বুড়িগঙ্গার নৌকাবাইচ

বুড়িগঙ্গার ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ। ছবি: প্রথম আলো
বুড়িগঙ্গার ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ। ছবি: প্রথম আলো

ব্রিটিশ যুগেও বুড়িগঙ্গা নদীর গুরুত্ব হ্রাস পায়নি। তখন থেকেই এই নদীর দুই তীরভূমি ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। যাত্রীদের ওঠানামা ও মালপত্রের পরিবহন সুগম করার জন্য ১৭৬৫ সালে প্রায় চার মাইল দীর্ঘ একটি বাঁধ নির্মিত হয়েছিল। পরে অবশ্য তার অস্তিত্ব অবলুপ্ত হয়। ১৮৫৭ সালে তদানীন্তন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার বাকল্যান্ড সাহেবের আগ্রহে ফরাশগঞ্জ থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত এক পাকা বাঁধ নির্মিত হয়, যা বাকল্যান্ড বাঁধ নামে পরিচিত। এই সুপরিচ্ছন্ন বাঁধে সাহেবসুবো ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সকাল-সন্ধ্যা ভ্রমণে বেরোতেন। এই ভ্রমণকারীদের সুবিধার্থে, বিশেষ করে নগ্ন স্নানার্থীদের নগ্নদেহ অবলোকনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সকাল নয়টার আগে এবং বেলা তিনটার পর ঘাটে স্নান নিষিদ্ধ করে এক ফরমান জারি হয়েছিল।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে অজস্র নদী-নালা, খাল-বিল এই দেশের সর্বত্র ছেয়ে আছে। প্রশান্ত এসব নদীর রূপ বর্ষাকালে হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। নদীর জলধারা দুই কূল ছাপিয়ে প্লাবিত করে মাঠঘাট ও জনপথ। বর্ষার এই জলধারার অবদানকে স্মরণ করে মানুষের মন হয়ে ওঠে আনন্দমত্ত। তারা এই বর্ষাকালে মেতে ওঠে নানা রকমের জলক্রীড়ায়। এ সময়েই প্রায় সারা বাংলাদেশে আয়োজন করা হয় নৌকাবাইচের। বুড়িগঙ্গাও এর ব্যতিক্রম নয়। 

বুড়িগঙ্গায় নৌকাবাইচের সময় বিভিন্ন নৌকায় পোশাকের বৈচিত্র্য, মাথায় রুমালের রঙের বাহার, নদীর দুই পাশের অগণিত দর্শকের মন কেড়ে নিতে দেখা গেছে। বুড়িগঙ্গা নদীর পশ্চিম প্রান্তে গণি মিয়ার হাটসংলগ্ন এলাকা থেকে এই বাইচ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে শেষ হয় বাকল্যান্ড বাঁধের প্রায় শেষ প্রান্তে। এই শেষ প্রান্তে বাইচ প্রতিযোগিতার বিচারকেরা অবস্থান নেন। বুড়িগঙ্গায় অনুষ্ঠিত জাতীয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার দূরত্ব হয় প্রায় ৬৫০ মিটার। বাকল্যান্ড বাঁধ ও তত্সংলগ্ন তীরভূমিতে অজস্র কৌতূহলী দর্শক ভিড় জমান। তাঁদের আনন্দ-উল্লাসে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। এ ছাড়া নদীর দুই পাশ ঘেঁষে দর্শকবোঝাই কিছু নৌকাও সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে।

নৌকাবাইচে আরেকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা গেছে। নৌকার দুই পাশে বসে থাকে বইঠাচালক মাঝির দল আর পেছনে থাকেন কয়েকজন দাঁড়ি। পেছনে দাঁড়িয়ে তাঁরা বইঠা চালান। নৌকার মাঝে থাকেন নৌকার নির্দেশক আর একদল গায়েন বা বাদক। প্রতিটি নৌকায় দেখা গেছে, তাঁরা ঢোল-করতাল নিয়ে গান আর বাদ্যসহযোগে তালে তালে মাঝিদের উত্সাহ দিচ্ছেন। মাঝেমধ্যেই তাঁরা সমস্বরে উত্সাহব্যঞ্জক কিছু শব্দ বা ধ্বনি বারবার উচ্চারণ করতে থাকেন। যেমন ‘হেঁইয়ো জোয়ান হেঁইয়ো’, ‘আল্লা বল হেঁইয়ো’, শাবাশ জোয়ান হেঁইয়ো’। দু-একজন দোহারও খঞ্জনি বাজিয়ে তালে তালে ধুয়া দেন। দুই পাশের দর্শকদের মধ্যেও কেউ কেউ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রতিযোগীদের উত্সাহ জোগান। 

আবহমানকাল থেকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নৌকাবাইচের প্রচলন হয়ে থাকলেও ব্রিটিশ আমলে ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল কি না, সে তথ্য আমাদের অজানা। হেকিম হাবিবুর রহমান তাঁর ঢাকাবিষয়ক গ্রন্থে শতবর্ষ আগের ঢাকায় নৌকাবাইচের কোনো তথ্য জানাননি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, দেশ বিভাগের পরে আনুষ্ঠানিকভাবে বুড়িগঙ্গায় নৌকাবাইচের প্রচলন হয়।


‘বুড়িগঙ্গার নৌকাবাইচ’, প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০০৯