বঙ্গবন্ধু: সিডনি শ্যানবার্গের চোখে

বঙ্গবন্ধু–স্বাক্ষরিত ছবিতে তাঁর সঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গ। ছবি: সংগৃহীত
বঙ্গবন্ধু–স্বাক্ষরিত ছবিতে তাঁর সঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গ। ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি আমার সঙ্গে সিডনি শ্যানবার্গের প্রথম সাক্ষাৎ। ১৯৭১ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের জন্য তাঁর পাঠানো রিপোর্টের ভিত্তিতে একটি বই ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সে বইয়ের কপি দেওয়ার জন্য তাঁকে একটি রেস্তোরাঁয় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। মিড-ম্যানহাটনে, তাঁর ও আমার কর্মস্থলের কাছাকাছি।

২৫ মার্চ, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ যে রাতে শুরু হয়, শ্যানবার্গ সেদিন ঢাকায়। পরদিন অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁকেও বহিষ্কার করা হয়েছিল। কলকাতায় পৌঁছে প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হলো বাংলাদেশে গণহত্যা শুরুর প্রথম প্রামাণিক বিবরণ টাইমস–এর জন্য পাঠানো। একাত্তরজুড়েই তিনি কখনো দিল্লি, কখনো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে সে গণহত্যার অসংখ্য প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। সাহিত্যপ্রকাশ থেকে বেরোনো সেসব প্রতিবেদনের নির্বাচিত সংকলন একাত্তরের একটি মূল্যবান দলিল।

শ্যানবার্গ সেদিন একাত্তরের অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। সে আড্ডার প্রায় শেষদিকে শ্যানবার্গকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাংলাদেশের কোন স্মৃতিটি তাঁর মনে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সামান্যমাত্র বিলম্ব না করে বললেন, শেখ মুজিব। প্রশ্ন করেছিলাম, কেন? উত্তরে শ্যানবার্গ বলেছিলেন, কারণ তাঁর ভেতর আমি পুরো বাংলাদেশকেই দেখেছিলাম।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই শ্যানবার্গ দিল্লি ছেড়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাঁর পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাংকক চলে আসেন। ফলে নবগঠিত দেশটির সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি জানতেন না ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু একা নন, সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন। আমার কাছ থেকে সে কথা জানতে পেরে স্তব্ধ হয়ে গেলেন, যেন বজ্রাঘাতে বিদ্ধ হয়েছেন। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এল। জানালার বাইরের অনির্দিষ্টভাবে তাকিয়ে বললেন, ১৯৭২-এ, বঙ্গবন্ধু যেদিন ভারতের রাজধানী হয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন, সেদিন দিল্লি বিমানবন্দরে তাঁর সঙ্গে দেখা। মুক্তিযুদ্ধের আগে ঢাকায় বহুবার দেখা হয়েছে, একান্তে কথা হয়েছে। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের জন্য নির্ধারিত স্থানে অন্যদের সঙ্গে তিনিও দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। দূর থেকেই বঙ্গবন্ধু চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে শ্যানবার্গ, তুমি? প্রটোকল উপেক্ষা করে তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন, দুই হাতে জড়িয়ে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। যেন পুরোনো এক বন্ধু, অনেক দিন পর দেখা হয়েছে।

দুই

১৯৭১–এর ফেব্রুয়ারি-মার্চে ঢাকায় রাজনৈতিক পারদ যখন ক্রমেই চড়ছে, তখন থেকেই শ্যানবার্গ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখছিলেন। পাকিস্তান সামরিক শাসক ইয়াহিয়া ও পিপলস পার্টির ভুট্টোর সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে যে লোকদেখানো আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিলেন, তার পুরোটাই তিনি টাইমসের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর পাঠকদের জানাচ্ছিলেন। এই সময়েই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় পেশাদারত্ব অতিক্রম করে ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গতায় পরিণত হয়।

২৫ মার্চের পর ঢাকা ত্যাগে বাধ্য হলেও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম তিনি অনুসরণ করেছেন, পাকিস্তান জেলে বঙ্গবন্ধুর অন্তরীণাবস্থাও ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এই সময় তাঁর অধিকাংশ প্রতিবেদনই দিল্লি থেকে পাঠানো। জুন-জুলাই মাসে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের তত্ত্বাবধানে একদল বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে তিনি ঢাকা ও ফরিদপুর সফরের সুযোগ পান। যা তাঁদের দেখানো হলো সবই সাজানো, সেনা কমান্ডের ‘গাইডেড ট্যুর’ ভিন্ন অন্য কিছু নয়, অভিজ্ঞ সাংবাদিক শ্যানবার্গের তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। অক্টোবর মাসে, যখন মুক্তিবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে হটতে শুরু করেছে, সে সময় শ্যানবার্গ একাধিক মুক্তাঞ্চল সফর করেন। ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে তিনি বাংলাদেশের নিকটবর্তী হওয়ার লক্ষ্যে কলকাতা চলে আসেন।

৬ ডিসেম্বর ভারত যুদ্ধরত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানালে যে দীর্ঘ প্রতিবেদনটি তিনি প্রেরণ করেন তাতে বাঙালিদের উল্লাসের খবর থাকলেও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি যে শূন্যতার সৃষ্টি করেছে সে কথাই বড় করে জানালেন। ৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত সে প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘বাঙালিরা আনন্দিত, কিন্তু তাঁদের নেতা এখনো অনুপস্থিত’।

কলকাতায় অবস্থানরত পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতাদের সদর দপ্তরে সবাই আজ আনন্দিত, সেখানে উল্লাস হচ্ছে, গান শোনা যাচ্ছে। তবে যে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট সরকার এই আন্দোলনের নেতৃত্বে, তাঁদের কোথাও নজরে পড়ল না। তাঁরা অপেক্ষায় আছেন সেই মানুষটির, যিনি পাকিস্তান জেলে কারাবন্দী হয়ে আছেন।

সেই লোকটির নাম শেখ মুজিবুর রহমান, সবাই এ ব্যাপারে একমত, একমাত্র তিনিই পারেন বাংলাদেশ নামক দেশটিতে তাঁর অনুসারীদের গঠনমূলকভাবে নেতৃত্ব দিতে। শেখ মুজিব যদি ভারত-পাকিস্তানের চলতি যুদ্ধ শেষে জীবিত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পারেন, তাহলে দারিদ্র্য, পশ্চাৎমুখিনতা ও অবজ্ঞার নিগড় থেকে দেশটিকে তিনিই মুক্ত করতে সক্ষম হবেন। বর্তমানে তিনি পাকিস্তানে বিচারাধীন রয়েছেন, এই বিচারে যদি তাঁর ফাঁসি হয়, তাহলে যাঁরা বর্তমানে বাংলাদেশের নেতৃত্বে রয়েছেন, তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক জটিলতায় একদম অসহায় হয়ে পড়বেন। তাঁদের কারোরই তেমন কোনো রাজনৈতিক প্রভাব নেই, শেখ মুজিবের কারাবাসের আগে তাঁরা কার্যত অপরিচিত ছিলেন। তাঁরা বরাবর সংবাদ সম্মেলনে মুজিবের পাশে বসে থেকেছেন, মুখে একটা কথাও বলেননি।

শ্যানবার্গ ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মুক্ত বাংলাদেশে প্রবেশ করেন, সে সময় খুলনাসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন শহর ও গ্রাম ঘুরে দেখার সুযোগ তাঁর হয়। তিনিই প্রথম বিদেশি সাংবাদিক যিনি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর সম্মুখ সমর প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। পাকিস্তান বাহিনীর হত্যাযজ্ঞও সরেজমিনে দেখে তাঁর প্রামাণিক প্রতিবেদন পাঠকদের জন্য নিয়মিত পাঠিয়েছেন। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের ঘটনাও তিনি সম্মুখসারিতে বসে দেখার সুযোগ পান।

দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু জাতির জনক স্বদেশে ফিরছেন না, পাকিস্তানি কারাগারে আটক রয়েছেন, এই দুর্ভাবনা তখন সারা বাংলাদেশে। তিনি জীবিত অথবা মৃত, খবরটিও নিশ্চিতভাবে জানা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে পাকিস্তানে ক্ষমতার পালাবদল হয়, ইয়াহিয়া খানের জায়গায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দাবি করলেন অবিলম্বে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে। তাঁর হাতে তখন তুরুপের তাস প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনা, যারা বাংলাদেশ যুদ্ধে পরাজয়ের পর যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ইন্দিরা জানালেন, মুজিবকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত এই পাকসেনাদের প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে কোনো আলোচনা হবে না। বিপাকে পড়লেন ভুট্টো, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্মত হলেন বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে। জাতির জনক মুক্তি পেয়ে লন্ডনে আসছেন, সেখান থেকে ঢাকা। সারা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল, যার সাক্ষী ছিলেন শ্যানবার্গ। ৯ জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে তিনি লিখলেন: সমস্যা আছে, অনিশ্চয়তা আছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শিগগিরই ফিরবেন, এই সম্ভাবনায় সারা দেশ মুখরিত। সে প্রতিবেদনের শিরোনামই ছিল, ‘জয় ইন ঢাকা’।

সোমবার ঢাকার রাস্তায় দেখা গেল হাজার হাজার উল্লাসমুখর বাঙালি, তারা সোল্লাসে গান গাইছে, চিৎকার করছে, কেউবা আকাশে গুলি ছুড়ছে। তারা শুনেছে নয় মাস কারাবাসের পর তাদের নেতা শেখ মুজিব পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। আজ অথবা আগামীকাল তিনি যখন সত্যি সত্যি দেশে ফিরে আসবেন, মানুষের উল্লাস বহুগুণে বেড়ে যাবে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে মুজিব শুধু একজন নায়কোচিত পুরুষ নন, তিনি একজন দেবতা-প্রায় মানুষ। কিন্তু তাঁর প্রতি এই মনোভাবের অর্থই হলো, মানুষটির কাছ থেকে দেশের মানুষের প্রত্যাশাও বিপুল।

১০ জানুয়ারি দিল্লি হয়ে ঢাকা ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। ১১ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে শ্যানবার্গ বঙ্গবন্ধুর দিল্লি যাত্রাবিরতির বিবরণ দিয়েছেন। এই ঘটনার কথাই তিনি আমাকে নিউইয়র্কে আবেগাপ্লুত হয়ে বর্ণনা করেছিলেন। পেশাদার সাংবাদিক, নিজের পাঠানো প্রতিবেদনে অবশ্য আবেগের লেশমাত্র নেই। তবুও এই লোকটি, যার প্রত্যাবর্তনের জন্য একটি দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, তাঁর প্রতি উষ্ণতার কোনো কমতি সেখানেও ছিল না।

১৫০ সেনার এক গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর শেখ মুজিব পাঁচ মিনিটের এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে ভারতের জনগণ ও তার অসাধারণ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ভারতের সাহায্যের ফলেই অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিত্ব থেকে মুক্তি, নৈরাশ্য থেকে আশার আলোয় আসা সম্ভব হয়েছে।

এক সপ্তাহ পর ১৬ জানুয়ারি ঢাকায় শ্যানবার্গের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হলো বঙ্গবন্ধুর। তাঁকে সবিস্তারে জানালেন ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তাঁর গ্রেপ্তারের বিবরণ। বঙ্গবন্ধু কেন আত্মসমর্পণ করেছিলেন, এ নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক আছে, অথচ অনেক প্রশ্নের উত্তর কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজেই শ্যানবার্গের কাছে দেওয়া তাঁর সেই সাক্ষাৎকারে দিয়ে গেছেন। ১৮ জানুয়ারি টাইমসের প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল, তিনি নিজের গ্রেপ্তার ও বন্দিত্বের পূর্ণ বিবরণ দিলেন।

ক্রন্দনরত স্ত্রী ও সন্তানদের শেষবারের মতো তিনি বিদায় জানালেন, হয়তো আর ফিরে আসবেন না, এ কথা তাঁর মতো নিজের স্বজনদেরও অজ্ঞাত ছিল না। এরপর পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে জোর করে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনল, পেছন দিয়ে বন্দুকের বাট দিয়ে বার কয়েক গুঁতোও দেওয়া হলো তাঁকে। জিপের কাছে পৌঁছে, অভ্যাসবশত হোক আর সেনা নেতৃত্বের প্রতি অবজ্ঞায়, তিনি বলে উঠলেন, ‘দাঁড়াও, আমার পাইপ আর তামাক আনতে ভুলে গেছি। ওই দুটি ছাড়া আমি যাব না।’

সেনারা হকচকিয়ে গেলেও তাঁকে ফের নিজের ঘরে ফিরিয়ে আনল, সেখানে স্ত্রী তাঁকে পরিচিত পাইপ ও তামাকের কৌটা তুলে দিলেন। তারপর তাঁকে জিপে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে তাঁকে এরপর সাড়ে নয় মাস কাটাতে হয় পাকিস্তানের কারাগারে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কয়েকজন আমেরিকান সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল দুর্ভাবনাবিহীন, মনে যেন বিন্দুমাত্র তিক্ততা নেই। অনর্গল ইংরেজিতে তিনি কথা বলছিলেন, নিজের সৌভাগ্যে কখনো কখনো নিজেই হাসছিলেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান, যিনি তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিলেন, এটি তাঁর একসময়ের সরকারি বাসভবন। সেই জেনারেল এখন নিজেই পাকিস্তানে কারাবন্দী।

২৫ মার্চের রাতের ঘটনা থেকেই গল্পটি শুরু করলেন শেখ মুজিব। আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে তিনি, সামনের কফি টেবিলে তাঁর পাইপ ও তামাকের কৌটা।

তিনি বললেন, তাঁকে হত্যা করে বাঙালিদের ওপর দোষ চাপানোর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, সে কথা তিনি আগেই জানতে পেরেছিলেন। ‘ওদের পরিকল্পনা ছিল, আমি (পালানোর জন্য) যেই ঘর থেকে বেরোব, অমনি পেছন থেকে আমার গাড়িতে গ্রেনেড ছুড়ে হত্যা করে বলবে এটা ‘এক্সট্রিমিস্ট’দের (অর্থাৎ অতি বামপন্থীদের) কাজ। আর সেজন্যই পাকিস্তান বাহিনীকে আমার জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। আমি ঠিক করেছিলাম আমার নিজের বাড়িতে থাকব, যদি হত্যা করে তো আমার বাড়িতেই তা করতে হবে। তাহলে সবাই জানবে আমাকে হত্যা করা হয়েছে, আর আমার রক্তে শুদ্ধ হবে আমার জনগণ।’

 ২৫ মার্চ রাতে যে পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ করবে, এমন কথা আগেই জানা গিয়েছিল। মুজিব আগেভাগেই তাঁর বড় ছেলে কামাল ও দুই কন্যাকে লুকিয়ে থাকার জন্য অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ধানমন্ডির সেই দোতলা বাড়িতে তাঁর সঙ্গে রয়ে গেলেন স্ত্রী ও কনিষ্ঠ পুত্র রাসেল।

যে কথা তিনি জানতেন না তা হলো তাঁদের মেজো ছেলে জামাল তখনো সেই বাড়িতে, নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছিল।

রাত ১০টা নাগাদ মুজিব জানতে পারলেন আক্রমণ হানার জন্য পাকিস্তান সেনারা অবস্থান গ্রহণ করেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেনারা তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলল, ধারেকাছে কোথাও মর্টার ফাটার আওয়াজ কানে এল। এমন আক্রমণের আশঙ্কা জেনে তিনি আগে থেকেই কিছু গোপন প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। রাত সাড়ে ১০টায় তিনি চট্টগ্রামে এক গোপন আস্তানায় ফোন করে জনগণের জন্য তাঁর শেষ বার্তা মুখে মুখে জানালেন। পরে এক গোপন ট্রান্সমিটারে সে বার্তা প্রচার করা হয়।

বেতারে প্রচারিত তাঁর সে বার্তার মোদ্দা কথা ছিল, তাদের নেতার ভাগ্যে যা–ই থাকুক, দেশের মানুষ যেন সেনা আক্রমণ প্রতিরোধ করে, যুদ্ধ চালিয়ে যায়। সে সময় সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার কথা তিনি বললেন। এই বার্তা প্রেরণের পর মুজিব তাঁকে পাহারারত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।

সারা শহরে পাকিস্তানি আক্রমণ শুরু হলো রাত ১১টার দিকে। দ্রুত বাড়তে লাগল তার তীব্রতা। মধ্যরাত ও একটার দিকে শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে গোলা ছোড়া শুরু হলো। তিনি স্ত্রী ও দুই পুত্রকে দোতলার কাপড় বদলের ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন, সবাই মাথা নিচু করে মেঝেতে বসে পড়লেন। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল গোলা।

কিছু সময়ের মধ্যেই সেনারা তাঁর বাসায় জোর করে ঢুকে পড়ল। পালাতে অস্বীকার করে এমন একজন দ্বাররক্ষীকে তারা গুলি করে হত্যা করে। দ্রুত ওপরে উঠে দরোজায় ধাক্কা লাগাল তারা। দরোজা খুলে সেনাদের মুখোমুখি হলেন মুজিব, তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, থামো, গুলি করা থামাও। গুলি করছ কেন? আমাকে যদি গুলি করতে চাও, তো চালাও গুলি। আমি তো তোমাদের সামনেই আছি, আমার মানুষ, আমার ছেলেমেয়েদের ওপর গুলি ছুড়ছ কেন?

আরও একঝাঁক গুলি বর্ষণের পর একজন মেজর সেনাদের গুলি করা বন্ধের নির্দেশ দিলেন। মুজিবকে তিনি বললেন, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। মুজিবের অনুরোধে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিদায় জানাতে তাঁকে কয়েক মুহুর্তের অনুমতি দেওয়া হলো। পরিবারের সবাইকে চুম্বন শেষে তিনি জানালেন, ওরা আমাকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু জানবে একদিন আমার মানুষ মুক্ত হবে, আমার আত্মা তাই দেখে শান্তি পাবে।

তাঁকে জাতীয় পরিষদ ভবনে আনার পর বসার জন্য একটি চেয়ার দেওয়া হলো। ‘তারপর তারা আমাকে চা খেতে অনুরোধ করল’, ঠাট্টার সুরে তিনি বললেন। ‘চমৎকার, এখনই তো চা খাওয়ার সেরা সময়।’

এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো সামরিক ছাউনির এক স্কুলের নোংরা ও অন্ধকার ঘরে। এরপর ছয় দিন তিনি সেই ঘরে কাটালেন। আর মধ্যরাত থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত তাঁকে থাকতে দেওয়া হলো জেনারেল টিক্কা খানের একটি ঘরে। হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা ও নির্যাতনে নেতৃত্ব দেন এই সেনা অফিসার।

মুজিব জানালেন, ১ এপ্রিল তাঁকে বিমানে করে নিয়ে আসা হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। তারপর তাঁকে সরিয়ে আনা হয় মিয়ানওয়ালির কারাগারে, থাকতে দেওয়া হয় ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত সেলে। পরবর্তী সময় (মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত) তাঁকে এইখানে এবং পাঞ্জাবের উত্তরে লায়ালপুর ও শাহিওয়ালের দুটি কারাগারে অন্তরীণাবস্থায় কাটাতে হয়। এই সময় পাকিস্তান সামরিক সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। এই ১২ অভিযোগের ছয়টির দণ্ড ছিল মৃত্যু। এই অভিযোগের একটি ছিল ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা’।

শেখ মুজিব, যিনি নিজে একজন আইনজীবী, জানতেন মুক্তি পাওয়ার কোনো সুযোগ তাঁর নেই, তাঁর চেষ্টা হলো কী করে কালক্ষেপণ করা যায়। মুচকি হেসে তিনি বললেন, ‘আমিও কিছু বাড়তি সময় পাওয়ার জন্য তাদের সঙ্গে এক খেলা খেলছিলাম।’

প্রথমে তিনি দাবি করলেন পাকিস্তানের সবচেয়ে বিখ্যাত আইনজীবী এ কে ব্রোহিকে দিতে হবে তাঁর পক্ষে ওকালতির জন্য। অনেক দর–কষাকষির পর ব্রোহিকে তাঁর পক্ষে ওকালতির অনুমতি দেওয়া হলো, তিনিও এ কাজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করলেন। কয়েক মাস পর লায়ালপুরে তাঁর বিচার শুরু হলো। সে সময় মুজিব মত পরিবর্তন করে ঘোষণা করলেন, তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চান না, ব্রোহি সাহেব ঘরে ফিরে যেতে পারেন।

তাঁর কথার উত্তরে এক সামরিক নির্দেশ জারি করে ইয়াহিয়া খান জানালেন, শেখ মুজিব চান বা না চান তাঁকে একজন আইনজীবীর সাহায্য নিতেই হবে। ‘তারা যে আমার (আত্মপক্ষ সমর্থনের আইনগত) অধিকার সংরক্ষণ করে, আমার ফাঁসির আগে এই মর্মে একটি সার্টিফিকেট তাদের দরকার ছিল।’

এই বিচার শেষ ৪ ডিসেম্বর। এর একদিন আগে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়েছে যা শেষ হলো ভারতীয় বাহিনীর বিজয় ও বাংলাদেশ নামক দেশের স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে। ‘ইয়াহিয়া সেনা কর্তাদের রাওয়ালপিন্ডি ডেকে পাঠিয়ে গুলি করে আমার হত্যার দ্রুত প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন, কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় এই নিয়ে তাঁকে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হলো।’

যুদ্ধের মাঝখানে (তাঁকে হত্যার) এমন এক রায় খুবই হাস্যকর দেখাত, তাই সে রায় কখনোই ঘোষিত হয়নি। ৭ ডিসেম্বর মুজিবকে মিয়ানওয়ালিতে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৫ ডিসেম্বর, ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের একদিন আগে, শেখ মুজিবকে হত্যার জন্য ইয়াহিয়ার যে পরিকল্পনা তা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরদিন সকালেই মুজিব সে খবর জানতে পেলেন।

মিয়ানওয়ালি জেনারেল এ কে নিয়াজির নিজস্ব জেলা। জেনারেল টিক্কা খানের জায়গায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। এই জেলখানার সব মানুষই মিয়ানওয়ালির মানুষ। ১৫ ডিসেম্বর তাদের জানানো হলো নিয়াজিকে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা হত্যা করেছে, তার প্রতিশোধ হিসেবে পরদিন সকালেই মুজিবকে হত্যা করা হবে। সে প্রস্তাবে সবাই এককথায় রাজি, মুজিব বললেন।

মুজিব জানালেন, পরদিন ভোররাত চারটার সময়, তাঁকে হত্যার জন্য নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা আগে, জেলের সুপার যে তাঁর প্রতি সদয় ভাবাপন্ন ছিলেন, জেলখানায় তাঁর সেলের দরজা খুলে ঢুকলেন। ‘আমাকে কি ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?’ মুজিব জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি আগেই দেখেছিলেন তাঁর সেলের বাইরে কবর খোঁড়া হয়েছে। বলা হয়েছিল তাঁর নিরাপত্তার জন্য পরিখা হিসেবে এটা খনন করা হয়েছে। জেল সুপার উত্তেজিত হয়ে জানালেন, না, তাঁকে ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। মুজিবের তবুও সন্দেহ যায় না। ‘আমি তাঁকে বললাম, যদি ফাঁসিই দেওয়া হয়, তাহলে আমাকে প্রার্থনার জন্য কয়েক মিনিট সময় দিন।’

 ‘না না, একদম সময় নেই।’ সুপার জানালেন। ‘একদম সময় নেই, আপনাকে এখনই আমার সঙ্গে আসতে হবে, জলদি।’

জেলখানা থেকে সরে যাওয়ার সময় সুপার পুরো ষড়যন্ত্রটা ভেঙে বললেন। তিনি মুজিবকে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন, সেখানে দুই দিনের জন্য তাঁকে রেখে দিলেন। তত দিনে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পথে, চারদিকে ভীষণ ঘোলাটে অবস্থা। ১৮ ডিসেম্বর সুপার মুজিবকে জানালেন, তাঁকে ফাঁসি দেওয়ার কথা জানার পর তিনি নিজেই ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।

জেল সুপার, যিনি ওই জেলার পুলিশ সুপারও ছিলেন, এরপর বাঙালিদের নেতাকে কয়েক মাইল দূরে এক অজ্ঞাতস্থানে কয়েক দিনের জন্য সরিয়ে নেন। সেখানে তিনি নয় দিনের মতো কাটান। জেলের কর্মকর্তারা সুপারকে মুজিবের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছু জানেন না বলে তাঁদের জানান। এরপর একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার সেই সুপারকে জানান, মুজিবকে লুকিয়ে রাখার আর প্রয়োজন নেই, জুলফিকার আলী ভুট্টো যিনি ১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেছেন, তিনি মুজিবের সঙ্গে কথা বলতে চান।

গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসার পর মুজিবকে রাওয়ালপিন্ডিতে বিমানযোগে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে রাষ্ট্রপতির ভবনে তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়। এর দিন কয়েক পরে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন ভুট্টো। মুজিব (আমাদের) জানালেন, ভুট্টোকে দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আপনি এখানে কী করছেন? ভুট্টো পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেছেন এ কথা তিনি জানতেন, কিন্তু এই নিয়ে ভুট্টোর সঙ্গে একটু রগড় করছিলেন মাত্র।

ভুট্টো মুজিবকে জানালেন, ‘আমি এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসক।’ সে কথায় মুজিবের মন্তব্য ছিল, খুবই চমৎকার অবস্থা!

মুজিব সাংবাদিকদের জানালেন, ভুট্টো তাঁকে বলেছিলেন ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে ইয়াহিয়া জানান, তাঁর একমাত্র দুঃখ এই কারণে যে তিনি মুজিবকে হত্যা করতে পারেননি। তিনি ভুট্টোকে বলেন, এই কাজটা (অর্থাৎ মুজিবকে হত্যা) তিনি যেন শেষ করেন। যাতে মনে হয় তাঁর সময়েই ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, সে জন্য কাগজপত্র পূর্বের তারিখে স্বাক্ষর করার প্রস্তাব পর্যন্ত করেন ইয়াহিয়া, ভুট্টো জানালেন। কিন্তু তিনি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

মুজিব জানালেন, ভুট্টো যে কারণে তাঁকে ফাঁসি দিতে অস্বীকার করেন তা ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। ভুট্টোর মনে হয়েছিল, মুজিবকে হত্যা করা হলে বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা করা হতে পারে। এ কাজের জন্য সবাই তাঁকে অর্থাৎ ভুট্টোকেই দায়ী করবে।

মুজিব জানালেন, ভুট্টো তাঁকে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে কোনো রকম একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য জোরাজুরি করেন। ‘আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি মুক্ত না এখনো বন্দী? আমি যদি মুক্ত হই তাহলে আমাকে যেতে দিন। আর যদি এখনো বন্দী হই তাহলে (এ নিয়ে) আমি কোনো কথা বলতে প্রস্তুত নই।’

ভুট্টো তাঁকে জানালেন তিনি মুক্ত, তবে যেতে দেওয়ার আগে তাঁর আরও দিন কয়েক লাগবে। মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও মুজিব সে সময় ভুট্টোর সঙ্গে অর্থপূর্ণ কোনো বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেননি বলে সাংবাদিকদের জানান।

একপর্যায়ে ভুট্টো দাবি করেন, পাকিস্তানের দুই অংশ তখন পর্যন্ত আইনের চোখে একই রাষ্ট্রের অন্তর্গত। সে কথার জবাবে মুজিব তাঁকে মনে করিয়ে দেন, বিগত নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগুরু দল হিসেবে জয়ী হয়েছিল, কিন্তু সে ফলাফল মানা হয়নি।

 ‘পাকিস্তান যদি এখনো অবিভক্ত দেশ হয় তাহলে আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসক নন, আমি।’

 ৭ জানুয়ারি ভুট্টো তৃতীয় ও শেষবারের মতো মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। মুজিব তাঁকে জানালেন, ‘আজ রাতেই আমাকে মুক্তি দিতে হবে, এ নিয়ে অযথা বিলম্বের আর সময় নেই। হয় আমাকে মুক্তি দিন অথবা মেরে ফেলুন।’

ভুট্টো তাঁকে বলেন এত দ্রুত সব আয়োজন করে ওঠা কঠিন। তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে লন্ডনে বিমানে পাঠাতে সম্মত হলেন। বিদায়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভুট্টো মুজিবকে অনুনয়–বিনয় করছিলেন যাতে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো রকম একটা রাজনৈতিক সম্পর্ক ধরে রাখা যায়।

২৩ জানুয়ারি ঢাকায় ফের বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ হলো শ্যানবার্গের। তিনি একা নন, আরও কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় যোগ দিতে। দেখা হলো, কথা হলো ধানমন্ডির বাসভবনে। দুই সপ্তাহ হয়নি দেশে ফিরেছেন, জানার চেষ্টা করছেন সমস্যার গভীরতা, চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার পথ খুঁজছেন। আশাবাদী মানুষ তিনি আজীবন, কিন্তু তিনিও চোখে আঁধার দেখছেন। কণ্ঠে কিছুটা অনিশ্চয়তাও।

 ‘দেশ স্বাধীন করবে একজন, আর তাকে গড়বে অন্যজন, এটাই হয়তো নিয়ম,’ বললেন বঙ্গবন্ধু। হতে পারে শেখ মুজিব প্রশাসক হিসেবে নিজের দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছিলেন। হতে পারে তিনি হয়তো ভেবেছিলেন বেঁচে ফিরে আসা হবে না তাঁর। তা কারণ যেটাই হোক, শেখ মুজিবের পক্ষে এখন এমন দার্শনিক ভাবনা মাথায় আনা শৌখিনতা বই অন্য কিছু নয়। এখন তাঁকে একই সঙ্গে স্বাধীনতার জনক ও দেশ গঠনকারীর ভূমিকা নিতে হবে।

তিনি ছাড়া আর কেউ নেই যে দেশটিকে তার অর্থনৈতিক পশ্চাৎমুখিনতা ও পাকিস্তান বাহিনীর ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ কাটিয়ে উঠে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে পারে। শেখ মুজিব, যার বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে কখনোই কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, তিনি এখন প্রশাসক হিসেবেও প্রশংসা পাচ্ছেন।

১০ জানুয়ারি, পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরার পর থেকে তিনি দেশের পূর্ণ শাসনভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। জাতির পিতার মতো প্রতীকী ভূমিকার বদলে তিনি নিজেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন, তাজউদ্দীনকে কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিসভার একটি আসন দেওয়া হয়েছে।

নতুন একটি দেশের নেতা হিসেবে শেখ মুজিব অস্বাভাবিক পরিশীলিত নেতৃত্বের প্রমাণ রেখেছেন। ঘৃণা প্রকাশের বদলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, যদিও ১৯৭১-এ তারা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল। বাংলাদেশের এই নেতা খুব ভালো করেই জানেন বিশ্বের অধিক গুরুত্বপূর্ণ দেশসমূহের স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ত্রাণ সাহায্য তিনি পাবেন না। পাকিস্তানের আপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধীরে ধীরে সে স্বীকৃতি পাচ্ছে, প্রথমে পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট দেশসমূহ থেকে, আর এখন পশ্চিমা দেশসমূহের কাছ থেকেও।

তবে সবচেয়ে যে দেশটির স্বীকৃতি এ দেশের মানুষ চায় তা হলো যুক্তরাষ্ট্র। সবাই মার্কিন সাহায্যের প্রত্যাশী, এ ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি একদিকে বাস্তবমুখী, অন্যদিকে বন্ধুসুলভ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু কিছু সাহায্য আসা শুরু করেছে, পাকিস্তান আমলে শুরু হওয়া কর্মসূচির অংশ হিসেবেই তা আসছে। তবে সবাই মানেন, ব্যাপক পরিমাণে বিদেশি সাহায্য না এসে পৌঁছালে কয়েক মাসের মধ্যেই খাদ্যসংকট দেখা দেবে।

শেখ মুজিবকে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যারও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। দেশের মানুষের মধ্যে একাত্তরে পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতাকারীদের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের চাপ রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে বিহারি মুসলমানরা। বিহারি ও অন্যান্য পাকিস্তানি দোসরদের অনেকেই এখন জেলে। মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকালে স্বজনদের হারিয়েছেন, তাঁরা এখনো একাত্তরের দালালদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। প্রতিশোধ গ্রহণের এই তীব্র ইচ্ছা প্রশমনের লক্ষ্যে শেখ মুজিব এই দালালদের কয়েকজনকে বিচারের সম্মুখীন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডে যুক্ত এমন মুখ্য পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের বিচারের জন্য তিনি একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কথাও বলছেন।

মুক্তিবাহিনী নিয়েও তাঁকে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই দেশ গঠনের কাজে যুক্ত হয়েছেন, তবে কেউ কেউ বেসামরিক জীবনে খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন না। এঁদের কেউ কেউ স্থানীয় মাস্তান হয়ে উঠেছেন। যেসব মুক্তিযোদ্ধা এখনো তাঁদের অস্ত্র হস্তান্তর করেননি, শেখ মুজিব আগামী ১০ দিনের মধ্যে তা হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেছেন দেশের নতুন জাতীয় মিলিশিয়ার সদস্য হিসেবে তাঁদের তিনি দেখতে চান। কিছুটা কৌশল করে বলেছেন, যারা নির্দেশ অমান্য করে অস্ত্র লুকিয়ে রাখবে, দেশের মানুষ তাদের পাকিস্তানি কোলাবরেটর ভেবে সন্দেহ করতে পারে। এই ‘গুন্ডাদের’ যথাযথ ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হবে।

শেখ মুজিবকে এখন প্রতিদিনই অসংখ্য আবেদনপত্র সামাল দিতে হচ্ছে। কেউ চাকরি খুঁজছে, কোনো নারী যে স্বামী বা পুত্র যুদ্ধে হারিয়েছে, সাহায্যের আশায় তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। এতসব ব্যস্ততার মধ্যেও ৫১ বছর বয়স্ক এই রাজনীতিক তাঁর পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজবের সময় বের করে নিচ্ছেন। গত সপ্তাহে এ রকম এক আসরে তিনি জানান, ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার সময় তিনি প্রায় মরতে বসেছিলেন। তাঁর বাড়ির দেয়াল ভেদ করে বুলেট বেরিয়ে যায়। ডিসেম্বরে যখন তিনি পাকিস্তানি জেলে, তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কিন্তু মাত্র দুই ঘণ্টা আগে কারাগারের সুপার তাঁকে গোপনে বের করে অন্যত্র লুকিয়ে রাখেন।

মৃত্যুর এই অভিজ্ঞতা মুজিব তাঁর দেশবাসীর সঙ্গে ভাগাভাগি করতে আগ্রহী। সেদিন এই প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে একান্তে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন, আর ঠিক তখনই এক পুরোনো বন্ধু এসে হাজির। মুজিব তাঁকে গভীর উষ্ণতায় জড়িয়ে বারবার বলতে থাকেন, ‘বেঁচে আছি, আমি বেঁচে আছি।’

তিনি বেঁচে আছেন সেই কারণে তাঁর সব সমস্যা ও প্রবল দারিদ্র্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুখে এই মুহূর্তে হাসি।

ঢাকায় ও বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় যে অসংখ্য বধ্যভূমি ছড়িয়ে রয়েছে, তার কয়েকটি সরেজমিনে ঘুরে দেখার সুযোগ হয় শ্যানবার্গের। ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত তাঁর এক মর্মস্পর্শী প্রতিবেদনের নাম ছিল, বাংলাদেশ এখন বিশাল এক শ্মশান। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রতিটি শহর ও গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য বধ্যভূমি, পাকিস্তানি সেনার হাতে নিহত বাঙালিদের ঢালাওভাবে সমাধিস্থ করা হয়েছে এই সব বধ্যভূমিতে। খুলনায় সেই রকম এক বধ্যভূমিতে তাঁর নজরে পড়ল মৃত মানুষের হাড়গোড়, তাদের ধর্মসম্মত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য ট্রাকে করে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। চারদিকে বেদনার চাদর বিছানো, অথচ দেশটি ঘুরে দাঁড়াবে মানুষের মনে সে বিশ্বাসও প্রবল। খুলনা শহরে শ্যানবার্গের নজরে এল কার্ডবোর্ডে লেখা একটি স্লোগান: এই শ্মশানভূমিতে আমরা গড়ব সোনার বাংলা।

মুক্তিযুদ্ধের পরপর ঢাকার বিভিন্ন বধ্যভূমি যে কজন বিদেশি সংবাদিক পরিদর্শনে আসেন, শ্যানবার্গ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি লিখেছেন, প্রতিদিনই নতুন বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হচ্ছে, শোনা যাচ্ছে নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের কথা। মিরপুর চিড়িয়াখানার এক কোনায় তাঁর নজরে পড়ে পেছনে হাতবাঁধা অবস্থায় মৃত মানুষের লাশ। মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে তাঁর মনে হলো এখানে প্রতিটি ঝোপঝাড়ে, এমনকি প্রতিটি কূপে রয়েছে মৃত মানুষের লাশ। ৬০ ফুট গভীর এক কূপে তিন দেখলেন তার প্রায় পুরোটাই মৃত মানুষের লাশে পূর্ণ।

মিরপুরের বধ্যভূমিতে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শ্যানবার্গ আমাকে সেই প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলেন। একজন দোভাষী নিয়ে তিনি ঘুরেফিরে দেখছিলেন, উদ্দেশ্য কত লোক, কীভাবে নিহত হয়েছে তার একটি তালিকা তৈরি করা। সে সময়ে তাঁর নজরে আসে ১২-১৩ বছরের একটি বালক। অপুষ্টি ও অভাবে জীর্ণ শরীর সে বালক মাটি খুঁড়ে বানানো অস্থায়ী গণকবরের চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, হাতে একটি খুলি। দেখে হঠাৎ মনে হয় বুঝি খেলা করছে। অধিকাংশ কবর সদ্য তৈরি, মাটি তখনো জমাট বাঁধেনি। মাটিতে হাত ডোবালেই বেরিয়ে আসছে সদ্যমৃত মানুষের দেহাবশেষ। প্রায় ভুতুড়ে এই জায়গায় ছেলেটি কেন, ও এমনই বা কেন করছে? দোভাষীকে প্রশ্ন করলেন শ্যানবার্গ। খোঁজ নিয়ে দোভাষী জানালেন, ছেলেটি বাবার লাশ খুঁজছে।

শ্যানবার্গ সেদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘সেই ছেলেটিকে আমি এখনো দেখতে পাই। চোখ বুজলেই তার মুখটা ভেসে ওঠে। মনে পড়ে হ্যামলেটের কথা, মনে পড়ে কবরখোদকের সঙ্গে তার কথোপকথন। কী আশ্চর্য রকম করুণ, একাকী ও অর্থহীন।’

তিন

স্বাধীনতার পরপর বঙ্গবন্ধুর জন্য একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল—একদিকে প্রাক্তন গেরিলাদের কাছ থেকে তাঁদের অস্ত্র উদ্ধার, অন্যদিকে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে অবাঙালি বা বিহারি নাগরিকদের নিরস্ত্র করা। জানুয়ারির শেষ নাগাদ ঢাকার মিরপুরে বিহারি অধ্যুষিত এলাকায় সহিংস সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে, যা শ্যানবার্গ প্রত্যক্ষ করেন। বঙ্গবন্ধু চাইছিলেন যাতে কোনোমতেই এই সহিংসতা ছড়িয়ে না পড়ে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়। ৩১ জানুয়ারি প্রকাশিত এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে শ্যানবার্গ লিখলেন, অবস্থা এখনো ঘোলাটে রয়ে গেছে।

 মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে সাংবাদিকদের যেতে দেওয়া হচ্ছে না, ফলে হতাহতের সঠিক খবর জানা সম্ভব হয়নি। তবে হাসপাতাল সূত্রে খবর নিয়ে যা জানা গেছে তাতে মনে হয় হতাহতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। শুধু নিহত হয়েছে এমন বাঙালির সংখ্যা ২০ হবে। বিহারিদের সংখ্যা জানা যায়নি। শেখ মুজিব অবাঙালিদের আজ বেলা একটার মধ্যে অস্ত্র হস্তান্তরের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। এই সব অস্ত্রের অধিকাংশই তারা বিগত নয় মাসের যুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সংগ্রহ করে। বাঙালি গেরিলাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার তারিখও আজ। এইসব গেরিলা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ও ভারতের কাছ থেকে তাঁদের অধিকাংশ অস্ত্র সংগ্রহ করেন। বাঙালি গেরিলারা তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র আংশিক জমা দিয়েছেন, তবে বিহারিরা স্বেচ্ছায় কোনো অস্ত্র জমা দেয়নি। এই সব বিহারি মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানিদের দোসর ছিল, তাঁরা উভয়ে মিলে লাখ লাখ বাঙালির স্বাধীনতা স্পৃহা রোধ করতে হত্যা করেছে। বিহারিপাড়ায় এখনো অনেক মৃত মানুষের হাড়গোড় নজরে আসে।

আজ বিকেলে ঢাকা স্টেডিয়ামে এক অস্ত্র হস্তান্তর অনুষ্ঠানে, যেখানে একটি খ্যাতনামা গেরিলা ইউনিটের সদস্যরা তাঁদের অস্ত্র জমা দেন, সেখানে শেখ মুজিব প্রায় ৪০ হাজার দর্শকের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা বিহারিদের ক্ষমা করে দিতে পারি, আমি চাই না তোমরা কেউ তাদের মেরে ফেল, যতবড় অপরাধই তারা করে থাকুক না কেন। তবে তাদের অস্ত্র জমা দিতে হবে। জমা না দিলে আমরা জোর করে সে অস্ত্র কেড়ে নেব।’ তিনি বিহারিদের উদ্দেশে বলেন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে বাংলা ভাষাটা শিখে নিন, বাঙালি হয়ে উঠুন, এখানে থাকতে শিখুন। আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।’

এর পরবর্তী সপ্তাহসমূহে শ্যানবার্গ প্রধানত দিল্লি থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন। এই পর্যায়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাষা ক্রমেই সমালোচনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি মালিকদের দেশত্যাগের পর তাঁদের ফেলে যাওয়া বিভিন্ন মিল-কারখানা সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। পশ্চিমা ত্রাণ ও অর্থনৈতিক সাহায্যের অভাবে বঙ্গবন্ধুকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় কমিউনিস্ট দেশসমূহের নিকটবর্তী হয়ে উঠতে হয়। অন্যান্য পশ্চিমা সাংবাদিকের মতো শ্যানবার্গও বাংলাদেশের এই বাম মোড় সুনজরে দেখেননি। ৩০ মার্চ ১৯৭২-এ প্রকাশিত তাঁর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘ধ্বংসের মুখে অর্থনীতি, দেশে খাদ্যসংকট।’ দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে শ্যানবার্গ এই জটিল পরিস্থিতির জন্য একদিকে যুদ্ধ–পরবর্তী অর্থনৈতিক জটিলতা, অন্যদিকে দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও সমন্বয়ের অভাবকে দায়ী করেছেন। তিনি এ কথাও বলেছেন, দেশে যে সত্যি সত্যি একটি চরম সংকটাবস্থা বিরাজ করছে, ঢাকায় বসে তা বোঝার উপায় নেই।

 ‘অত্যন্ত বিরক্ত একজন আমলা জানালেন, এটা যে যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা, ঢাকায় এসে কোনো বিদেশির পক্ষে তা বোঝা অসম্ভব। অন্যদিকে সরকারি নেতারা যথারীতি রাজনীতির ঘুঁটি চেলে যাচ্ছেন। কোনো অতিরিক্ত কর আরোপ হয়নি, কোনো বিশেষ নির্দেশও জারি হয়নি।’

এই জটিলতার মধ্যেও অধিকাংশ বাঙালির চোখে আশার আলো ছিলেন বঙ্গবন্ধু, শ্যানবার্গের সে কথা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী ও ক্ষমতাবলয়ের বাইরে থাকা রাজনীতিক সমালোচনামুখর হয়ে উঠলেও সাধারণ মানুষ তাকিয়ে ছিল বঙ্গবন্ধুর দিকে। তাঁর দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত, নানাভাবে তাঁর হাত বাঁধা এ কথা জানা সত্ত্বেও উজ্জ্বল আগামী দিনের সম্ভাবনায় আস্থা হারাননি তিনি। ৪ এপ্রিল প্রকাশিত শ্যানবার্গের এক প্রতিবেদনে এমন আত্মবিশ্বাসী বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দেখা যায়।

স্বাধীনতা চার মাস পর নবগঠিত বাংলাদেশ বিভিন্ন বিভেদাত্মক শক্তির প্রভাব কাটিয়ে স্থিতিশীলতা অর্জনে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সরকারে বিশৃঙ্খলতা রয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। আইনভঙ্গের ঘটনা বেড়ে চলেছে। ‘শত্রুদের’ বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, যদিও অনেক ক্ষেত্রে এই অভিযুক্ত শত্রুদের চাকরি পাওয়াই আসল লক্ষ্য। অর্থনীতি কার্যত স্থবির হয়ে আছে, বাড়ছে দারিদ্র্য।

অনেক অর্থেই বাংলাদেশ সরকার মানে শেখ মুজিব। বাঙালিরা সবাই আশা করে মুজিব ব্যক্তিগতভাবে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব সমস্যার সমাধান করে দেবেন। তিনি নিজেও মনে করেন কাজটি করার জন্য নিদেনপক্ষে তাঁকে চেষ্টা করতে হবে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাই তাঁকে নানা আবেদন নিয়ে ঘিরে থাকে। কোনো সরকার এভাবে চলতে পারে না, এ কথা তিনি নিজেও মানেন, কিন্তু কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। ‘আমি কী করব, এরা সবাই বিরাট সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। তারা সবাই আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। কারও স্বামী মারা গেছে, কারওবা পুত্র।’

তাঁর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপের জন্য সাধারণ মানুষের চেয়েও নিজের মন্ত্রিসভার সদস্যদের চাহিদা বেশি, প্রতিটি বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত মনোযোগ দরকার। এই চাপ শেখ মুজিবের শরীরের ওপর অনিবার্যভাবে পড়েছে। বরাবরই তাঁর জীবনীশক্তি বিপুল, অথচ এখন তাঁকে ক্লান্তি গ্রাস করেছে, চেহারায় সে ক্লান্তির ছাপ। একজন অতিথিকে তিনি সেদিন বললেন, ‘আমি ভালো নেই। অতিরিক্ত চাপ।’

চলতি পরিস্থিতিকে অনেকে ‘বিশৃঙ্খল’ হিসেবে বর্ণনা করছে। যে পাঁচ লাখ বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে রয়েছেন তাঁদের অনেকে দক্ষ সরকারি কর্মচারী, দেশটি চালানোর জন্য তাঁদের প্রয়োজন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তার রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে তাঁদের আটকে রেখেছে। এদিকে ১৯৭০–এর নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে প্রবল ঐক্য ছিল তাতেও চির ধরা শুরু করেছে। এই দল কখনো সমশ্রেণিভুক্ত মানুষের ছিল না। অনেকেই মুজিবের জনপ্রিয়তার কারণে এই দলে যুক্ত হয়েছেন, অন্যরা ভেবেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা পরিবর্তনের এটাই সেরা সুযোগ। কিন্তু ভারতের সাহায্যে দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর যে একতা তাদের যূথবদ্ধ করেছিল তা আলগা হয়ে আসছে। কেউ কেউ বামপন্থী দলের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। দলের নেতাদের মধ্যে দুর্নীতিও ব্যাপক। কেউ কেউ দিনদুপুরে ত্রাণের খাদ্য দখল করে খোলাবাজারে তা বিক্রি করছেন। মজুতদারী ও চোরাচালানেরও কমতি নেই। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে একদল বন্দরশ্রমিক এক প্রাক্তন পাকিস্তানি মালিকের কোম্পানি দখলে নিয়ে নিজেদের নামে এক সমবায় গঠন করে সরকারি অনুমোদনের আবেদন করে। তাদের লাইসেন্স না দিয়ে তা দেওয়া হয়েছে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে, যাঁর এই ব্যবসায় কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাই নেই।

তিনি অনেকের কাছে ব্যক্তিগতভাবে বলেছেন দুর্নীতিবাজ দলীয় নেতাদের বাদ দিয়ে অধিক তরুণ ও নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের ওপর দায়িত্ব অপর্ণ করবেন। দলের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে, এই বছর বা আগামী বছরের শুরুতে মুজিব নতুন নির্বাচন ডাকবেন। এর ফলে দল ও সরকার তিনি ঢেলে সাজাতে পারবেন। যেসব বামপন্থী দল, যারা একসময় তাঁকে সমর্থন করেছে, তাদেরও সন্তুষ্ট করা যাবে। এদের অনেকেরই অভিযোগ, যুদ্ধ তারাও করেছে, এই সরকারে তাদেরও স্থান হওয়া উচিত।

এই দলীয় কলহ সম্ভবত সবচেয়ে তীব্র বন্দরনগরী চট্টগ্রামে, যেখানে দলীয় নেতা থেকে শুরু করে প্যারামিলিটারি, এমনকি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারাও ক্ষমতার দাবিদার। যুদ্ধে অংশ নিয়েছে যেসব গেরিলা গ্রুপ, তারাও নানা কারণে ক্ষুব্ধ। ভারতের দেওয়া অথবা পাকিস্তানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্রের ভগ্নাংশ মাত্র তারা ফেরত দিয়েছে। কোনো কোনো মাওবাদী গ্রুপ সরকারের বিরুদ্ধে তৎপর। এই অবস্থা চলতে পারে না। মাত্র কিছুদিন আগে শেখ মুজিব বলেছেন দেশে এখন অর্থনৈতিক সংকটাবস্থা বিরাজ করছে, সবার চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা কিছুটা খাটো করতে হবে।

আপাতভাবে শেখ মুজিব খোলামেলাভাবে এসব ব্যাপারে কিছু বলেননি, কারণ তিনি কোনো গ্রুপকে বিগড়ে দেওয়ার বিপক্ষে। তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্য এখনো প্রকাশ্যে কোনো সমালোচনা শোনা যায়নি, তবে তাঁর সরকারের কোনো কোনো সদস্য, যাঁদের বিলাসবহুল গাড়িতে চলাফেরা করতে দেখা গেছে, তাঁদের ব্যাপারে সমালোচনা শোনা গেছে।

বামপন্থী সাপ্তাহিক হলিডের এক সাম্প্রতিক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব ও দক্ষতা বিষয়ে জনমনে বিপুল আস্থা রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে তাঁর প্রশাসন ও দলের কেউ কেউ অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক। খাদ্যাভাব প্রকট হয়ে উঠছে, বাড়ছে দারিদ্র্য। এই অবস্থায় মুজিবের জন্য অগ্রাধিকার হয়ে উঠেছিল যেভাবে সম্ভব খাদ্য আমদানি করে সমস্যার মোকাবিলা। এক ভারত ও পূর্ব ইউরোপীয় মিত্রদের ওপর নির্ভর করে এই বিপদ এড়ানো কঠিন, এ কথা মুজিব জানতেন। তাই পশ্চিমের সঙ্গে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে, স্বাভাবিক অবস্থা গড়ে তুলতে তিনি ব্যাগ্র হয়ে পড়েন। ৬ এপ্রিল ১৯৭২-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে শ্যানবার্গ জানিয়েছেন, আমেরিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনুপস্থিতির সুযোগে সোভিয়েতরা বাংলাদেশে আসন গেড়ে নিচ্ছে। এপ্রিলের গোড়ার দিকে চিকিৎসার জন্য শেখ মুজিব মস্কোর উদ্দেশে যাত্রা করেন, সেটিও নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর রুশ প্রভাবের প্রমাণ। তা সত্ত্বেও শেখ মুজিব কাছের বন্ধুদের জানিয়েছেন তিনি বাংলাদেশে লক্ষণীয় মার্কিন উপস্থিতি চান।

মুজিবসহ বিভিন্ন বাংলাদেশি কর্মকর্তা এ কথা পরিষ্কার করেছেন যে তাঁরা ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হতে চান না। চিকিৎসার জন্য মস্কো যাত্রার আগে শেখ মুজিব স্থানীয় মার্কিন মিশনের মাধ্যমে ওয়াশিংটনের কাছে এক আবেদনে সে কথা খোলাসা করে বলেছেন। মস্কোতে আলাপ-আলোচনার সময় তিনি নিজের জন্য দর–কষাকষির সুযোগ রাখতে চান। কিন্তু ওয়াশিংটন থেকে কোনো সদুত্তর আসেনি।

শেখ মুজিব জাতিসংঘের ত্রাণ তৎপরতার কাছে আবেদন করেছিলেন যাতে চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন সরানো কাজে তারা সাহায্য করে, কিন্তু সেখান থেকেও জবাব আসেনি। তাতে ফল দাঁড়িয়েছে যে এই কাজটিও সোভিয়েতদের হস্তগত হয়েছে।

এপ্রিলের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ঘটনাটির গুরুত্ব উল্লেখ করে একটি লম্বা প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন শ্যানবার্গ। ৯ এপ্রিল প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনেও তিনি পুনরুল্লেখ করেন মুজিবের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ ক্ষুধা ও দারিদ্র্য। এ দুই চ্যালেঞ্জ সামলাতে ব্যর্থ হলে বিপদে পড়তে পারেন শেখ মুজিব। কিন্তু এতেও সন্দেহ নেই, একমাত্র মুজিবই পারেন এই সংকট থেকে উত্তরণ।

স্বাধীনতার ফলে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হবে, এই প্রত্যাশা অনেক বাঙালিরই ছিল। কিন্তু দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে আছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ আগের চেয়েও কম, সমস্যা মোকাবিলায় সক্ষম এমন কোন সরকারি ত্রাণ কর্মসূচি নেই। ফলে সারা দেশে অসন্তোষ বাড়ছে।

সরকারের মধ্যেও বিশৃঙ্খলা রয়েছে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে কোনো কোনো রাজনীতিক নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন, কেউ কেউ পাকিস্তানি মালিকদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির দখল নিচ্ছেন। বেআইনি কার্যকলাপ বাড়ছে, মাস্তানদের খোলামেলাভাবে অস্ত্র হাতে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে।

এত জটিলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ মোটেই ‘আন্তর্জাতিক বাস্কেট কেস’ নয়, যেমন হেনরি কিসিঞ্জার ও অন্য পর্যবক্ষকেরা দূরে বসে বলেছেন। বছরে তিনটি ফসল তোলার মতো প্রযুক্তি এখন রয়েছে, এর ফলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারবে। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ আহরণ হয়নি। এই দেশের মৎস্য সম্পদেরও যথাযথ উন্নয়ন হয়নি। হাঁটতে চলতে দেশটির এখন যে ক্রাচের প্রয়োজন, পর্যাপ্ত বিদেশি সাহায্য পেলে একদিন সে ক্রাচ ছুড়ে ফেলতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ।

কিন্তু সে অবস্থা এখনো অনেক দূরে। দেশটি এখন শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতার জন্য লড়াই করছে। তবে এই দেশের মানুষ ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ কথা, যদিও সে কেবল কথার কথা।

 ‘আমরা তাদের আরও কিছু সময় দেব, তবে খুব বেশি সময় নয়,’ একজন ছাত্র জানাল।

চার

১৯৭৩ সালের গোড়ার দিকে শ্যানবার্গ দিল্লি থেকে বদলি হয়ে টাইমসের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যুরো প্রধান হয়ে ব্যাংকক চলে আসেন। এই সময় থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কার্যত ছিন্ন হয়। ভিয়েতনামে, বিশেষত কম্বোডিয়া ও লাওসে মার্কিন সামরিক তৎপরতা তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে। কম্বোডিয়ায় কমিউনিস্ট খেমার রুজ ক্ষমতা দখলের পর বিপদ জেনেও শ্যানবার্গ নমপেনে থেকে যান, খেমার নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেন। সে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ দি কিলিং ফিল্ডস। ১৯৭৬-এ শ্যানবার্গ কম্বোডিয়া ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন।

শ্যানবার্গ আমাকে বলেছিলেন, কম্বোডিয়া ফিরে আসার সময় তিনি বাংলাদেশের কথা ভেবেছেন। ‘১৯৭৬-এ নমপেন ছেড়ে আসার সময় আমার মন ত্রাস ও শঙ্কায় আচ্ছন্ন ছিল। জান নিয়ে ফেরা হবে কি না তা জানতাম না। বিমান কম্বোডিয়া ছেড়ে আসার পরও সে ভয় যায়নি। অবশেষে বিমান যখন থাইল্যান্ড অতিক্রম করে ভারত ও বাংলাদেশের আকাশে প্রবেশ করে, ভয়টা কেবল তখন কাটে। মনে হলো শত্রুপুরী ছেড়ে নিজের ঘরে ফিরছি।’

যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার পর শ্যানবার্গ কিছুদিন নিজের পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস–এ কাজ করেন, পরে মতান্তরের কারণে ভিন্ন একটি কাগজে যোগ দেন। জীবনের শেষ ১০ বছর নানা রোগশোকে ভুগেছেন তিনি। এরই মধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন, টেলিফোনে ও ই–মেইলে বার্তা বিনিময় হয়েছে। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের ওপর একটি তথ্যচিত্রের জন্য বিশেষ সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন।

তাঁর কাছ থেকে শেষ ই–মেইলটি আমি পাই ২০১২ সালের ১০ মে। তিনি লিখেছিলেন:

বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম একাত্তরের গণহত্যা ভালোভাবে প্রকাশে সক্ষম হয়নি, এ জন্য সে ঘটনা যতটা সম্ভব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ আমার নিজের দায়িত্ব বলে মনে করি। আমি শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও সাহসিকতার জন্য তাঁকে সম্মান করি। ১৯৭১-এ আমার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপরাধমূলক ব্যবহারের প্রতি যে সমর্থন দেয়, সে জন্য আমি ঘৃণাবোধ করি। তুমি হয়তো জানো, আমার ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ বিয়োন্ড দি কিলিং ফিল্ডস-এ আমি সে সময়ের ১২টি প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত করেছি।

খুব খুশি হতাম যদি এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যেত। কিন্তু এখন আমাকে অবশিষ্ট জীবন ধীরগতিতে কাটাতে হবে। আমি কখনোই বাংলাদেশে আমার অভিজ্ঞতার কথা ভুলব না, সে সময় তোমার দেশের মানুষ যে নির্যাতনের ভেতর দিয়ে গেছে, তাও কখনো ভুলব না।

৯ জুলাই ২০১৬ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সিডনি শ্যানবার্গ।