১৯৭১-এর টেলিভিশন সংবাদ : বঙ্গবন্ধু আর মার্চ

১৯৭৪ সালে ওয়াশিংটনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইকবাল বাহার চৌধুরী (সর্ব বাঁয়ে)। হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট েজরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠকের পর
১৯৭৪ সালে ওয়াশিংটনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইকবাল বাহার চৌধুরী (সর্ব বাঁয়ে)। হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট েজরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠকের পর

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ঐতিহাসিক দিনগুলিসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামের নানা ঘটনার কথা সকলেরই জানা। তবে ঘটনার আড়ালে আছে অনেক ঘটনা। সবার নিজস্ব নানান ঘটনা। তারই কিছু বিবরণ দিতে চাই আজ প্রায় ৪৭ বছর পর।

আমি তখন আদমজী শিল্প ও বাণিজ্যগোষ্ঠীর সদর দপ্তর মতিঝিল বাণিজ্য এলাকায় আদমজী কোর্টে ফুলটাইম কাজ করি। রাতে কাজ করি তখনকার পাকিস্তান টেলিভিশনের মুখ্য সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে। ১ মার্চ আদমজী কোর্টে আমার অফিসের সকালের কাজ শেষ করে দুপুরে কোনো রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ খাব বলে রাস্তায় বেরিয়েছি। হঠাৎ দেখি মিছিল আসছে পূর্বাণী হোটেলের দিকে। আদমজী কোর্ট, পূর্বাণী হোটেল আর তখনকার পি.আই.এ (বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান) অফিসের মাঝামাঝি এসে জনতার মিছিল থামল। সেই সময় পূর্বাণী হোটেলে চলছে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক। ১৯৭০-এর নির্বাচনে যারা জয়ী হয়েছে, তাদের নিয়ে বেঠক করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্বাণী হোটেলের বাইরে মিছিলের জনতা স্লোগান দিচ্ছে—‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, এই স্লোগান আগে কখনো শুনিনি। ঐদিন সকাল ১১টার দিকে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সরকার ঢাকায় জাতীয় পরিষদের আসন্ন অধিবেশন বাতিলের ঘোষণা দেন। তারই প্রতিবাদে জনতার এই স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল। এরপরই দেখলাম পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস অফিসে ইটপাটকেল নিক্ষে করে পাকিস্তান শব্দটি ভেঙে চুরমার করে দিল। ১ মার্চ এই ধরনের কিছু হবে, সম্ভবত কেউ তা ভাবেনি। আসলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের সরকারি ঘোষণাই পাকিস্তানের কবর রচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল সেদিন। জনতা যখন পূর্বাণী হোটেলের বাইরে, সেই সময় বঙ্গবন্ধু হোটেলের ভেতরে বৈঠক করছেন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে, যারা সেখানে উপস্থিত হন। ঢাকা টেলিভিশনের সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে আমিও সেখানে যোগ দিলাম। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের ফলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, সে প্রশ্ন তখন সবার মনে। পরের দিন ২ মার্চ, জাতীয় সংসদ অধিবেশন বাতিলের ঘোষণার বিরুদ্ধে হরতাল পালিত হলো।

৩ মার্চ ছাত্রদের আহ্বানে বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিলেন। সেদিন রাতে বাংলার জনসমুদ্রের সামনে বঙ্গবন্ধুর ওই ঐতিহাসিক ভাষণের বিস্তারিত সংবাদ উপস্থাপনের সময় আমি শেখ মুজিবুর রহমানের নামে আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলেছিলাম। পাকিস্তান টেলিভিশন বা রেডিও থেকে বঙ্গবন্ধু বলা যেত না, অথচ শেরেবাংলা বলার ব্যাপারে কোনো বাধা ছিল না। তখন থেকে প্রতিদিন বঙ্গবন্ধু বলা চালু হলো। সেদিন রাতে টেলিভিশন সংবাদ শেষে আমরা সংবাদ ইউনিট থেকে কযেকজন ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেলাম। তখন কারফিউ চলছে। টেলিভিশন সংবাদ বিভাগে কাজ করি বলে আমাদের সবার কারফিউ পাস ছিল, কাজেই যেতে সমস্যা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ওই ঐতিহাসিক বাড়ি, যা এখন জাদুঘরে পরিণত হয়েছে—সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম বাঁ দিকের কামরায় টেলিফোনে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম, খুলনা এবং অন্যান্য জায়গায় নির্দেশ দিচ্ছেন—‘কোট, পোর্ট, এয়ারপোর্ট সব বন্ধ করে দাও।’ ৩ মার্চ রাত ১০টার পরে সেদিন তাঁর পাশে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ ও মনসুর আলী। অন্য আরেকটি কামরায় ছিলেন জনাব আহাদ, তাঁর স্ত্রী রোজী আহাদ এবং তখনকার দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার ম্যানেজিং এডিটর আহসান আহমদ আশ্ক্। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের একই ব্যাচের ছাত্র তাঁর স্বামী পদার্থবিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিঞার সঙ্গেও অল্প কিছুক্ষণের জন্য দেখা হলো সেই রাতে। একটু পরে বঙ্গবন্ধু বারান্দায় এলে আমাদের সঙ্গে তাঁর দেখা হলো। তাঁর কথায় বুঝতে পারলাম সে রাতের টেলিভিশন সংবাদ দেখে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাদের বললেন, ‘তোরাই আমার হীরা, চুনি, পান্না।’ ইংরেজিতে আরও বলেন, ‘কন্টিিনউ িদস স্ট্রাগল ইভেন ইফ আই অ্যাম নট দেয়ার।’ এরপরে তিনি বললেন, ‘আমি ইউডিআই করে দিলাম।’ বারান্দায় পায়চারি করতে করতে বঙ্গবন্ধু এসব কথা বলে আবার ঘরের ভেতর চলে গেলেন।

ইউডিআই মানে হলো ইউনিল্যাটারাল িডক্লারেশন অব ইন্ডিপেনডেন্স। আমরা এ কথা শুনে চমকে উঠলাম। মনে হলো আগামীকাল এ ঘোষণা প্রকাশিত হলে সামরিক বাহিনী ঢাকা শহরে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে। দারুণ দুশ্চিন্তা নিয়ে আমরা সবাই বাড়ি ফিরলাম। ৩ মার্চের সেই রাতে অসহযোগ আন্দোলনের নির্দেশাবলি ঘোষণা করা হলো। তবে আনুষ্ঠানিক কোনো স্বাধীনতা ঘোষণা সেদিন দেওয়া হয়নি। প্রতিদিন মিছিল বের হচ্ছে—বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গিয়ে তা শেষ হচ্ছে। গোটা বাংলাদেশ তখন পরিচালিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।

এরপর এলো ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পাকিস্তান টেলিভিশন থেকে আমরা সেদিন এসব খবর, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সবকিছুর পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রচার করেছিলাম সরকারি নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে। সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে কর্তৃপক্ষ ২৫ মার্চ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সাহস পায়নি।

মার্চ মাসের ২১ বা ২২ তারিখে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ বেইলি রোডে তখনকার প্রেসিডেন্ট হাউসে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে তাঁর বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়ির সামনে তাঁর টয়োটা গাড়ি থেকে আমার নাম ধরে ডেকে ভেতরে আসতে বললেন। বাড়ির ভেতরে তখন সাংবাদিক-ফটোগ্রাফারদের ভিড়। সবাই জানতে চাইছেন, আলোচনায় কী হলো, নতুন কোনো খবর আছে কি না। দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার ফটোগ্রাফার গোলাম মওলা তখন সামনে থেকে ফটো তুলছিল। বঙ্গবন্ধু আমাকে পাশে টেনে নিয়ে মওলাকে বললেন, ‘এবার ওর সঙ্গে ছবি তোলো।’ বঙ্গবন্ধুর মাথায় যখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ চিন্তা সেই সময় আমার সঙ্গে তাঁর ছ‌বি তোলার এই ঘটনা, আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের আর গর্বের ব্যাপার—যা আমার মনে থাকবে চিরকাল। মার্চের ঐতিহাসিক দিনগুলোয় সরকারি নির্দেশ-নিয়ম অমান্য করে, ঢাকা টেলিভিশন থেকে যেভাবে আমরা সংবাদ পরিবেশন করেছিলাম, বঙ্গবন্ধু তাতে যে কত খুশি হয়েছিলেন এ থেকেই তা বোঝা যায়। টেলিভিশন সংবাদ বিভাগের সব কর্মী সেই সময় এ ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।

এরপর এলো ২৫ মার্চ। সে রাতে সংবাদ উপস্থাপনের আগে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে একটা থমথমে ভাব লক্ষ করেছিলাম। আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে, শান্তিপূর্ণ সমাধানের আর কোনো পথ নেই, অশুভ কিছু ঘটতে যাচ্ছে—এই রকমই মনে হচ্ছিল সেই সন্ধ্যায়। ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো ঢাকা ত্যাগ
করেছে শোনা যাচ্ছে, বিপজ্জনক কিছু একটা হবে এমন আশঙ্কা নিয়ে সেখান থেকে টেলিভিশন স্টুডিওতে গিয়ে সংবাদ উপস্থাপন করে বাড়ি ফিরলাম।

তার পরের ইতিহাস সবারই জানা। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর, লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭২–এর ১০ জানুয়ারি একটি বিশেষ বিমানে ঢাকায় ফিরলেন, সে দিনটি ছিল একটি ঐতিহাসিক দিন। সেই দিন ঢাকা টেলিভিশনের জন্য বিমানবন্দর থেকে ধারা-বর্ণনা করতে গিয়ে দেখেছিলাম, এক বিরাট জনসমুদ্র বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ একনজর তাঁকে দেখার জন্য উপস্থিত হয়েছে বিমানবন্দরে, পথে-ঘাটে, বাড়ির ছাদে—সবখানে। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু সেদিন গিয়েছিলেন রেসকোর্স ময়দানে বিরাট জনসভায় ভাষণ দিতে। ধারা বর্ণনা অব্যাহত রাখার জন্য বিমানবন্দর থেকে সেদিন একটি হেলিকপ্টারে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রেসকোর্স ময়দানে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল, আমি ভেবে পাই না। সেই ঐতিহাসিক দিনগুলোর কথা আমি কোনো দিন ভুলব না।

ইকবাল বাহার চৌধুরী: ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান