অগ্নিগর্ভ ভাষণ

শেখ মুজিব গণ-অসহযোগের ডাক দিয়ে জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জন-অসন্তোষ এতটাই ছিল যে কয়েকটি ঘটনায় পাকিস্তানি পতাকা ও জিন্নাহর প্রতিকৃতি পোড়ানো হয়। দ্রুত বাংলাদেশের একটি পতাকা—গাঢ় সবুজ জমিনে পূর্ব বাংলার মানচিত্র-সংবলিত একটি লাল বৃত্ত—হাজির করেন কিছু ছাত্র এবং কয়েকটি সভা-সমাবেশে তা ওড়ানো হয়। এটা আশ্চর্যজনক নয় যে সাধারণের এ প্রত্যাশা ছিল যে শেখ মুজিব হয়তো ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন।

এই পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবের ভাষণের সারকথা কী হবে, তা ঠিক করতে তাঁর বাড়িতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসলেন। এর প্রধান বিষয় ছিল, শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা করা উচিত কি না? ছাত্রনেতাদের পাশাপাশি বেশির ভাগ সাধারণ জনতাও দৃঢ়ভাবে এই দাবির পক্ষে ছিল। অন্যদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বিপজ্জনক পথ বেছে নেওয়ার বিপক্ষে শেখ মুজিবের ওপর চরম চাপ ছিল। স্বয়ং ইয়াহিয়া রাওয়ালপিন্ডি থেকে শেখ মুজিবকে টেলিফোন করে বেপরোয়া ঘোষণা না দিয়ে আলোচনার পথ খোলা রাখার আহ্বান জানান। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড শেখ মুজিবকে টেলিফোন করে সংযমের আহ্বান জানান। ভারত কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছিল কি না, তার কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তবে অস্থিতিশীলতা, যা গৃহযুদ্ধের রূপ নিতে পারে, তার চেয়ে তাদের আগ্রহ বরং বেশি ছিল সুশৃঙ্খলভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। কারণ, যেকোনো প্রকার অস্থিতিশীলতা ভারতের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল। সেখানে নকশালবাদী বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগ নেতারা সর্বসম্মতিক্রমে একমত হলেন যে ওই মুহূর্তে একতরফাভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়াটা হবে অপরিণামদর্শী।

রমনার রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের সামনে শেখ মুজিব বললেন, শহীদের রক্ত মাড়িয়ে ২৫ মার্চের পার্লামেন্ট অধিবেশনে যোগ দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অধিবেশনে যোগ দিতে তিনি চারটি পূর্বশর্ত দিলেন: সামরিক আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে, সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে, ধর্মঘটের সময় বলপ্রয়োগের ঘটনায় তদন্ত করতে হবে এবং জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তিনি বললেন, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চান না, তিনি চান জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক। তিনি ভাষণ শেষ করেন উত্তেজনাময় এই কথাগুলো বলে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

শেখ মুজিবের সচেতন বক্তব্য পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ব্যাপারে বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি, বিশেষ করে তাঁর নিজ দলের চরমপন্থী ছাত্রসংগঠনের। তবে তাঁর বক্তব্যের শেষাংশ, যেখানে ঊহ্য থাকল যে তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য স্বাধীনতা, তা তাদের শান্ত রাখল। শেখ মুজিবের ভাষণের পরপরই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা তাঁর পূর্বশর্তগুলোর পক্ষে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দিলেন এবং প্রেসিডেন্টের প্রতি তা মেনে নেওয়ার আহ্বান জানালেন। এমনকি মাওলানা ভাসানী, যিনি আরও কয়েকজন নেতাসহ এর আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন, পল্টন ময়দানে ৯ মার্চ এক জনসভায় ঘোষণা দেন যে শেখ মুজিবের শর্ত অনুযায়ী ২৫ মার্চের আগে সরকার কোনো পদক্ষেপ না নিলে তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলন শুরু করবেন।

রাষ্ট্রযন্ত্র সচল রাখতে আওয়ামী লীগ বেশ কয়েকটি অস্থায়ী নির্দেশনা জারি করে। এসব নির্দেশনা শুধু সাধারণ মানুষই নয়, বাঙালি সরকারি কর্মকর্তারাও মেনে নিলেন। এমনকি গভর্নর টিক্কা খান তাঁকে শপথ পড়াতে ঢাকায় হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি সিদ্দিকীকে রাজি করাতে পারলেন না। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে দৃশ্যত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সমান্তরাল সরকার পরিচালিত হচ্ছিল। এটা এতটাই সফল ছিল যে ওয়ালি খানের পর্যবেক্ষণ ছিল যে এমনকি মহাত্মা গান্ধীও এতে অবাক হয়ে যেতেন।

শেখ মুজিব: ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডি, ইউপিএল, ২০০৯

এস এ করিম: বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রসচিব