মাটি থেকে শিল্পকলা

কুমোরের হাতে তৈরি হচ্ছে মাটির পাত্র
কুমোরের হাতে তৈরি হচ্ছে মাটির পাত্র

ব্যবহারিক মৃৎপাত্রের মূল নান্দনিক মাত্রা উদ্ভাসিত হয় তার সৃষ্টিকালেই। নরম কাদার অনুভব, যা করার জন্য মাংসপেশি তৈরি হয়েছে, তা করতে পারার সংবেদন এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জটিল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য মনের ব্যবস্থাপনা। সামান্য মাটিকে শনাক্তযোগ্য পূর্ণাঙ্গ অবয়বে পরিণত করার এবং যা ছিল প্রাকৃতিক, তাকে সামাজিক করে তোলার মধ্য দিয়ে কুমোর তাঁর শক্তিমত্তা টের পান। বারবার কোনো সমস্যার সমাধানে হাতকে কাজে লাগানো এবং মনকে ভরানোর জটিল প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় তাঁর আত্মবিশ্বাস। সৃষ্টিশীলতা সময়কে অধিকার করে। অন্তর্গত সামর্থ্য যতই ক্রীড়াশৈলীর মতো বাস্তবায়িত হয়, পরিকল্পনা যত বেশি শিল্পরূপ পেতে থাকে আর শিল্পবস্তু হয়ে ওঠে অনন্য; সক্ষম ব্যক্তি হিসেবে কুমোরও ততটাই নিজের অস্তিত্বের জোরালো প্রমাণ পান।

কুমোর কাজের ধাপগুলো নির্দ্বিধায় ক্রমাগত পেরিয়ে যান; অনুভব করেন কাজটির সুললিত স্বাচ্ছন্দ্য। কুয়া থেকে বাড়িতে পানি বয়ে আনার সময় নারীরা কুমোরের তৈরি কলসি কাঁখে নিয়ে কোনো অস্বস্তি টের পান না। কোনো কিছু তাঁদের বাধা দেয় না, তাঁদের চলন থাকে সাবলীল। যে মানুষটি সারা দিন পেরেক ঠোকেন, তিনি তাঁর পেশির মাধ্যমেই জানেন ভালো আর খারাপ হাতুড়ির পার্থক্য। কাজের উপযোগী করে তৈরি উৎকৃষ্ট সরঞ্জাম ব্যবহারের সময় মনে যে সাবলীল প্রফুল্লতা জন্মায়, সেটিই তাঁর নান্দনিক ভারসাম্য।

দলবদ্ধ কাজ হলো শিল্পীর দ্বিতীয় আনন্দ। কলসি তৈরির জন্য কাদা খুঁড়ে তোলা, তাকে আকার দেওয়া, পোড়ানো ও বিক্রি করা—সবটা একজনেরই কাজ নয়। অনেকের সঙ্গে মিলে কাজ করার সময় আলাপ-আলোচনায় কুমোর তাঁর নিস্তরঙ্গ সময়টিকে ভরিয়ে তোলেন, তাঁর একাকিত্ব দূর করেন, একাত্ম হয়ে ওঠেন; এভাবে তিনি পরিণত হন বৃহত্তর সত্তার অংশীদারে। কর্মী এই মানুষটি এভাবে হয়ে ওঠেন এক সামাজিক সত্তা। তিনি তখন এক নিবিড় সমবায়ের অংশ, যা গড়ে উঠেছে কাজের অংশীদারত্বে, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে উৎপাদনশীলতা ও তার পারিতোষিকের মধ্য দিয়ে। শ্রম ও প্রাপ্তির মধ্যস্থতায় তাঁদের পরিবারগুলো সংহত হয়। মাটি পোড়ানোর যৌথ চুলায় সম্মিলিত কাজের মধ্য দিয়ে গ্রামের সামাজিক পরিসরে এসব পরিবার পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়। গ্রামীণ ও শহুরে বাজারের সূত্রে উপযোগিতার মর্যাদাপূর্ণ মূল্যবোধের ভিত্তিতে গ্রামগুলো বৃহত্তর সমাজের সংস্পর্শে আসে, যেখানে এই মুহূর্তেই কেউ না কেউ তাঁদের কাজের সুফল ভোগ করছেন।

কাদামাটি মৃৎপাত্রে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে নান্দনিকতার এই লক্ষ্য পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছায়। একই সঙ্গে কুমোরও হয়ে ওঠেন এক সক্ষম ব্যক্তি, সমাজের একজন সদস্য—বিশ্বজগতের সত্তা। যে কাদামাটি দিয়ে সবকিছুর সূচনা, তা কিন্তু কুমোরের নিজের সৃষ্টি নয়। তিনি এর নিয়ন্তা হন স্বল্পকালের জন্য—মাটি খুঁড়ে তোলার পর থেকে পুড়িয়ে পাত্র তৈরি করা পর্যন্ত। ব্যবহৃত হয়ে ভেঙে যাওয়ার পর আবার তা মাটিতে মিশে যায়।

অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ

‘কাদামাটির রূপরস’, প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০১৫

হেনরি গ্লাসি: ইমেরিটাস অধ্যাপক, লোকসংস্কৃতি বিভাগ, ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্লুমিংটন, যুক্তরাষ্ট্র।