বাঙালির বিশ্বরূপ

শাস্ত্র হিসেবে নৃতত্ত্ব কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পর প্রশ্নটা তুলেছিলেন একজন নৃতাত্ত্বিকই, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা সমাজগুলোর পর্যবেক্ষণকে কেন বলা হবে নৃতত্ত্ব, আর ধনী সমাজের পর্যবেক্ষণকে কেন আমরা বলব সমাজতত্ত্ব? এরপর নৃতত্ত্ব আর আগের পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। একটু ঘুরিয়ে এখানেও এ প্রশ্ন তোলা যায়, শিক্ষিত সমাজের সৃজনশীল প্রকাশকে যেখানে আমরা ডাকি ‘শিল্প’ বলে, সেখানে আনপড় সমাজের সংস্কৃতিকে কেন বলা হবে ‘লোকশিল্প’?নানাজনের লেখাপত্র থেকে ‘লোকশিল্প’ সম্পর্কে মোটা দাগে যে ধারণা মেলে তা অনেকটা এ রকম: ‘লোকশিল্পে’র ভাষা স্থির। কারণ এর ভাষাটির সুনির্দিষ্ট একটি ধারণা আনপড় সমাজে আগে থেকেই হাজির থাকে। ব্যক্তিশিল্পী সেই সামাজিক ভাষাটিতে নিজের সৃজনশীলতা রূপায়ণ করেন। আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকা ভাষায় আত্মাহুতি দেন ব্যক্তিশিল্পী। অর্থাৎ আমাদের লোকায়ত শিল্পচর্চার পুরো ঘটনাটি যেন ইতিহাসের বাইরের ঘটনা। সময় পাল্টাচ্ছে, কিন্তু শিল্পের ভাষা ও অভিজ্ঞতা পাল্টাচ্ছে না।বিষয়টি একটু বিশদ করা যাক। আমরা দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, সৃষ্টিশীল ধারণা ও ভাষার অভিনবত্বে আধুনিক শিল্পীরা আমাদের যারপরনাই হতচকিত করে তুলছেন। অথচ গ্রামেগঞ্জে যাঁরা গাজীর পট আঁঁকছেন, যুগের পর যুগ তাঁদের অঙ্কনশৈলীতে চোখে ধরা পড়ার মতো বদল ঘটছে কোথায়? এ থেকে চটজলদি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আমাদের দেরি হয় না যে, নতুন যুগের মার্জিত শিল্পকলা যেখানে সমসাময়িক ইতিহাসের হাত ধরে উঠে এসেছে, ‘লোকশিল্প’ সেখানে পড়ে রয়েছে পেছনে। এ শিল্পকলা বিলীয়মান অতীতের স্মৃতিচারণ মাত্র। এর মূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক। এ শিল্পের পেছনে কাজ করছে একটি পিছিয়ে থাকা বা পশ্চাদ্পদ সমাজের মন। আমাদের সচল জীবনে এর কোনো যোগ নেই। ‘লোকশিল্পে’র প্রতি আমাদের দরদ আছে বটে, তবে সেটা জাতীয়তাবাদী আবেগে, জাতির ‘শেকড়’ খোঁজার অন্বেষায়।বলছিলাম আনপড় পশ্চাদ্পদ সমাজের মনের কথা, তাদের পিছিয়ে থাকা শিল্পকলার কথা। এই ধারণারই গোড়ায় আঘাত করেছিলেন ফরাসি ভাবুক ক্লদ লেভি-স্ত্রস। মিথ অ্যান্ড মিনিং বইয়ে তিনি বললেন, এ সমাজকে পশ্চাদ্পদ ভাবার লেশমাত্র অবকাশ নেই, কারণ ‘চারপাশের জগত, এর প্রকৃতি এবং নিজেদের সমাজকে বোঝার তাগিদে ও কামনায় এঁরাও উদ্গ্রীব। এ কারণে একেবারে দার্শনিক, এমনকি কখনো কখনো বিজ্ঞানীদের মতো, এঁরাও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে এগিয়ে চলেন।’ ক্লদ এখানেই থামেন না। শিক্ষিত ও আনপড় সমাজের পার্থক্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, লোকায়ত সমাজ ‘আলাদা কারণ এঁরা স্বল্পতম রসদ নিয়ে বিশ্বজগত সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণায় পৌঁছাতে চান—আর এ ধারণা নিছক সাধারণ নয়, বরং সামগ্রিক।’ (বাঁকা হরফ ক্লদ লেভি-স্ত্রসের)। জগদ্বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তের দোহাই দিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষিত সমাজের বৈজ্ঞানিক মন এর বিপরীত। নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য সবকিছু তাঁরা বিভক্ত করে আনে। সহজ কথায়, আনপড় সমাজের বিশ্বরূপ অখণ্ড, আধুনিক সমাজের বিশ্বধারণা বিচূর্ণ। তাঁদের নিজ নিজ শিল্পকলায়ও সেই বিশ্বরূপেরই অভিব্যক্তি।এই ধারণার চাক্ষুস নমুনা দেখেছিলাম জাপানের এক লোকশিল্প জাদুঘরের চত্বরে পা রাখার পর। কামরার পর কামরায় বিপুলায়তন সে জাদুঘরে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এমন সব লোকায়ত শিল্পের নিদর্শন, যা রচিত হয়েছে কেবল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোয়। ইতিহাসের সেসব ব্রাহ্মমুহূর্ত কীভাবে ভেঙে দিচ্ছে ‘লোকশিল্পে’র তথাকথিত চেনা ছক, সে ছিল অবাক বিস্ময়ে দেখার মতো ব্যাপার।শিল্পরচনার প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ শিল্পীর লড়াই বরং আরও তীব্র। গ্রামসমাজের মানসে গেঁথে থাকা শিল্পভাষাটি তৃপ্ত করে শুরু করতে হয় তাঁদের শিল্পরচনা। কিন্তু আবার ওরই মধ্যে রূপায়ণ করতে হয় শিল্পীর নিজস্ব শিল্পচেতনা। সমাজের কাঙ্ক্ষিত শিল্পভাষার মধ্যে তাই সেখানে স্ফূর্তি ঘটে ব্যক্তিশিল্পীর নিজস্ব মুদ্রা ও পাল্টে যাওয়া বিশ্ববোধ। ইতিহাসের দীর্ঘ পটভূমিকায় এই বিবর্তন এত ধীর ও সূক্ষ্ম যে ধৈর্যের সঙ্গে লক্ষ না করলে সহজে নজরে আসে না। বাংলাদেশের লোকায়তিক শিল্পের নিবিড় পর্যবেক্ষক, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক হেনরি গ্লাসির বর্ণনায়, এ শিল্প ‘ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক, বৌদ্ধিক ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ, উদ্ভাবনমুখর ও চিরায়ত, বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক, প্রয়োজনীয় ও মনোহর, ইচ্ছা ও বাস্তবতার এক সমন্বয়।’আমাদের লোকায়ত শিল্পেও এভাবে রচিত হয়ে চলেছে বাংলার নিজস্ব ও অখণ্ড বিশ্বরূপ। আর গ্রামেগঞ্জে তা রচনা করে চলেছেন আমাদের প্রজ্ঞাবান শিল্পীরা; যাত্রায়, পটে, মৃত্ ও ধাতুশিল্পে, গানের বিচিত্র উচ্ছৃত ধারায়। জাতি হিসেবে আমাদের স্বপ্ন ও লড়াইয়ের খবর পেতে হলে এ শিল্পেরই কাছে আমাদের বারবার ফিরে ফিরে আসতে হবে।