দরদি মরমি কবি

হাসন রাজা
হাসন রাজা

হাসন রাজার বিখ্যাত গান ‘লোকে বলে বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা না আমার’ শুনলে কারও কারও তাঁর ঘরবাড়ি দেখার ইচ্ছা হতে পারে। এমন কিছু মানুষ গেলেন হাসন রাজার ঘরবাড়ি দেখতে। হাসন রাজা নিজেই আগ্রহী হয়ে তাঁদের ঘরবাড়ি দেখাতে নিয়ে গেলেন। নিজের কবরের জায়গা দেখিয়ে বললেন, ‘এই দেখুন আমার বাড়ি।’

ঘটনা কতটুকু সত্যি, জানি না। প্রভাতকুমার শর্মার লেখা মরমি কবি হাসন রাজায় এ রকম পড়েছি। সুনামগঞ্জে গিয়ে সেই বিখ্যাত ‘ঘর’ দেখেও এসেছি। একই সঙ্গে তাঁর তরবারি, কাঠের বউলাওয়ালা খড়ম ও আচকানও দেখলাম। সব ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছেন হাসন রাজার প্রপৌত্র কবি দেওয়ান মমিনুল মউজদিন। আমার ছেলেমানুষি আগ্রহ দেখেই হয়তো তিনি বললেন, ‘স্যার, হাসন রাজা সাহেবের আচকানটা কি একটু পরে দেখবেন?’ আমি আচকান পরে ওনার খড়ম পায়ে দিয়ে কিছুক্ষণ গম্ভীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলাম, শুধু তলোয়ারটা হাতে নিলাম না।

হাসন রাজার প্রতি আমার প্রবল আগ্রহের শুরুটা করে তেরো-চৌদ্দ বছরের এক কিশোরী। আমি গিয়েছি হবিগঞ্জের কী একটা অনুষ্ঠানে। শেষ রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে ঘুমাতে গেছি। ঠিক করে রেখেছি দুপুর পর্যন্ত ঘুমাব। ভোর ছয়টায় এই মেয়েটা এসে ঘুম ভাঙাল। সে একটা হারমোনিয়াম নিয়ে এসেছে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে আমাকে গান শোনাবে। কাঁচা ঘুম ভাঙানোর জন্য তাকে ধমক দিতে গিয়েও দিতে পারলাম না। মেয়েটার চোখ করুণ, চেহারায় গাঢ় বিষণ্নতা। আমি বললাম, শোনাও তোমার গান। একটা শোনাবে, এর বেশি না।

সে গাইল, ‘নিশা লাগিল রে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে।’ কী সুন্দর বাণী! কী সরল সুর। আমি বললাম, এই গানটা কার লেখা?

হাসন রাজার।

উনার আর কোনো গান তুমি জানো? জানলে গাও।

আর জানি না।

আমি ঢাকায় ফিরলাম। অচিনবৃক্ষ নাটকে গানটি ব্যবহার করলাম।

শিকায় ঝোলানো হাঁড়ি
শিকায় ঝোলানো হাঁড়ি

একদিন হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় হাসন রাজার গানের সিডি বের করার সিদ্ধান্ত নিই। তাঁর চমত্কার সব গান একেবারেই গীত হয় না। আমাদের বের করা সিডির কারণে গানগুলো সবাই শুনবে, এ রকম আশা। সেই গান রেকর্ড করা, সিডি বের করা মানেই প্রচুর অর্থ ব্যয়। সিডি করা হলো ইংল্যান্ডে। দুঃখের ব্যাপার, সিডি খুব কম মানুষই কিনল। আমার তখন রোখ চেপে গেছে, দেশের মানুষকে হাসন রাজার গান শুনতেই হবে। হাসির ধারাবাহিক নাটক লিখলাম, নাম আজ রবিবার। প্রতিটি পর্ব শেষ হলো হাসন রাজার বিভিন্ন গান দিয়ে। যেদিন এই নাটক প্রচার শেষ হলো, আমার কাছে মনে হলো, এই দরদি মরমি কবির প্রতি আমার যে ঋণ, তা খানিকটা শোধ হয়েছে।

পাদটীকা-১

হাসন রাজার একটি গানের প্রথম তিনটি চরণ:

‘হাসন রাজায় কয়

নামাজ রোজা ছাইড়া দিচ্ছি

ভেস্তে যাইবার ভয়।’

বেহেশতে যেতে তাঁর ভয়টা কোথায়, তা তিনি গানে ব্যাখ্যা করেছেন। কৌতূহলী পাঠক গানটি সংগ্রহ করুন।


‘বাউলা কে বানাইলো রে?’, প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০১১