অসাধারণ ভাষণ

রেসকোর্স ময়দানে সেই অবিস্মরণীয় ভাষণ। ছবি: সংগৃহীত
রেসকোর্স ময়দানে সেই অবিস্মরণীয় ভাষণ। ছবি: সংগৃহীত

অধীর আগ্রহ ও গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে ৭ মার্চ দুপুর থেকে রেডিও সেটের সামনে বসে রইলাম। কথা ছিল, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা সরাসরি সম্প্রচার করা হবে বেতারে। কিন্তু তা হলো না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসে আমাদের উদ্বেগ আরও বাড়ল।

ঢাকার খবর জানতে মার্চের ১ ও ৩ তারিখ অধিক রাতে ফোন করেছিলাম আমার শিক্ষক মুনীর চৌধুরীকে। ৭ তারিখ গভীর রাতে আবার তাঁকে ফোন করলাম। টেলিফোন বাজামাত্রই তিনি ধরলেন, তাঁর কণ্ঠে চাপা উত্তেজনা। হ্যাঁ, উনি গিয়েছিলেন রেসকোর্সে বক্তৃতা শুনতে। সে বক্তৃতার কথা বললেন, জনসমুদ্রের বিবরণ দিলেন, মানুষের প্রতিক্রিয়ার কথা জানালেন। আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম যে বিকেলের অভিজ্ঞতা তখনো তাঁকে সম্মোহিত করে রেখেছে। তাঁর সঙ্গে জীবনে সেই আমার শেষ কথা।

ক্যাম্পাসের অনেকের সঙ্গেই চট্টগ্রাম শহর ও ঢাকার বন্ধুবান্ধবদের কথা হচ্ছিল টেলিফোনে। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা তাৎক্ষণিকভাবে সম্প্রচার করা যায়নি বেতারে। তবে জানা গেল, এর প্রতিবাদে বেতারের বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের কাজকর্ম বন্ধ করে দেন এবং পরে রফা হয় যে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার যে রেকর্ড করা হয়েছিল, তা বেতারে প্রচারিত হবে পরদিন সকালে।

৭ মার্চের বক্তৃতা তাই আমরা শুনতে পেলাম ৮ মার্চে। কী অসাধারণ ভাষণ! সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হয়। বঙ্গবন্ধু যখন বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তখনই মনে হলো পৃথিবীর বুকে একটি নতুন জাতির জন্ম হলো।...

তখন সারা দেশে বয়ে যাচ্ছিল অস্থির সময়। দেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকায় বইছিল ঝোড়ো হাওয়া। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে সবাই জেনেছে স্বাধীনতার ঘোষণা বলে। এর দিন দশেক পরে এক বক্তৃতায় মাওলানা ভাসানী বলেছিলেন যে ‘মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, এ ব্যাপারে মতানৈক্য নেই।’ সেই ঘোষণার সঙ্গে আমরা পেয়েছিলাম নতুন কর্মসূচি। ৩ মার্চ থেকে যে সত্যাগ্রহ শুরু হয়, তা ৭ মার্চের পরে নেয় অহিংস অসহযোগের রূপ। সেই অসহযোগের কালে সেনানিবাস আর গভর্নর-ভবনের বাইরে কোথাও সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল না, সবকিছু চলেছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী যে গভর্নর টিক্কা খানকে শপথবাক্য পড়াতে অস্বীকার করেন, তা সারা পৃথিবীতে সংবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেশময় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সর্বস্তরের মানুষ, সরকারি কর্মচারীরাও শরিক হন তাদের সঙ্গে। শিল্পী-সাহিত্যিকেরা আয়োজন করেন বিক্ষোভ, মিছিল ও সমাবেশের, বর্জন করেন সরকারি খেতাব। কর্নেল ওসমানী ও মেজর জেনারেল মজিদের নেতৃত্বে সাবেক সৈন্যরা শপথ নেন দেশের জন্য লড়াই করার। সবাই-ই আহ্বান জানাচ্ছেন স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।

আমার একাত্তর থেকে, সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৯

আনিসুজ্জামান: জাতীয় অধ্যাপক