সব বাঙালির উৎসব

বাংলা সনের প্রথম দিন বাংলাদেশে পালিত হয় নববর্ষ হিসেবে। ‘নতুন বছরের আগমন উপলক্ষে অনুষ্ঠিতব্য উত্সবের প্রথম দিন’, যেমনটি লিখেছেন এনামুল হক, ‘প্রকৃতপক্ষে তা একটা নির্দিষ্ট উত্সবের দিন।’

বাঙালির নববর্ষের প্রধান বৈশিষ্ট্য এটি হিন্দু বা বৌদ্ধ বা মুসলমানের একক কোনো উত্সব নয়। এর চরিত্র সর্বজনীন। সর্বজনীন এমন উত্সব পৃথিবীতে বিরল। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। কিন্তু তাদের নববর্ষ আশুরা থেকে শুরু নয় এবং তা বিষাদময়ও নয়। এ কারণেও বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ পালন বিশেষ স্বাতন্ত্র্যময়।

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস খুব পুরোনো নয়। খুব সম্ভব বাংলা সনের সঙ্গে যোগ আছে বাংলা নববর্ষ পালনের। সম্রাট আকবর বাংলায় বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন ১০ মার্চ ১৫৮৫ সালে। কিন্তু তা কার্যকর হয় ১৬ মার্চ। তাঁর সিংহাসনারোহণের সময় থেকে। বাংলা সনের ভিত্তি হিজরি চান্দ্র সন ও বাংলা সৌরসন। বাংলার তৃণমূল পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়েছিল বাংলা সন। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রবল আগ্রাসনের পরও গ্রামীণদের বাংলা সন থেকে হটানো যায়নি।

বৈশাখ কেন নববর্ষ, সে রহস্য উদ্​ঘাটিত হয়নি। তবে অনুমান করে নিতে পারি, দেশটি গ্রীষ্মমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত, তাই এখানে গ্রীষ্মেরই প্রাধান্য থাকা স্বাভাবিক। চারদিকে শুধু পানির তৃষ্ণা, সবকিছু মিলিয়ে ঋতুর এক প্রচণ্ড পরিবর্তন সহজেই স্পষ্ট হয়। তারপর কালবোশেখি। আচমকা বুনো মোষের মতো এসে সব করে দেয় লন্ডভন্ড। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি। কমে দাবদাহ। হাল পড়ে খেতে। আর এই পরিবর্তনটা শুধু কৃষি নয়, শরীর-মনেও পরিবর্তন আনে। শিল্প-সাহিত্যেও তা প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্নভাবে।

পুঁথিকার মনিরুদ্দীন আহমদ লিখেছিলেন:

এহি তো বৈশাখ মাসে ফুল ফুটে বাগে।

সাজাইয়া ফুলের পালঙ্গ আশেক মাশুকে থাকে...

আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কিছু গান তো এখন বৈশাখী উত্সবের সূচনা সংগীত:

এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।

তাপসনিশ্বাসবায়ে

মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে

নববর্ষ আগে ছিল মূলত গ্রামীণ উত্সব, শহরে যে একেবারে পালিত হতো না, তা নয়। তবে তা শহরকে আন্দোলিত করতে থাকে গত শতকের ষাটের দশকে। সামরিক একনায়ক আইয়ুব খান রবীন্দ্রসংগীত ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর হামলা শুরু করেন ষাটের দশকের গোড়াতেই। রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করলে বুদ্ধিজীবীরা উদ্যোগ নেন এর প্রতিবাদ করার। সাড়ম্বরে পালন করেন রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। এরই সঙ্গে সূত্রপাত হয় ছায়ানটের।

এ প্রসঙ্গে পাহাড়িদের কথাও বলতে হয়। জাতিসত্তা ভিন্ন হলেও সমতল প্রভাবিত করেছে ও করছে তাদের উত্সবকে (সংস্কৃতি)। রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির সবচেয়ে বড় উত্সব ‘বৈসাবি’। চাকমারা একে বলে ‘বিজু’। ত্রিপুরা ‘বৈসুক’ আর মারমারা ‘সাংগ্রাই’। এরই মিলিত নাম ‘বৈসাবি’। চৈত্রের শেষ দুই দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন পালিত হয় ‘বিজু’। বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণই হচ্ছে এর মূল।

বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠান বাংলা নববর্ষ। তৃণমূল থেকে শাহরিক—সব পর্যায়েই বিপুল উত্সাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে তা পালিত হয় একমাত্র খাঁটি বাঙালি উত্সব হিসেবে।


‘এহি তো বৈশাখ’, প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০০৭