বাঙালির কবি

জসীমউদ্‌দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩—১৩ মার্চ ১৯৭৬) প্রতিকৃতি এঁকেছেন মাসুক হেলাল
জসীমউদ্‌দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩—১৩ মার্চ ১৯৭৬) প্রতিকৃতি এঁকেছেন মাসুক হেলাল

জসীমউদ্দীন তাঁর কবিতায় বাঙালির লৌকিক শিল্প-ঐতিহ্যের দুই বলবান ধারা ‘কবিগান’ ও ‘কথকতা’ এবং গদ্যরচনায় লোকজ কলারীতিকে আত্মস্থ করে তাঁর অতুলনীয় কবিতা ও অনন্য স্বাদু গদ্য শিল্প নির্মাণ করে গেছেন। তাঁর কবি হয়ে ওঠার উৎস-অনুসন্ধানে কবির জীবনকথা বইটি আমাদের হাতে যেন এক রহস্যালোকের চাবি তুলে দেয়। এ বইয়ের ‘কবিতা-রচনা’ শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি বলেন, ‘আলপনার নকশা আঁকার মতো উপস্থিত ছড়া কাটিয়া বোলরচনায় একটি অপূর্ব আনন্দ আছে।...আলপনার মতো কবিগান রচনা বাংলা কবিতার প্রকাশভঙ্গির একটি দিক। এই পথে কিছুটা তপস্যা করিলে আমাদের তরুণ-কবিরা উপকৃত হইবেন বলিয়াই আমি মনে করি। আমার নিজের রচনায় তেমন চাতুর্যভরা মিল অনুপ্রাসের বর্ণচ্ছটা নাই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হইতে আরম্ভ করিয়া আরও অনেক সমালোচক বলিয়াছেন, “আমার ছন্দের গতি খুব সহজ।” ইহা যদি আমার গুণ হইয়া থাকে, তবে এই শিক্ষা আমি পাইয়াছি আমার দেশের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত কবিয়ালদের কাছে। তাঁহারাই আমার কাব্যজীবনের প্রথম গুরু। সেই যাদব, পরীক্ষিত, ইসমাইল, হরিপাটনী, হরি আচার্য।—এঁদের কথা যখন ভাবি, আমার অন্তর কৃতজ্ঞতায় অশ্রুসিক্ত হইয়া ওঠে। পল্লী বাংলার ঘরে ঘরে তাঁহারা যে অমৃতধারা বিতরণ করিতেন তাহা হইতে বঞ্চিত হইয়া আজ বাঙালির অন্তর শুষ্ক মরুভূমি হইয়া পড়িতেছে।’ (জীবন কথা, জসীমউদ্দীন, পঞ্চম মুদ্রণ, ২০০১, পৃ. ১৩০-৩১)
জসীমউদ্দীনের কবিতায় লোকগানের প্রভাবও সামান্য নয়। কবি তাঁর কবিতায় লোকঐতিহ্যভিত্তিক নবনির্মাণেরও এক কুশলী শিল্পী ছিলেন। এর পরিচয় বিধৃত আছে তাঁর ইংরেজি ভাষায় লেখা প্রবন্ধ ‘ফোক সংস অব ইস্ট বেঙ্গল’-এ। এই প্রবন্ধের সংশ্লিষ্ট অংশের বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়:
লোকসংগীতকে জনসাধারণের কাছে উপস্থাপনের অনেক বড় ধরনের অসুবিধা আছে। কারণ প্রায়ই তা মধ্যবিত্ত রুচির সঙ্গে যায় না। তাই এ ধরনের রচনাকে নবায়ন করে উপস্থাপন করার জন্য আমার অনেকগুলোর নিজস্ব পদ্ধতি ছিল।
আমি কখনো একগুচ্ছ গান সংগ্রহ করে তার মধ্যে যেগুলো শহরের লোকদের রুচির সঙ্গে খাপ খায়, সেগুলোই বেছে নিতাম। গ্রাম্য-সাহিত্য থেকে আপত্তিকর ও খুব অশ্লীল অংশগুলো কেটেকুটে বাদ দিয়ে আমি তাকে ভদ্রসমাজের উপযোগী করে তুলতাম। কখনো কৃষকের পর্নকুটিরে লেখা কোনো গানের সুরটা আমাকে মুগ্ধ করেছে; কিন্তু তার কথা অস্পষ্ট ও স্থূল। কখনো এমন হয়েছে যে, কোনো গ্রামবাসী আমাকে একখানা গান দিয়েছে, সে শুধু সুরটা জানে এবং গানের দু-চার লাইন মাত্র মনে রাখতে পেরেছে। আমি ওই ভাব বজায় রেখে গানের বাকি অংশটা তৈরি করে নিয়েছি। এই আধামৌলিক গানগুলো বাস্তবিকপক্ষে খুব মূল্যবান। কারণ শিক্ষিত জনসাধারণ তা পছন্দ করেছে এবং একই সঙ্গে তা গ্রামীণ গায়েনদেরও মনমতো হয়েছে। এভাবেই তা জনপ্রিয় হয়েছে।
কবির এই বক্তব্য বিশেষ মূল্য বহন করে। এ থেকে তাঁর সৃজন-প্রক্রিয়ার একটা ধরন যেমন বোঝা যায়, তেমনি তিনি যে নগর ও গ্রাম এবং আধুনিক ও ঐতিহ্যিক ধারার বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে একটি একক জাতীয় সাহিত্য নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন, তা পরিস্ফূট হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্যের অভিঘাত না পড়লে এই পথেই হয়তো আমাদের আধুনিক সাহিত্য গড়ে উঠত।
জসীমউদ্দীনের কবিতা ও গদ্যরচনায় বাঙালির কথকতার ঐতিহ্যটি বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। জসীমউদ্দীনের এক অন্ধ দাদা ছিলেন। নাম দানু মোল্লা। কবি বলেছেন, ‘অল্প বয়সে চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিনি কোনো লেখাপড়া শিখিতে পারেন নাই। কিন্তু স্নেহপ্রবণ বৃদ্ধলোকটি ছিলেন গ্রাম-বাংলার কৃষ্টির জীবন্ত প্রতীক। কেচ্ছা, তামাসা, শ্লোক—এসব তো তিনি জানিতেনই, তাহা ছাড়া যত রকমের গ্রাম্যগান ও সুর তাঁর পেট ভরা ছিল।...দাদার কাছে কত রকমের কেচ্ছাই না শুনিতাম! কেচ্ছা বলিবার সময় তিনি আঙুলে তুড়ি দিয়া, দুই হাত ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া, কণ্ঠস্বর কখনও বিলম্বিত লয়ে টানিয়া, কখনও দ্রুতলয়ে খাটো করিয়া, কখনও ধমকের সুরে, কখনও আবেগমিশ্রিত সুরে, কখনও জোরে জোরে দাপটের সঙ্গে, কখনও ফিসফিস করিয়া মনে মনে কথা বলার মতো করিয়া, কাহিনীর বিষয়বস্তুটিকে তিনি শ্রোতাদের মনে জীবন্ত করিয়া তুলিতেন।’ (জীবন কথা, পৃ. ৩৬-৩৮)। কবি তাঁর কবিজীবনের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘আমার কবিজীবনের প্রথম উন্মেষ হইয়াছিল এই দাদার গল্প, গান ও কাহিনীর ভিতর দিয়া। সেই ছোটবেলায়ই মাঝে মাঝে আমাকে গানে পাইত। নিজে মনোক্তি করিয়া ইনাইয়া-বিনাইয়া গান গাহিয়া যাইতাম। দাদা একদিন আমাকে বলিতেছিলেন, “পাগলা গানের মধ্যে কি যে বলে কেউ শোনে না। আমি কিন্তু শুনি মনোযোগ দিয়া ওর গান।” কি অন্তর্দৃষ্টির বলেই না আমার রচকজীবনের প্রথম আকুলি-বিকুলি তিনি ধরিতে পারিয়াছিলেন।’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৫)

>জসীমউদ্‌দীনের রচনায় মৌলিক বাংলাদেশকে পাওয়া যায়। অর্থাৎ জসীমউদ্‌দীনের কবিতা নির্মাণকলায় এমন কিছু আছে, যা বাঙালি ও বাংলাদেশের চিরায়ত সত্তার মৌলিক অংশকে পরম যত্নে ধারণ করেছে

উপরোক্ত পটভূমির কথা মনে রাখলে জসীমউদ্দীনের কবিতার রাখালিয়া সুর এবং কৃষিভিত্তিক পল্লিবাংলার গহিন-ভেতরের চিত্র পাই। তিনি শুধু মুসলিম-কথক তাঁর দাদার সংস্কৃতিভান্ডারই আত্মস্থ করেননি, বাঙালি হিন্দুর রামায়ণ-মহাভারতের কখক ঠাকুরের ধারা এবং কারবালা কাহিনির জারিগান ও বাউল সাধনার ধারাকেও আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। বোধ হয় তার চেয়েও বড় কথা মধ্যযুগের বাংলার মূলধারার কাব্যের আখ্যান প্রবলতার ধারাটিকে স্বকীয় কৌশল ও তাঁর কালের প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করে শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়েছিলেন, তেমনি বাঙালি জীবনের, বিশেষ করে গ্রামীণ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবনযাত্রার এক অনিঃশেষ আখ্যান রচনা করেছিলেন। সোজনবাদিয়ার ঘাট, নক্সীকাঁথার মাঠও তাঁর কাহিনিভিত্তিক কবিতাগুলো এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
তাঁর কবিতার আখ্যানধর্মী বৈশিষ্ট্যে উৎসমূল সম্পর্কে জানা যায় কবির একটি বক্তব্য থেকে। তিনি বলেন, ‘গল্প বুননের যে ধারাটি চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, রামায়ণ প্রভৃতি কাব্যে যেভাবে চলছিলো, মধু-হেম নবীনের ধারা তার সঙ্গে যোগ রাখেনি। সে জন্য বাংলার মাটিতে তাঁরা শিকড় গাড়তে পারেননি।’ (জসীমউদ্দীনের প্রবন্ধসমূহ, দ্বিতীয় খণ্ড)। জসীমউদ্দীন গল্প বুননের ঐতিহ্যিক ধারাটিকে সংহত ও পরিপাটি করে তুলেছেন তাঁর কাব্যে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও জসীমের আখ্যানধর্মী কাব্য-আঙ্গিকের প্রশংসা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়টি লক্ষ করে কবির নক্সীকাঁথার মাঠের কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘এই বইখানি সুন্দর কাঁথার মতো করে বোনা।...এবং আমি এইটেকে আদরের চোখে দেখেছি।’

২.
পল্লীকবিদের কবিতা শিথিল, দুষ্টমিপূর্ণ ও প্রযত্নহীন হলেও লোককবিতা কিন্তু উপেক্ষণীয় নয়; বরং তার গুরুত্ব বিরাট। সে জন্যই জাতীয়তাবাদী জার্মান দার্শনিক পণ্ডিত ও সংস্কৃতিতাত্ত্বিক ইয়োহান গারট্রুড হার্ডার বলেছেন, ‘লোককবিতা একটি জাতির আত্মা।’ লোককবিতার একটা অংশ ভাব-গভীর ও দার্শনিকতাপূর্ণ। এতে বাঙালির শতসহস্র বছরের চিন্তন-প্রক্রিয়ার ধরনটি ফুটে উঠেছে। লালন ফকির, হাসন রাজা, রাধারমণ, সৈয়দ শাহনূর প্রমুখ কবির রচনা এই ধারার। এঁদের কবিতায় উচ্চমার্গের দর্শন ও ভাবুকতার পরিচয় বিধৃত। মধ্যযুগে এঁদের পূর্বসূরি কবি আলাওল, সৈয়দ সুলতান, শেখ ফয়জুল্লাহ, আলী রেজা, শেখ চাঁদ প্রমুখ।
দ্বিতীয় ধারার লোককবিতার মধ্যে মৈমনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এই ধারাটি বাংলা কবিতার অনন্য সম্পদ। লোককবিতার এই দুই ধারার কবিতাকেই হার্ডারের অনুসরণে আমাদের ‘জাতির আত্মা’ হিসেবে আখ্যাত করা যায়। জসীমউদ্দীন পদাবলি সাহিত্য, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল যেমন নিবিষ্টচিত্তে পাঠ করেছিলেন, তেমনি বাংলার লোককবিতার ভাব-সম্পদও আত্মস্থ করেছিলেন গভীরভাবে। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই খুলে যায় তাঁর নিজস্ব কাব্যভুবনের দরজা।
‘পল্লীকবি’ হিসেবে জসীমউদ্দীনকে ঘিরে একটা মিথ তৈরি হয়েছে। এই ‘অভিধা’ বিশাল পল্লিবাংলায় তাঁর বই বিক্রির সহায়ক হয়েছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বেশ হিসেবি কবি এতে বোধ হয় আপত্তি করেননি। কিন্তু তিনি নিজেকে ‘পল্লীকবি’ মনে করতেন এমন মনে হয় না। ‘পল্লীকবি’র অভিধা নিকৃষ্ট কবির নামান্তর তা তিনি বুঝতেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর ‘লালন ফকির’ প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘লালনকে হতভাগা পল্লীকবি বলিয়া উপেক্ষা করিলে চলিবে না।’ (জসীমউদ্দীনের প্রবন্ধসমূহ, দ্বিতীয় খণ্ড, ২০০১, পৃ. ১৯)
আমাদের মধ্যযুগের মূলধারা কাব্যেও আখ্যান প্রবলতা আছে। তার পটভূমি পল্লি বা নগর যা-ই হোক না কেন সে-হিসেবে ভাগ করে আমরা তাকে, ‘পল্লী সাহিত্য’ বা ‘নাগরিক সাহিত্য’ বলি না। কারণ সাহিত্যের বিষয়বস্তু যা-ই হোক শিল্পীর প্রকাশশৈলীর ধরন ও ভঙ্গি অনুযায়ী তার চরিত্র নির্ধারিত হয়। গ্রাম-বাংলার বেসুমার পথুয়া/ ভাট কবি আছেন। তাঁরা কোনো না-কোনো সমকালীন ঘটনা নিয়ে কবিতা রচনা করে থাকেন। সে সব হাটুরে পদ্যের আবেদন তাৎক্ষণিক। সাময়িক কৌতূহল মিটিয়েই সে কবিতা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পুনঃপ্রকাশ ও পুনঃপ্রচার না করে কবি নতুন কবিতা রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। এটা পল্লীকবির কবিতা রচনার একটা প্রচলিত ধারা। কিন্তু জসীমউদ্দীনের কবিতা কি এমন সাময়িক? তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের সংস্করণের পর সংস্করণ হচ্ছে। শুধু দেশেই তাঁর বইয়ের বিপুল চাহিদা আছে এমন নয়, বিদেশেও তাঁর রচনা সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ছে। এর কারণ জসীমউদ্দীনের রচনায় মৌলিক বাংলাদেশকে পাওয়া যায়। অর্থাৎ জসীমউদ্দীনের কবিতা নির্মাণকলায় এমন কিছু আছে, যা বাঙালি ও বাংলাদেশের চিরায়ত সত্তার মৌলিক অংশকে পরম যত্নে ধারণ করেছে।

পূণৃচন্দ্র চক্রবর্তীর অাঁকা জসীমউদ্‌দীনের সোজন বাদিয়ার ঘাট বইয়ের প্রচ্ছদের রেখাচিত্র
পূণৃচন্দ্র চক্রবর্তীর অাঁকা জসীমউদ্‌দীনের সোজন বাদিয়ার ঘাট বইয়ের প্রচ্ছদের রেখাচিত্র

পল্লীকবিরা গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের সংবাদ-পিপাসা ও রসতৃষ্ণাকে নিবৃত্ত করলেও তাতে তাঁদের চৈতন্যের স্তরের কোনো উত্তরণ ঘটে না, হৃদয়ের এমন কিছু প্রসারও ঘটে না। ভালো কবিতা নিবিষ্ট পাঠকের হৃদয়ে যে গভীর অনুভব, তীক্ষ্ণ অনুভূমি ও সংবেদনশীলতার উপাদানের রাসায়নিক বিকিরণ ঘটায়, পল্লীকবির কবিতায় তা প্রত্যাশিত নয়। এখানেই জসীমউদ্দীনের কবিতা পল্লীকবির কবিতা থেকে আলাদা হয়ে গেছে। পল্লীকবির কবিতা ছকবাঁধা, পুনরাবৃত্তিময় ও নিরস। বহু ক্ষেত্রে তার বর্ণনা ক্লান্তিকর, একঘেয়ে। জসীমউদ্দীনের কবিতা কি তাই? তাহলে কোন যুক্তিতে জসীমউদ্দীনকে ‘পল্লীকবি’ বলব?
৩.
আমাদের বিবেচনায় জসীমউদ্দীন কবি হিসেবেই শুধু এক বড়মাপের শিল্পী ছিলেন না, গদ্যলেখক হিসেবেও তাঁর তুলনা মেলা ভার। গদ্যশিল্প সৃষ্টিতে কবি বাংলার লৌকিক ঐতিহ্যের কথকতার ধারাটিকে নিপুণভাবে ব্যবহার করেছিলেন। গ্রামীণ গল্প-গাছার কথকদের মুখের ভাষা এবং কবির নিজস্ব অনুপুঙ্খ অবলোকন ক্ষমতার চিত্রধর্মিতা তাঁর কবিতার মতো গদ্যশিল্পকেও স্বাদু ও মনোজ্ঞ করেছিল। জসীমউদ্দীনের অনুরাগী সমালোচকেরা যে বলেছেন, ‘জসীমউদ্দীনের জীবনকথা পড়িতেছি না, মায়ের হাতের পিঠা খাইতেছি।’ এই উক্তিতে একটুও অতিরঞ্জন নেই।
৪.
কবি ও গদ্যশিল্পী জসীমউদ্দীন এক মহান মানবতাবাদী গণশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর অনন্য দেশপ্রেমের মূলে ছিল বিপুল-ব্যাপক সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর আন্তরিক ভালোবাসা। দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি হতে পেরেছিলেন এক অঙ্গীকারদীপ্ত প্রতিবাদী লেখক। দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরশাসকদের নানা কুকীর্তির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক লড়াকু যোদ্ধা। ভাষা-আন্দোলনসহ বাঙালির সব গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার সংগ্রাম এবং ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন এক সক্রিয় কলম-সৈনিক। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর সখ্য ও শ্রদ্ধা ছিল আন্তরিক ও উদ্দীপনাপূর্ণ।

তাঁর চারিত্র্যশক্তি ছিল সুদূঢ়। তাই ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের মূল সভাপতির ভাষণে প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতেই তিনি যেমন তাঁর সরকারের কোনো কোনো নীতির তীব্র সমালোচনা করতে পারেন, আবার ঘৃণ্য ঘাতকদের হাতে তাঁর নিহত হওয়ার পর তাঁকে নিয়ে অসামান্য কবিতাটিও লিখতে পারেন। সব মিলিয়েই জসীমউদ্দীন বাংলা ও বাঙালির এক মহান সাহিত্যশিল্পী।
শামসুজ্জামান খান: গবেষক; মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি।