পটের পৃথিবী

শম্ভু আচার্য
শম্ভু আচার্য

৪৫০ বছরের পুরোনো আঁকিয়ে আমাদের আচার্য পরিবার। আমার বাবা সুধীর আচার্য। মা কমলা দেবী। জাতি-গোত্র ব্রাহ্মণ, লগ্ন আচার্য। পেশা পঞ্জিকা দেখে বিয়ে বর্ণনা করা, জ্যোতিষকর্ম আর পূর্বপুরুষেরা নির্মাণ করতেন প্রতিমা, আলপনা। দিনবদলের সঙ্গে তাঁরাও বদলালেন বিভিন্ন সময় নানা পেশায়। আমি বাবার বড় ছেলে। আমার ছেলে অভিষেক আচার্যও আঁকে। ৪৫০ বছরে যা হয়নি, আমার জীবনে তা ঘটেছে সাধনার বররূপে।

৪৫০ বছর আগে আচার্যের প্রথম পুরুষ পট আঁকাকে পেশা করেছিলেন। তখনকার পটচিত্র ছিল সম্পূর্ণ ধর্মভিত্তিক। সময়ের পরিবর্তনে তাঁরা একদিন হয়ে ওঠেন পটুয়া। সনাতন ধর্ম আর সহজাত লোককৃষ্টির বিষয় নিয়েই ছিল পটচিত্রের অন্যতম আকর্ষণ। এভাবেই শিল্পের আত্মবিশ্লেষণ পটে সত্য ও বাস্তবে রূপ নেয়।

আমি ছয় বছর বয়সে বাবার সঙ্গী হয়েছি। দিন গেছে চর্চা, সাধনা আর দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে। পটচিত্রকে এ সময় পরিচিত করতে পেরে নিজেকে আমি ভাগ্যবান বলে মনে করি। মনে পড়ে পূর্বপুরুষের কথা। জানামতে তাঁরা নয় পুরুষ পট আঁকিয়ে। পূর্বপুরুষ নরসিংদী থেকে মুন্সিগঞ্জের কমলাঘাট রিকাবি বাজারের পাশের কালিন্দিপাড়ায় বসবাস করতে থাকেন। এঁদের প্রথম আদি পেশা ছিল তাঁতের শাড়িতে নকশা করা। পরে প্রতিমা তৈরি এবং পটচিত্রের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। মনে রাখা যায়, পটচিত্র নতুনভাবে তৈরি হয় না, বংশক্রমান্বয়ে এটা গড়ে উঠছে। এখন অনেকেই পটচিত্র আঁকেন, এটা একটা ভালো লক্ষণ।

কঠিন নিয়ম মেনে পটচিত্র আঁকতে হয়। শিশিরভেজা সকালে গোসল করে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে মন্ত্র পরে ধ্যানমগ্ন হতে হয়। পরবর্তী সময়ে ফোটানো জলের সঙ্গে দেশীয় বানানো রং মিশিয়ে ক্যানভাসে প্রয়োগ করতে হয়। অপবিত্র অবস্থায় বা ইচ্ছা করলেই যখন-তখন আঁকা সম্ভব নয়। এই চিত্র আঁকার কিছু নিয়মতান্ত্রিক ব্যাকরণ আছে, যা মেনে এবং শিখে এসব পটচিত্র আঁকতে হয়। ফোক-লোক আচার-কৃষ্টির বিষয় গ্রামবাংলার আবহমানকালের জনমানুষেরই প্রকৃত উত্সব অনুষ্ঠান, যা পরম্পরায় বিভিন্ন পথ ধরে এসেছে নানা মাধ্যম হিসেবে। 

পটচিত্রের স্বধর্মই বাস্তবকে রূপান্তরিত করা, প্রাকৃতিক ও সাদৃশ্যবোধক লক্ষণগুলো দেশীয় তাত্পর্য নিয়ে মানসিক স্তরে পৌঁছে দেওয়া। স্মৃতি ইচ্ছা কল্পনার চেতনে-অবচেতনে প্রসারিত হতে থাকে নিরবধি। ঠিক তেমনি রূপকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে একটি অনির্বচনীয় বোধ জেগে ওঠে। সম্ভবত এ কারণেই চেনা কিছুকে অচেনা মনে হয়। এই অচেনা অপরিচয়ের অনুভূতি একদিকে যেমন স্থির, অন্যদিকে লৌকিক অর্থে একাধিক সংকেতের সম্ভাবনা গড়ে তোলা। পটচিত্র তাঁর বিষয়ের দিক থেকে পরিষ্কার ও অর্থবহ।


‘পটশিল্পে নয় পুরুষ’, প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০১০