প্রথম আধুনিক
বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসটি তিন পর্বে বা খণ্ডে বিন্যস্ত। এর প্রথম খণ্ডের নাম ‘মহরম পর্ব’, ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় খণ্ড ‘উদ্ধার পর্ব’ ও তৃতীয় খণ্ড ‘এজিদ-বধ পর্ব’ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৮৮৭ ও ১৮৯০ সালে। বিষাদ-সিন্ধুর মূল উপজীব্য হলো: ১. কারবালার যুদ্ধ ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাতি হাসান ও হোসেনের শহীদ হওয়ার কাহিনি; ২. মোহাম্মদ হানিফার হাতে দামেস্কে এজিদের সেনাদের হাতে বন্দী জয়নাল আবেদীন ও নারীদের মুক্ত হওয়ার ঘটনা; এবং ৩. এজিদের পরাজয় (এই পর্বের নাম ‘এজিদ-বধ’ হলেও, তাঁকে আসলে বধ বা হত্যা করা হয়নি)। পরাজিত হওয়ার পর এজিদ একটি কুয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, রোজ কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তিনি সেখানে আগুনে পুড়তে থাকবেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যু হবে না।
বিষাদ–সিন্ধুর মূল বিষয়বস্তু ইসলাম। তবে এখানে এ-ও উল্লেখ করা জরুরি যে উপন্যাসটিতে বাঙালি মুসলমান বা হিন্দু—কোনো সম্প্রদায়ের প্রতিই জবরদস্তি বা জঙ্গিপনার কোনো নজির নেই। মনে রাখতে হবে, ঊনবিংশ শতকে বাংলায় বেশ কয়েকটি সংস্কারপন্থী ইসলামি আন্দোলন হয়েছে—ওয়াহাবি ও ফরায়েজি আন্দোলন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আন্দোলন দুটির লক্ষ্য ছিল মুসলমান সমাজ, তাদের নিজেদের মধ্যে আত্মশুদ্ধি বা সহিহ ইসলামচর্চা।
মীর মশাররফ হোসেন যে শুধু মুসলিম ‘শুদ্ধতাবাদী’ সংস্কারক ছিলেন না, তা-ই নয়, বরং তিনি হিন্দুদের দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রকৃত বোঝাপড়া করেছেন—অন্তত তাঁর জীবনের শুরুর অর্ধাংশ সময় তো তা-ই। ১৮৮৮ সালে, বিষাদ-সিন্ধু ত্রয়ী পর্ব রচনা ও প্রকাশনার দশকটিতে তিনি ‘গো-জীবন’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। লেখাটিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান আছে। কিন্তু তাঁর শেষ বয়সে, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মশাররফ হোসেনের এই চিন্তা-চেতনায় আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। বাঙালি হিন্দুদের প্রতি তিনি তখন তাঁর আগের আস্থা রাখতে পারেননি, বজায় রাখতে পারেননি তাঁর সহানুভূতিশীলতা।
তাঁর মনোজগতের এই পরিবর্তনকে আনিসুজ্জামান সে সময়ের অনুদার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে খাটো করে দেখতে নারাজ। সে সময় সংঘটিত হিন্দু রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ সাহিত্যে ও সমাজে তাৎক্ষণিকভাবে তুমুল আলোড়ন তোলে। একপর্যায়ে তা হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্যের পরিবর্তে বৈরিতায় পর্যবসিত হয়। আনিসুজ্জামান যদিও কারও নাম উল্লেখ করেননি, তবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-৯৪) কথা নিশ্চয়ই তিনি মনে করেছেন, বিশেষ করে তাঁর আনন্দমঠ (১৮৮২) উপন্যাস ও কৃষ্ণচরিত্র-এর কথা। মশাররফের প্রথম দিকের রচনাগুলোকে আনিসুজ্জামান সত্যিকার অর্থে ‘সাহিত্য’ বলে মনে করেছেন। আর ন্যারেটিভ ইন নভেল ফর্ম বা উপন্যাসরীতির বয়ান-কৌশলের নমুনা হিসেবে পেশ করেছেন বিষাদ-সিন্ধুর নজির। তিনি বলেছেন, ‘মশাররফ হোসেনের মনোভাবের পরিবর্তনের পেছনে এই অনুদার পরিবেশের দান যে অনেকখানি, সেটা স্বীকার না করে উপায় নেই।’ মশাররফ হোসেনের কৃতিত্ব হলো, তাঁর রচনার সমগ্রতা, যাকে আমরা সাহিত্য বলেই অভিহিত করতে পারি; ছিল সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব থেকে মুক্ত।
অনুবাদ: মিজান মল্লিক
আধুনিক সাহিত্যে মুসলিম কণ্ঠ’, প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০১৫
ক্লিনটন বি সিলি: ইমেরিটাস অধ্যাপক, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র।