মুজিব তখন তরুণদের মধ্যে পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আজ মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি হলো? শেখ মুজিবের পেছনে আজ সাড়ে সাত কোটি মানুষের সমর্থন আর তোর পেছনে? কয়েকটা বন্দুক আর গোলাবারুদ। কিন্তু বন্দুক মানুষেই বানিয়েছে না? মানুষের চেয়ে সেই বন্ধুকের ক্ষমতা কখনো বেশি হয় নাকি। নিশ্চয়ই মানুষের জয় হবে। জয় হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। কত রক্ত নেবে পিশাচেরা! বঙ্গবন্ধু তো বলেই দিয়েছেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি প্রয়োজন হলে আরও রক্ত দেব। দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’...বঙ্গবন্ধুর সেই সাতই মার্চের কণ্ঠস্বর। একবার তা যে বাঙালির কানে গেছে জীবনের মতো সে হয়ে গেছে অন্য মানুষ। কিন্তু হয়নি যারা? তারা মানুষ নয়। তারা ওই রক্তলোভী পিশাচের দলে। রক্তপায়ী জীবটা এখন বলে কী! পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।...আবার মুখে গাল এসে গেল সুদীপ্তর। অমন যে নিরীহ অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহিন, তিনিও ক্রোধে প্রায় দিশেহারা হলেন—ওরে হারামের হাড়, সংহতি মানে কী? বিনা বাধায় পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ত চুষতে দেওয়ার নাম সংহতি? তোদের ওই সংহতির নিকুচি করি। রাগে রেডিওটাকেই এখন তুলে আছাড় মারতে ইচ্ছে করছে। নাহ্ রেডিওর কাছ থেকে এখন সরে যাওয়াই ভালো। ঘরের অন্য কোণে চলে গেলেন সুদীপ্ত। খাটের একাংশ পুড়ে গেছে, শুতে গেলে ভেঙে পড়তে পারে। অতএব মেঝেতে সপ বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন—ঘুমোনোর উদ্দেশ্য নয়। সাতই মার্চের রেসকোর্স মাঠে এখন ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। অতীতের কোনো আনন্দক্ষণে আত্মনিমজ্জনের মধ্যে বেঁচে ওঠার কোনো রসদ যদি মেলে। হ্যাঁ বেঁচে ওঠার একটি মন্ত্রই আজ বাঙালি জপ করতে পারে সেই অগ্নিমন্ত্রের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। না, নাম জপ নয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশকে জপমন্ত্রের মতো সারাক্ষণ মনের মধ্যে জাগ্রত রেখে কর্মের পথ বেছে নিতে হবে... ‘আর যদি আমার মানুষের উপর একটি গুলি চলে, তোমাদের উপর নির্দেশ রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’...আমরা যদি প্রত্যেকে নিজের ঘরকে এক একটি দুর্গ করে তুলতে পারতাম। মুজিব ভাই, তোমার বাংলাদেশ একদিন ওদের জন্য দুর্ভেদ্য দুর্গ হবেই। কিন্তু তার আগে একটি নয়, বহু গুলি তারা চালাবে তোমার দেশের মানুষের ওপর।

উহ্, আবার সেই কালরাতের মতো গুলি-গোলা শুরু হলো। বকশীবাজারের দিকেই আগুনের শিখাটা যেন বেশি দেখা যাচ্ছে। আগুন আর গুলি-গোলার আওয়াজ। সেই রাতও গুলি-গোলার বিচিত্র শব্দ শুনে কাটল। কারফিউ উঠল সকালে একটু বেলা হওয়ার পর।...

সুদীপ্ত বেরিয়ে গেলেন। প্রথমেই গেলেন তিনতলায়। ড. ফজলুর রহমানেরও ড্রয়িংরুম খোলা। লোকটি ড্রয়িংরুমেই পড়ে ছিল। ড. রহমানের বৃদ্ধ বাবুর্চি। মুখভরা দাড়ি, পরহেজগার মানুষ। রহমান সাহেবদের গ্রামেই বাড়ি। ছেলেবেলায় এর কোলে-পিঠে চড়ে রহমান সাহেব মানুষ হয়েছেন। এবং তখনই মনে হলো ড. ফজলুর রহমানের ভাগ্যেও কি তবে...? না, তা না হতেও পারে। তাঁদের মতোই তিনিও লুকিয়ে বাঁচতে পারেন না? হ্যাঁ, বেঁচেই আছেন হয়তো। আশাটাকে দুহাতে বুকে চেপে সুদীপ্ত ভেতরে গেলেন। হায় হায়, কাঞ্চন যে! শয়নকক্ষের সামনে বারান্দায় কাঞ্চনের লাশ পড়ে আছে। ড. ফজলুর রহমানের ভাগনে কাঞ্চন। মামার কাছে থেকে কলেজে পড়ত। কলেজে? ব্যস, তবে আর কথা নেই। এ ছেলে রাষ্ট্রদ্রোহী না হয়ে যায় না। রাষ্ট্রদ্রোহী যে, তার আরও প্রমাণ আছে। স্বাস্থ্য ভালো ছিল কাঞ্চনের। খেলাধুলা করা সবল-সুস্থ একজন বাঙালি যুবক। ওরে বাবা। তা হলে তো একে বাঁচতে দেওয়া যায় না। ভাগনে কাঞ্চনকে মেরে শোবার ঘরে ঢুকে মামাকে মেরেছে। দেয়াল-আলমারির পাশে কাত হয়ে পড়ে আছেন ড. ফজলুর রহমান।...

বনের পশুকেও তো কেউ এমন করে মারে না। দুমাসের শিশুকে বনের বাঘও তো আক্রমণ করবে না। ক্ষুদ্র মানবশিশু রমুলাসকে লালন করেনি বনের এক বাঘিনী? হ্যাঁ, মানুষ পশুরও অধম কখনো হয়। কিন্তু সব মানুষ হয় না। যারা হয় তাদের সঙ্গে কি একত্র থাকা চলে? না, আর ওদের সঙ্গে নয়। ফিরোজ ঠিকই বলে। ফিরোজ বলে, ব্রিটিশ রাজত্বে বাংলাদেশের অবস্থা যেমন ছিল এখনো ঠিক তেমনি আছে। স্বাধীনতাসংগ্রাম এখনো তাই শেষ হয়নি। শেষ কী? শুরুই তো হয়নি এতকাল। শুরু হয়েছে গত সাতই মার্চ থেকে। মুজিবুর রহমান গণ-আন্দোলন শুরু করলেন।...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বাধীনতা? প্রশ্ন তুলেছিলেন সুদীপ্ত। বন্ধুর সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। কিন্তু আর তো তর্কের অবকাশ নেই। পাকিস্তান নামে কোনো দেশ পাঞ্জাবসিন্ধু অঞ্চলে থাকতে পারে, বাংলায় নেই। থাকলে তো ওরা-আমরা মিলেমিশে একই দেশের অধিবাসী হতাম। এবং তা হলে এমনি করে নির্বিচার নারী-শিশু-বৃদ্ধ সবাইকে ওরা হত্যা করতে পারে? নিজের দেশের লোক হলে এমনি করে নিরপরাধ জনসাধারণকে মারতে পারে কেউ? পরের দেশেও এমন ঢালাও গণহত্যার কথা ক্বচিৎ শোনা গেছে!

কোথায় এলেন তিনি। এখানে শহীদ মিনার ছিল না? সেটা কোথায়? কোনো চিহ্নই নেই। তবু চিহ্ন আছে। পড়ে আছে বালু-সিমেন্টের স্তূপ। ডিনামাইট দিয়ে গোড়াসুদ্ধ নির্মূল করে দিয়েছে বাঙালির মর্যাদার প্রতীক সেই প্রাণপ্রিয় শহীদ মিনার। এই তো কদিন আগে এইখানে শপথ নিয়েছিলেন তাঁরা—ঢাকার শিল্পী-সাহিত্যিকেরা। কবিবন্ধু শামসুর রাহমানের কণ্ঠে সুদীপ্তদের সবার দৃপ্ত শপথ বেজে উঠেছিল—আমরা লেখনীকে আজ দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের হাতিয়ার করব। তা করতেই হবে যে।

এবারের একুশে ফেব্রুয়ারিতে রাতদুপুরের অনুষ্ঠানে সুদীপ্ত এখানে এসেছিলেন। কেননা শুনেছিলেন, স্বয়ং শেখ সাহেব ওই সময় আসবেন। এসেছিলেনও শালপ্রাংশু বজ্রমানব শেখ মুজিবুর রহমান। কেমন যেন ম্লান দেখাচ্ছিল না মুজিব ভাইকে? ওকে ম্লান বলে নাকি! ঠিক কেমন যে দেখাচ্ছিল কোনো শব্দ দিয়ে তা যেন প্রকাশ করা যায় না। দুর্জয় সেনাপতির প্রতিজ্ঞা, জননীর মমতা এবং ষড়যন্ত্রসংকুল ভবিষ্যতের আশঙ্কা—সবকে এক পাত্রে ঢেলে মিশালে যা দাঁড়ায় মুজিব ভাইয়ের মুখে-চোখে ছিল সেই ভাবের অভিব্যক্তি। বাইরের শত্রুর কাছে এত কঠোর এত দুর্দমনীয় যে ব্যক্তিত্ব, ঘরের লোকের কাছে তার একি রূপ! সুদীপ্ত তাঁর চোখের দিকে তাকালেন। সেখানে তো কই সেই আগুন নেই! তবু আগুন আছে। আগুন চাপা দেওয়া আছে এবং চারপাশে আপনজনের উদ্দেশে উৎসারিত হচ্ছে—বন্ধুর প্রীতি, শিশুর সারল্য আর বয়স্ক হৃদয়ের বাৎসল্য। এখন তিনি অকঠোর, কিন্তু সেই সঙ্গে অনমনীয় শপথে আকীর্ণ। সেই আত্মপ্রত্যয়বিদ্ধ দুর্দমনীয়তার সঙ্গে কী একটা এসে মিশেছে যেন। কী তার নাম? অপার্থিব দীপ্তি? স্বর্গীয় আভা? নাম যা-ই হোক, তিনি যে তখন ঐশীবাণীর আশীর্বাদপ্রাপ্ত ছিলেন, তাতে তো কোনোই ভুল নেই। তা না হলে কী করে তখন উচ্চারণ করেছিলেন সেই অমোঘ বাণী!—

‘এই শহীদ মিনারে আপনাদের সাথে এই বোধ হয় আমার শেষ দেখা।’ শহীদ মিনারের সামনে থেকে একমুঠো মাটি নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন—

‘আমি যদি না-ও থাকি, আপনারা থাকবেন। এই শহীদ মিনারকে ওরা যদি গুঁড়িয়ে দেয়, তবু থাকবে আপনার দেশের ধুলো-কাদা-মাটি। কখনো এই দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।’

কী কোমল প্রীতিস্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর! ইনিই কি সেই দুই সপ্তাহ পরের বজ্রমানব শেখ মুজিব। একুশে ফেব্রুয়ারির ঠিক দুই সপ্তাহ পর। রমনা রেসকোর্সে সাতই মার্চের সেই বজ্রকণ্ঠ। সেই কণ্ঠ বিধ্বস্ত শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আবার স্মরণ করলেন সুদীপ্ত। কাল থেকে কতবারই তো স্মরণ করলেন। সেই কণ্ঠ ইতিপূর্বে কখনো কোনো বাঙালি শুনেছে? হয়তো কখনো শুনেছে শশাঙ্কের কণ্ঠে, হুসেন শাহের কণ্ঠে কিংবা সিরাজের সেনাপতি মোহনলালের কণ্ঠে। অতঃপর এই সেদিন নেতাজি সুভাষের কণ্ঠে। নেতাজির প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু! তোমার প্রয়াস ব্যর্থ হবে না। আমরা ব্যর্থ হতে দেব না। সাতই মার্চের রমনা রেসকোর্সে যারা গিয়েছিল তারা কি জীবনের মতো অন্য মানুষ হয়ে যায়নি? অন্তত সুদীপ্ত হয়েছিলেন। রাজনীতির ডামাডোলে সুদীপ্ত কখনো ছায়া মাড়ান না। কিন্তু সাতই মার্চের রমনা রেসকোর্সের দৃশ্য দেখার পর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতায়, তাঁর সমস্ত চিত্ত ও দেহের প্রতি রক্তকণা একটি দৃঢ়প্রত্যয়ের বৃন্তে সংহত সূর্যমুখী হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতা-উন্মুখ অনির্বাণ সূর্যমুখী।

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রচিত রাইফেল রোটি আওরাত থেকে, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ২০১৭
আনোয়ার পাশা: কবি, কথাসাহিত্যিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী