স্বাধীনতার সংগ্রাম

সেই সময় তাঁকে (কামর সাহেবকে) কয়েক মাস বাস করতে হয়েছিল মগবাজার এলাকার একটি বাড়ির দোতলায়। একতলায় থাকতেন সপরিবারে বাড়িঅলা। বাড়িঅলার স্ত্রীর মধ্যে বাগ্মিতার গুণ ছিল, সেটা বোঝা গেল ছাব্বিশে মার্চের আগের দিনগুলোতে। ভদ্রমহিলা ফরসা, ছিপছিপে, সুন্দরী এবং সাহেবি কেতায় দুরস্ত। সেই সময় সকলেরই সাহস একেবারে বেপরোয়া হয়ে গেছে। যার যা মন চাইছে বলছে, দল বেঁধে লাঠি-সড়কি উঁচিয়ে এদিক-ওদিক যেখানে খুশি যাচ্ছে। বাংলাদেশ বলতে গেলে স্বাধীন হয়েই গেছে। কারণ ঢাকা থেকে কোথায় চিঠি বা টেলিগ্রাম যাবে, সেক্রেটারিয়েটের বড় বড় অফিসাররা কী করবেন বা করবেন না, ব্যাংক, রেলওয়ে, সড়ক পরিবহন, বন্দর, বেতন দান, পেনশন প্রভৃতি বিষয়ে কীভাবে কতটা কাজ হবে বা হবে না, তার সবটাই ঠিক করে দিচ্ছেন অসহযোগ আন্দোলনের নেতারা। এমনকি, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নতুন গভর্নর টিক্কা খানকে শপথ পাঠ করাতেও অস্বীকার করেছেন। ইয়াহিয়া খানও চুপ করে আছেন। কিছুই বলছেন না। যেন তিনি মেনেই নিয়েছেন শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন, সুতরাং, তাঁর দল যদি আগাম কিছু কিছু ক্ষমতা ব্যবহার করতে শুরুই করে দিয়েছেন, তো কি আর বড় কাজ করেছেন, কিছুদিন পরই তো তাঁকে আরও বড় দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু কিছু কিছু লোক এটাকে ভালো লক্ষণ মনে করছেন না। একেবারে টুঁ শব্দটি করছে না তারা। এতটা ভালো আবার ভালো নয়। ভালো করে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।

যা-ই হোক, সেই ভদ্রমহিলা বক্তৃতা মুখস্থ করছেন। তাঁর গলার মডিউলেশান ভালো। গলাটাকে বেশ উঁচু-নিচু খেলাতে পারেন। কামর সাহেব ওপর থেকে শোনেন। তাঁর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এই ভদ্রমহিলা অবশ্যই একজন ভবিষ্যৎ মন্ত্রী। তাই তিনি বক্তৃতা দেয়াটাকে অভ্যাস করে নিচ্ছেন। পায়চারি করেন, আর তাঁর গলা থেকে গরম গরম বারুদের মতো শব্দ বের হয়। শুধু পায়ের কাজ, আর গলার কাজ। অন্য সব কাজ তিনি ইতরজনদের জন্য রেখে দিয়েছেন। তাঁদের বসার ঘরের দেয়ালে ঝুলছে শেখ মুজিবের ছবি। সেটা সেই দিনগুলোতে কোনো অভিনব দৃশ্য নয়। প্রায় সব বাড়িতেই তা-ই। সেটা জিন্নাহ সাহেব আর লিয়াকত আলী খান সাহেবের ছবি ঝোলাবার জন্য সুসময় নয়। অবশ্য কিছু কিছু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোক ছিল। তাঁরা জিন্নাহ আর লিয়াকতের ছবি সরিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু দেয়ালটিকে আপাতত সাদা রেখেছেন। সারা দেশ যা করছে সেই ভদ্রমহিলাও তা-ই করছেন, এতে দোষ ধরার কিছু নেই। এবং কারও দোষ খুঁজে বেড়ানো কামর সাহেবের স্বভাবও নয়। কিন্তু একটা জিনিস কামর সাহেব বুঝতে পারছেন না। রেস খেলার ময়দানে শেখ সাহেব সাতই মার্চ যে বক্তৃতাটি দিলেন, ভদ্রমহিলা সেটাই কেন মুখস্থ করছেন। সে বক্তৃতা তো হয়েই গেছে এবং ভদ্রমহিলার বক্তৃতার গলা যতই ভালো হোক, শেখ সাহেবের মতো করে তো আর বলতে পারবেন না। তবু দিন নাই রাত নাই সকাল নাই সন্ধ্যা নাই, কামর সাহেবকে ননস্টপ শুনতে হচ্ছে: ‘১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খাঁ মার্শাল ল জারি করে দশ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৪ সালে ৬ দফা আন্দোলনের সময় আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালে আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া এলেন।—এরপর যদি একটি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়—তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।...আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব।...সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

৭ মার্চের জনসভায় যোগ দেয়ার জন্য এই ভদ্রমহিলাই একটি বড় মহিলা দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ময়দানে গিয়েছিলেন। কণ্ঠে কি দৃপ্ত স্লোগান! মুখ দিয়ে অগ্নিবর্ষণ করছেন। ১৭ মার্চ তারিখে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী চট্টগ্রামে বললেন, শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এ ধরনের ঘোষণা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে কোনোরূপ মতানৈক্য থাকতে পারে না। শেখ মুজিব আর ইয়াহিয়ার মধ্যে আপোসের কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। সেটাকেই স্বর্ণ সুযোগ মনে করে আরও কোনো কোনো ব্যক্তি আর দল স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন।

এল বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চের রাত্রিবেলা। ব্যারাক থেকে রাত্রি দশটার সামান্য আগেই তিন ব্যাটেলিয়ন সৈন্য বেরিয়ে এসে ঢাকা শহরের ওপর চড়াও হলো। সঙ্গে আছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালের এম-২৪ ট্যাঙ্ক। তারা মাঝরাতে উপস্থিত হলো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। দখল করল ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরি। এখান থেকেই আশপাশের হলগুলোতে গোলাবর্ষণ পাল্লার মধ্যে থাকবে। কী হচ্ছে বুঝবার আগেই ইকবাল হলের ২০০ জন ছাত্র প্রাণ হারাল।—সেইভাবেই শুরু।

পরদিন সকালবেলাই কাকপক্ষী ওঠার আগেই সেই ভদ্রমহিলা শেখ মুজিব এবং অন্য বাঙালি নেতাদের ছবিগুলো দেয়াল থেকে সরিয়ে ফেললেন। দেয়াল বেয়ে উঠলেন জিন্নাহ সাহেব আর ইয়াহিয়া খান। বাড়ির মাথায় আবার উড়ল পাকিস্তানের ঝান্ডা। সেই ভদ্রমহিলা—তৈয়বা যাঁর নাম—তাঁর মুখের আগুন নিভে গেল। যেখানে যেখানে আগুন ছিল, সব বরফ হয়ে গেল। সব আগুন কবজা করে নিল পাকিস্তানের ভাইজানরা। অবশ্য মুক্তিযোদ্ধারা আবার আগুন জ্বালাবে। কিন্তু মাঝখানে কিছুটা সময় হিমযুগ গেল।

মায়ের কাছে যাচ্ছি, মুক্তধারা, ১৯৮৯
রশীদ করীম: প্রয়াত কথাসাহিত্যিক