পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া: ৭ মার্চ ও তারপর

>বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা নিয়ে পাকিস্তানি সেনাশাসকদের শিবিরেও ছিল অস্থিরতা। সে ভাষণের আগে ও পরে সে প্রতিক্রিয়ার পাকিস্তানি ভাষ্য। অনুবাদ: মাসুদুল হক
সেদিন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
সেদিন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত

সেই চরম কঠিন দিন, ৭ মার্চ, যেদিন রেসকোর্স ময়দানে মুজিব জনসমাবেশে ভাষণ দেবেন—সেই দিনটি এগিয়ে এল। ঢাকা অস্থির হয়ে উঠল। গুজব ডালপালা বিস্তার করল। ভয়ভীতি এবং সংশয় দানা বাঁধল। ব্যাপকভাবে এই ধারণা ছড়িয়ে পড়ল যে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জন্য একপক্ষীয় (ইউডিআই) স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। অনেকে ভাবল, তাঁর ঘোষণা বাস্তব পরিস্থিতিকে রীতিসিদ্ধ করবে। অন্যরা মনে করলেন, এর অর্থ সোজাসুজি পাকিস্তান ভেঙে যাওয়া এবং এই অবস্থা সেনাবাহিনী কখনোই মেনে নেবে না।

এই ধরনের ঘোষণার মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগও সজাগ ছিল। পার্টির ভেতরকার চরমপন্থীরা তখনো ওই ঘোষণা দেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মধ্যপন্থীরা এর বিরোধিতা করছিল। বলা হয়, এই দুইয়ের মধ্যে মুজিবের অবস্থা ছিল ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দোলায়মান এবং চরম পদক্ষেপের খুঁটিনাটি বিষয়ের পরিমাপ করছিলেন।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ৬ মার্চ নৈশভোজ সেরে আওয়ামী লীগ বৈঠকে বসল। সরকারের সমস্ত ইন্দ্রিয় নিবিষ্ট হলো ওই সভার ওপর। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দপ্তরকে সম্ভাব্য ‘বোমা বিস্ফোরণ’ সম্পর্কে জানান দেওয়া হলো। সিদ্ধান্ত ছাড়াই মধ্যরাতে সভা মুলতবি হয়ে গেল। পরদিন খুব ভোরে সভা বসবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে ঘটনায় দু-দুটো অগ্রগতি সংযোজিত হলো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৬ মার্চ টেলিফোনে মুজিবের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেন এবং তাঁকে রাজি করানোর চেষ্টা করেন যে এমন পদক্ষেপ যেন তিনি না নেন—যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় রুদ্ধ হয়ে যায়। পরে তিনি মুজিবের জন্য টেলিপ্রিন্টারে একটা বার্তা প্রেরণ করেন। মধ্যরাতে আমার উপস্থিতিতে এই বার্তাটি ঢাকার সামরিক আইন সদর দপ্তরে পৌঁছায়। পাঠানোর আগে আমি তাড়াতাড়ি পড়ে নিলাম। পরে আমার স্মরণের ওপর নির্ভর করে আমি সেটা ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করে ফেলি। বার্তা সম্পর্কে আমার ডাইরিতে লিপিবদ্ধ আছে।

 ‘অনুগ্রহ করে কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি শিগগিরই ঢাকায় আসছি এবং আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করব। আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, আমি আপনার আকাঙ্ক্ষা এবং জনগণের প্রতি দেওয়া আপনার প্রতিশ্রুতির পুরোপুরি মর্যাদা দেব। আমার কাছে একটি পরিকল্পনা আছে—যা আপনাকে আপনার ছয় দফা থেকেও বেশি খুশি করবে। আমি সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না।’

একজন ব্রিগেডিয়ার নিজে ধানমন্ডির বাসভবনে গিয়ে মুজিবের হাতে বার্তাটি পৌঁছে দিয়ে এলেন। ফিরে এসে তিনি মুজিবের আতিথেয়তা, ভদ্র আচরণ, বাসভবনের সামনে দাঁড়ানো ডজন ডজন গাড়ি, শত শত মানুষ ইত্যাদি সম্পর্কে অনর্গল বলে যেতে থাকেন। বলেন, বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো যেন কোনো উৎসবের রৌদে অবগাহন করছে।

বলা হয়, ঢাকা কর্তৃপক্ষের পরামর্শেই প্রেসিডেন্ট এই বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন, যাতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার উদ্দেশ্যে শক্তি সঞ্চয় করা যায়। এটা পুরোপুরিই বানোয়াট কথা। আসলে ঢাকা কর্তৃপক্ষ এই সময়ে যেকোনো ধরনের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টার বিরুদ্ধে পরামর্শ দিয়েছিল। এমনকি স্বাভাবিক সেনা চলাচলও বন্ধ রাখা হয়েছিল। ইয়াহিয়ার মনে কী ছিল, সেটা ভিন্ন ব্যাপার।

একই দিন (৬ মার্চ) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা করলেন, ‘২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।’ যদি এই সিদ্ধান্তটি এক সপ্তাহ আগে নেওয়া হতো তাহলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতো।

ওই রাতে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর—জিওসির বাসভবনে তাঁকে রাত দুটোয় ঘুম থেকে ডেকে তোলেন তাঁর গোয়েন্দা বিভাগের এক অফিসার। আওয়ামী লীগের দুজন প্রতিনিধি ছিলেন তাঁর সঙ্গে। মুজিবের দূতরা বললেন, শেখ সাহেব চরমপন্থীদের তরফ থেকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছেন। তারা তাঁকে একপক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য চাপ দিচ্ছে। তাদের উপেক্ষা করার মতো যথেষ্ট শক্তিও তাঁর নেই। তাই তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে তাঁকে সামরিক বাহিনীর হেফাজতে নিয়ে আসা হোক। জিওসি বললেন, ‘আমি নিশ্চিত, কীভাবে চাপ প্রতিহত করতে হয়, মুজিবের মতো একজন জনপ্রিয় নেতা তা ভালোভাবেই জানেন। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে দিয়ে কিছুই করানো যাবে না। তাঁকে বলবেন, আমি সেখানেই (রমনা রেসকোর্সে) থাকব চরমপন্থীদের আক্রোশ থেকে তাঁকে রক্ষার জন্য। কিন্তু এ-ও বলে দেবেন, যদি তিনি পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেন তাহলে আমি সম্ভাব্য সবকিছুই জড় করব। বিশ্বাসঘাতকদের হত্যার জন্য ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগান—সবই এবং প্রয়োজন যদি হয় ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে না।’

পরদিন (৭ মার্চ) পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মি. ফারল্যান্ড মুজিবের সঙ্গে দেখা করলেন। কিছুক্ষণ পর এক বাঙালি সাংবাদিক, নাম মি. রহমান, টেলিফোনে আমাকে বললেন, একপক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারটি অপসারিত হয়েছে। মুজিবের সঙ্গে ফারল্যান্ডের দেখা করার ব্যাপারটি নিয়ে জি ডব্লিউ চৌধুরী আরও বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড মুজিবের কাছে আমেরিকার নীতিমালা পরিষ্কার তুলে ধরেন। তিনি তাঁকে এই পরামর্শ দেন, তাঁর বিচ্ছিন্নতাবাদী খেলায় সাহায্যের আশায় তিনি যেন ওয়াশিংটনের দিকে না তাকান।’

 সেই চরম সন্ধিক্ষণ এসে গেল। মুজিবের ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল ২টা ৩০ মিনিটে (স্থানীয় সময়)। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র মুজিবের ভাষণ নিজ উদ্যোগে সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থা সম্পন্ন করে। রেডিওর ঘোষকেরা আগে থেকেই রেসকোর্স থেকে ইস্পাতদৃঢ় লাখো দর্শকের নজিরবিহীন উদ্দীপনার কথা প্রচার করতে শুরু করে।

এ ব্যাপারে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর হস্তক্ষেপ করল এবং এই ‘বাজে’ ব্যাপারটি বন্ধ করার নির্দেশ দিল। আমি বেতার কেন্দ্রে আদেশটি জানিয়ে দিলাম। আদেশটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনের অপর প্রান্তের বাঙালি বন্ধুটি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। বললেন, ‘আমরা যদি সাড়ে সাত কোটি জনগণের কণ্ঠকে প্রচার করতে না পারি তাহলে আমরা কাজই করব না।’ এই কথার সঙ্গে সঙ্গে বেতার কেন্দ্র নীরব হয়ে গেল।

যে মুজিব সকালে তাঁর বাসভবনের ছাদে ছাত্রনেতাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অনুমতি দেন, তিনিই জনসভায় পতাকা উত্তোলনের ব্যাপারটি নাকচ করে দিলেন। কুণ্ডলী পাকানো টান টান উত্তেজনার মধ্যে তিনি মঞ্চে আরোহণ করলেন। একটি ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ বিশাল জনসমুদ্রের দিকে তাকালেন। মুজিব তাঁর স্বভাবসুলভ বজ্রকণ্ঠে শুরু করলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে কণ্ঠস্বর নিচু গ্রামে নামিয়ে আনলেন বক্তব্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য। তিনি একপক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না। কিন্তু ২৫ মার্চে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের বিষয়ে চারটি পূর্বশর্ত আরোপ করলেন। এগুলো হলো:

১. মার্শাল ল তুলে নেওয়া;

২. জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা;

৩. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া এবং

৪. বাঙালি হত্যার কারণ খুঁজে বের করার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা।

বক্তৃতার শেষ দিকে তিনি জনতাকে শান্ত এবং অহিংস থাকার উপদেশ দিলেন। যে জনতা সাগরের ঢেউয়ের মতো প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে রেসকোর্সে ভেঙে পড়েছিল—ভাটার টান ধরা জোয়ারের মতো তারা ঘরে ফিরে চলল। তাদের মসজিদ কিংবা গির্জায় অনুষ্ঠিত ধর্মীয় সমাবেশ থেকে ফিরে আসা জনতার ঢলের মতোই দেখাচ্ছিল। এবং ফিরে আসছে তারা সন্তুষ্টচিত্তে—ধর্মোপদেশামৃত শুনে। তাদের ভেতরকার সেই ক্রোধ যেন থিতিয়ে গেছে, যাকে প্ররোচিত করা যেত ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণে। আমাদের অনেকেরই আশঙ্কা ছিল এ রকমই। এই বক্তৃতা সামরিক আইন সদর দপ্তরে স্বস্তির বাতাস বইয়ে দিল। সদর দপ্তর থেকে টেলিফোনে কথোপকথনকালে একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা জানান যে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বলেছেন, ‘এই পরিস্থিতিতে এটাই সবচেয়ে উত্তম ভাষণ।’

এখন তো তাৎক্ষণিকভাবে সংকট উত্তরণ সম্ভব হলো। কিন্তু মুজিবের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে কোন কোন বিষয় প্রভাব ফেলেছিল, তা নির্ধারণের চেষ্টায় বসে গেলেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা তিনটি কারণ তালিকাভুক্ত করলেন। হতে পারে প্রেসিডেন্ট যে জলপাই শাখা উঁচিয়ে ধরেছিলেন, সেটাকে তিনি আঁকড়ে ধরেছেন। হতে পারে ফারল্যান্ডের সফর ভারসাম্য রক্ষা করেছে। এ-ও হতে পারে, জিওসি যে হুমকি দিয়েছিলেন সেটা হয়তো কৌশলে পরিণত হয়ে গেছে। হতে পারে, তিনটিরই প্রভাব একসঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু কেউই একে পাকিস্তানের প্রতি মুজিবের নিখাদ ভালোবাসা হিসেবে দেখতে চাইলেন না।

ঝড় শান্ত হওয়ার পর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ৩টা ৪০ মিনিটে ঢাকায় এলেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুব, মেজর জেনারেল খাদিম রাজা এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমিও সেখানে ছিলাম। জেনারেল টিক্কার পরনে ছিল নীল স্যুট। প্লেন থেকে যখন নামলেন, মনে হলো প্রাণবন্ত, উচ্ছল এবং আস্থাবান। তাঁর সামনে প্রায় ভেঙে পড়া, ক্লান্ত ও অবসন্ন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুবকে একদম খাপছাড়া মনে হচ্ছিল। তিনি খাকি ইউনিফর্ম পরে ছিলেন। মনে হলো, আন্দোলিত পাজামার ঝাপটা তাঁর মানসিক আক্ষেপকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। দুজনকে একদমই আলাদা দেখাচ্ছিল এবং ভূমিকাও ছিল ভিন্নতর। গাড়ির বহর টারম্যাক ছেড়ে আসতেই বসন্ত-সূর্যের শেষ রশ্মি ছড়িয়ে পড়ল কালো মার্সিডিসের ঝকমকে ছাদের ওপর। রাত্রি দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করল।

মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা জেনারেল টিক্কা খানের গাড়িতে ছিলেন। পথে জেনারেল টিক্কা খাদিমকে বললেন, এখানে কী গোলমাল পাকিয়েছ তোমরা? জিওসিকে রাজনৈতিক এবং আবহগত বেশ কয়েকটা ঝড় মোকাবিলা করতে হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই তিনি উৎসাহব্যঞ্জক বাক্য আশা করেছিলেন। এই অপ্রত্যাশিত মন্তব্যে থ বনে গেলেন। ঝট করে সিটের এক কোনায় সরে গিয়ে বললেন, ‘মনে রাখবেন স্যার, আমরা এখানে নরকের মধ্যে দিন যাপন করছি। এটাই কি আপনার পুরস্কার? যতক্ষণ আপনি নিজে পরিস্থিতি না দেখছেন, দয়া করে তার আগে কোনো মন্তব্য করবেন না।’ জেনারেল টিক্কা চুপ হয়ে গেলেন। প্রথম দিনেই উভয়ের মধ্যে যে ফারাক সৃষ্টি হলো, তা পূরণ হতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়।

একই দিন সন্ধ্যায় জেনারেল টিক্কাকে সরকারিভাবে পরিস্থিতি অবহিত করা হলো। ব্রিফিংয়ের সময় আমাকে লাগোয়া কক্ষে থাকতে বলা হয়, যাতে আমাকে পাওয়া যায়। কিন্তু কেউ আমাকে ডাকতে আসেনি। ৭টা ৩০ মিনিটে জেনারেল ইয়াকুব ব্রিফিং শেষ করে কামরা থেকে বেরিয়ে এলেন। এবং তাঁর স্নেহভরা হাত আমার কাঁধে রেখে বললেন: ‘নাহি খেল আয়ে দাগ বারুছে খুদো কে আতি হে অওর দোঁ জবা আঁতে আঁতে।’ (প্রথম দৃষ্টিতে কেউই সমস্যার পুরোপুরি তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে না।)

রাত আটটায় রাওয়ালপিন্ডিকে জানানো হলো যে জেনারেল টিক্কা দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন। এবার তিনি মস্তকে তিনটি টুপি ধারণ করলেন: গভর্নর, সামরিক আইন প্রশাসক ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার। তিনি তাঁর সৈনিকসুলভ গুণাবলির মাধ্যমে আমাদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টির প্রেরণা জোগালেন। আমরা জেনারেল ইয়াকুবকে শ্রদ্ধা করতাম একজন ভাষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে। কিন্তু আমরা জানতাম, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংকট সৃষ্টি এবং এর সঙ্গে নির্যাতন চালানোর নীতির কাছে তিনি মাথা নত করতে পারেননি বলেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হলো।

মুজিবুর রহমান তখনো দেশে শাসন চালিয়ে যাচ্ছেন। আর জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ নেওয়ার জন্য কোনো বিচারপতি খুঁজে পেলেন না। অসুস্থ শরীরের কারণে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মি. জাস্টিস সিদ্দিকী শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। মূলত তিনি প্রদেশের ডিফ্যাক্টো শাসক আওয়ামী লীগকে ক্ষুব্ধ করতে চাইলেন না। কয়েক দিন পর ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশন এক প্রস্তাব পাস করিয়ে মি. সিদ্দিকীকে তাঁর এই সাহসিকতার জন্য অভিনন্দন জানাল।

 ঢাকার সামরিক আইন অফিসাররা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করলেন। কিন্তু আইনগত দিক থেকে, যে আইন প্রেসিডেন্ট প্রণীত, তাতে বলা আছে, সংশ্লিষ্ট প্রদেশের প্রধান বিচারপতি শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। এই আইন যতক্ষণ সংশোধিত না হচ্ছে, ততক্ষণ তাঁর কোনো মনোনীত ব্যক্তি কিংবা সুপ্রিম কোর্টের স্থানীয় কোনো বিচারপতি শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারবেন না। শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য জেনারেল টিক্কা নিজে চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজমকে টেলিফোন করলেন। তিনি নানা অজুহাত দেখিয়ে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। এইভাবে তিনি চিফ সেক্রেটারির চাকরি না হারিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে চললেন।

ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ তার শাসনকে সংহত করার জন্য একের পর এক নির্দেশ (মোট সংখ্যা ৩১) জারি করে চলল। এই সব নির্দেশ সমাজের সর্বস্তরে তথা সরকারের সব বিভাগ, কলকারখানা, রাষ্ট্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বাকি সব প্রতিষ্ঠানই মেনে চলল। এমনকি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন রেডিও এবং টিভিও মুজিবের আদেশ অনুসারে চলতে থাকে। মুজিবের শাসন সারা প্রদেশকে গ্রাস করল। ব্যতিক্রম ছিল সেনানিবাসের সাতটি পকেট, যেখানে অফিসার ও সৈন্যরা দিবস রজনী পার করছিলেন নিদারুণ দুর্দশার মধ্যে। ক্রোধ তাঁদের আবেগ গিলে ফেলেছিল ঠিকই। কিন্তু নিয়মশৃঙ্খলার প্রতি তাঁরা দৃঢ়ভাবে সেঁটে ছিলেন। প্ররোচনা সৃষ্টির জন্য মুজিব কোনো চেষ্টাই বাদ রাখলেন না। তিনি সেনাবাহিনীকে রেল ও সড়কে প্রবেশ করতে না দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানালেন। স্থানীয় ঠিকাদারেরা সরবরাহ বন্ধ করে দিলেন। ফলে খাদ্যের জন্য অফিসার ও জোয়ানরা মজুত শুকনো রেশনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তবু তাঁরা আদেশ মেনে চললেন।

এঁদের অনেকেই তখনো পুলিশ ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সঙ্গে মিলে গুরুত্বপূর্ণ ভবন, যেমন ব্যাংক, রেডিও, টেলিভিশন কেন্দ্র, বিদ্যুৎকেন্দ্র, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ প্রহরায় অংশ নিচ্ছিলেন। জনতা কর্তব্যরত ওই জোয়ানদের প্রায়ই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করত। গালিগালাজ করত। পথে যাতায়াতকালে বাধা সৃষ্টি করত। একসময় এই ধরনের আচরণ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত সংস্থার সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ অনিবার্য করে তোলে। ফলাফল: দুই পক্ষেই হতাহত হয়। সরকারি পক্ষে কয়েকজন, জনতার দিকে বেশি।

৭ মার্চ সরকারি এক তথ্য বিবরণীতে সপ্তাহের হতাহতের কথা স্বীকার করা হলো: ১৭২ জন নিহত ও ৩৫৮ জন আহত। তথ্য বিবরণীতে আরও বলা হলো, ‘এর ভেতর নিজেদের মধ্যে দাঙ্গায় চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, ফিরোজবাগ কলোনি ও ওয়্যারলেস কলোনিতে মারা গেছে ৭৮ জন এবং আহত হয়েছে ২০৫ জন। সেনাবাহিনীর নিহত হয় ৫ জন, আহত ১, অন্যদিকে ইপিআরের বুলেটে মারা গেছে ২ জন। খুলনায় ৩ ও ৪ মার্চে স্থানীয় ও অস্থানীয় দাঙ্গা দমনকালে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ৪১ জন। স্থানীয় গোলযোগ প্রশমনে পুলিশের বুলেটবিদ্ধ হয়ে রংপুরে গুলিতে মারা গেছে ৩ জন এবং জখম হয়েছে ১১ জন। একটি ট্রেন লাইনচ্যুত করাকালে ৪ মার্চ খুলনায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ৪ জন এবং আহত হয়েছে ১ জন। ৩৪১ জন আসামি ও বিচারাধীন অভিযুক্ত ব্যক্তি ৬ মার্চ ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলখানা ভেঙে পালানোর চেষ্টা করেছিল। ফলে পুলিশকে গুলি করতে হয়। এতে প্রাণ হারায় ৭ জন এবং আহত হয় ৩০ জন। একদল সহিংস জনতা ৩ ও ৪ মার্চে যশোর, খুলনা ও রাজশাহীর টেলিফোন কেন্দ্রে হামলা চালায়। সেনাবাহিনীর জওয়ানরা এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর প্রহরায় ছিল। তারা জনতার ওপর গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। এতে ৮ জন প্রাণ হারায় এবং ১৯ জন আহত হয়। ৫ মার্চ সেনাবাহিনীর জওয়ানরা যশোর থেকে খুলনা যাচ্ছিল। পথিমধ্যে জনতা তাদের ওপর হামলা চালায়। তাদের গুলি ছুড়তে হয়। এতে ৩ ব্যক্তি মারা যায় এবং কয়েকজন আহত হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালনকালে হতাহতের শিকার হয়। মারা যান একজন অফিসার ও আহত হন একজন। ২-৩ মার্চ রাতে নওয়াবপুর-তাঁতীবাজারের ঘটনায় ইপিআরের গুলিতে মারা গেছে ৬ জন এবং আহত হয় ৫৩ জন। আত্মরক্ষার জন্য একজন ইপিআর সদস্য গুলি ছোড়েন, তাতে নিহত হয় চারজন এবং আহত হয় তিনজন। প্রদেশব্যাপী সেনাবাহিনীর গুলিতে মৃতের সংখ্যা ২৩ এবং আহত ২৬। এর ভেতর ২-৩ মার্চ রাতে যখন সদরঘাটে (ঢাকা) সেনাবাহিনীর ওপর জনতা হামলা করে, তখন গুলি চালানো হয় এবং ৬ জন প্রাণ হারায়। সহিংস জনতা ৩ মার্চ স্থানীয় টেলিভিশন কেন্দ্রে চড়াও হলে সেনাবাহিনীর গুলিতে একজন মারা যায়।

বাঙালিরা হতাহতের এই সংখ্যা বিশ্বাস করল না। তারা ভাবল, তথ্যবিবরণীতে আসল ঘটনাকে কম করে দেখানো হয়েছে। বরং তারা খবরের কাগজের শোর তোলা হেডলাইনকে বিশ্বাস করল। তাতে বলা হলো, ‘কয়েক শ বুলেটবিদ্ধ ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে’, ‘সেনাবাহিনীর গুলিতে হাজার হাজার লোক নিহত’, ‘নিরপরাধ নারী ও শিশুরাও হামলার শিকার’ ইত্যাদি।

তথ্যবিবরণী ও সংবাদপত্র যা রিপোর্ট করতে ব্যর্থ হলো তা হলো, অবাঙালিদের (বেসামরিক পশ্চিম পাকিস্তানিসহ) দুঃসহ যাতনা, যারা আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের হাতে সর্বক্ষণ যাতনার শিকার ছিল। কর্তৃপক্ষকে এই পরামর্শ দেওয়া হয় যে আওয়ামী লীগের এই ডিফ্যাক্টো শাসনামলে তাদের নৃশংসতার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করতে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ একে অগ্রাহ্য করে। তারা এ ব্যাপারে দুটো কারণ দর্শায়। প্রথমত, বলেন, এই প্রস্তাবের পক্ষে গেলে দ্বিজাতিতত্ত্বকে (মুসলমান মুসলমানকে হত্যা করছে) ‘অস্বীকার’ করা হয়। দ্বিতীয়ত, এটা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিশোধস্পৃহা জাগিয়ে তুলতে পারে, যেখানে এক বিরাটসংখ্যক বাঙালি শান্তিতে বসবাস করছে।

নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৭

সিদ্দিক সালিক: তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা