যত কাণ্ড শুটিংয়ে

জয়া আহসান। ছবি: সুমন ইউসুফ
জয়া আহসান। ছবি: সুমন ইউসুফ

‘তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল।’ আমাদের মতো অভিনয়শিল্পীদের বেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের এই কলিটি কী যে সত্য!

সিনেমার রুপালি পর্দা কিংবা পত্রিকার পাতার ঝলমলে ছবির কোলাহলে আমাদের জীবনের সত্য আড়ালে চলে যায়। এতসব উজ্জ্বল আলোর ঝলকের পেছনে পুঞ্জ হয়ে থাকা কষ্ট, বেদনা আর ঝুঁকির গল্প কজনই বা জানেন। বাইরের চকচকে জৌলুস মুছে দেয় ট্রেনের তলায় ঝাঁপাতে গিয়ে হাড়ের স্থায়ী ক্ষতির কথা কিংবা বিষ্ঠায় সয়লাব বন্যার পানি গায়ে মেখে কাজ করার গল্প।

আজ শোনাই পর্দার দারুণ সব দৃশ্যের পেছনের রোমহর্ষ, বেদনা আর রোমাঞ্চভরা কিছু ঘটনা।

একাকী নির্জন ঈদ
সেবারের ঈদের সময়টায় আমি কলকাতায়। শুটিংয়ের প্রচণ্ড চাপ। চলছে সকাল থেকে গভীর রাত অবধি টানা। দম ফেলারই অবকাশ নেই, ঈদের প্রস্তুতির তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। হঠাৎ কী কারণে যেন ঈদের দিনের সকালের শুটিং বাতিল হয়ে গেল।

ফাঁকা হয়ে গেল ঈদের দিন সকালটা। কোনো কাজ নেই। বাড়িতে আমি একা। মা, বোন, আত্মীয়স্বজন সবাই ঢাকায়। ঘুম থেকে উঠে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। খুব খিদে পেয়েছে। ফ্রিজ খুললাম, কী খাওয়া যায় দেখি। ফ্রিজে আছে শুধু সামান্য একটু বাসি পরিজ আর দুধ। আর কিচ্ছু নেই। খেতে বসে চোখ ভরে পানি চলে এল।

ঈদের সকাল মানে তো আমার কাছে মায়ের হাতের সেমাই আর জর্দা। দুপুরে পোলাও–মাংস। ঢাকায় নিশ্চয়ই আনন্দ করে সবাই তা–ই খাচ্ছে। আর এখানে ঈদের সকালে আমার সামনে কিনা খাওয়ার প্লেটে শুধুই দুধ আর বাসি পরিজ। দীনহীন সেই প্লেটের সামনে বসে রইলাম একলা আমি।

নিয়তির আবর্ত
আবর্ত কলতাকায় আমার প্রথম ছবি। মাসখানেক টানা শুটিং চলবে সেখানে। কিন্তু পুরো আনন্দটা মনে নিতে পারছি না। বাবা অসম্ভব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। ছোট বোন কান্তার দায়িত্বে বাবাকে রেখে মাকে নিয়ে রওনা দিলাম কলকাতায়। মনটা মেঘলা হয়ে রইল।

এ ছবিতে আমার চরিত্রের নাম চারু। ছবিতে ওর বাড়িটি দেখানোর জন্য নতুন তোলা একটি দালানের ১৯ তলার ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হয়েছে। সেই ফ্ল্যাটটি তৈরি করে নেওয়া হয়েছে চারুর ফ্ল্যাটটি যে রকম দেখাতে পারে, সে রকম করে। নতুন সেই অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে লিফট পুরোপুরি চালু হয়নি। প্রায়ই আমাদের হেঁটে হেঁটে ওপরে উঠতে হয়।

বাবার খোঁজখবর নিই। ছবির কাজও করি। বাবাকে নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো খবর পাই না। তাঁর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই ছবির কাজ আস্তে আস্তে শেষ দিকে চলে এল।

একদিন শেষ দৃশ্যের শুটিং চলছে। আমি শট দিতে ব্যস্ত। এর মধ্যে কে একজন এসে আমার হাতে ফোন ধরিয়ে দিল। খুবই নাকি জরুরি। ফোনটা ধরতেই কান্তার কান্না। কান্নার দমকে সে কথা বলতে পারছে না। কোনোমতে শুধু বলল, ‘জয়া আপু, বাবা নেই।’

শুনে আমার মাথা শূন্য হয়ে গেল। আমার শুটিংয়ের মধ্যেই বাবাকে চলে যেতে হলো? তাঁকে শেষ দেখাও দেখতে পারলাম না? মাকে এ খবর দেব কী করে? বাবার কাছে তো আমাকে যেতেই হবে। কিন্তু এই ছবি? আমার চিন্তার খেই হারিয়ে যেতে লাগল।

শুটিং স্পটেও ততক্ষণে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ছবি নিয়েও নিশ্চয়ই উদ্বেগে ভরে উঠেছে সবার মন। পরিচালক অরিন্দম শীল কাছে এসে খুব কোমল গলায় বললেন, ‘কিচ্ছু ভেবো না, জয়া। ছবির কাজ পরে দেখা যাবে। তুমি বাবার কাছে যাও।’

আমি ড্রেসিংরুমে গিয়ে আড়াল খুঁজছি। বুক ফেটে যাচ্ছে আমার। একা একা হাউমাউ করে কাঁদছি। মনের মধ্যে অলক্ষ্যে অন্য একটা ভাবনাও কাজ করছে। আমি চলে গেলে এই ফ্ল্যাটটিও তো ছেড়ে দিতে হবে। আমি ফিরে আসার পর আবার ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিতে হবে। সবকিছু তৈরি করতে হবে নতুন করে। কত টাকাই বা বাজেট একটা বাংলা ছবির! প্রযোজক–পরিচালকের নাগালের বাইরে চলে যাবে তখন ছবিটা।

ধীরে ধীরে সামলে নিলাম নিজেকে। পরিচালককে এসে বললাম, অরিন্দমদা, শটটা কি আমি একবার দেওয়ার চেষ্টা করে দেখব? বাবার মৃত্যুর ভার বুকে চেপে রেখে ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ক্যামেরায় ধরা পড়ল ছবির শেষ শট।

শুটকির এই গুদামে থাকতে থাকতে ডিডিটি বিষক্রিয়ায় আমার শরীরের চামড়া উঠে গিয়েছিল। নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত ‘গেরিলা’ ছবিতে।
শুটকির এই গুদামে থাকতে থাকতে ডিডিটি বিষক্রিয়ায় আমার শরীরের চামড়া উঠে গিয়েছিল। নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত ‘গেরিলা’ ছবিতে।

ভোজনের মাশুল
মনের চাপ বেড়ে গেলে আমার শুধু খেতে ইচ্ছে করে। গেরিলা ছবির শুটিংয়ে একটা ট্রেনে চেপেছি আমরা। যে সে ট্রেন নয়, পাকিস্তান আমলের ট্রেন। অনেক ঝক্কি করে পঞ্চাশের দশকের বগি জোগাড় করে সে রকম একটা ট্রেন তৈরি করে তোলা হয়েছে। ট্রেন চলছে উত্তরবঙ্গের পথ ধরে। প্রতিদিন সে ট্রেনের তেলের খরচাই লাখ টাকার কাছাকাছি। চলন্ত সে ট্রেনে চলছে শুটিং।

পথে পথে ট্রেন থামছে। চোখে পড়ছে স্ট্রিটফুডের বিচিত্র পসরা। আর আমার চলছে খাওয়া। বুট, বাদাম, শসা, ডিম, চানাচুর—যা পাচ্ছি খাচ্ছি। খেতে খেতে আমার পেটের বারোটা বেজে গেল। কিছুক্ষণ পরপর আমার জন্য ট্রেন থামাতে হচ্ছে। আর আমি ছুটছি বাথরুমে। একটা সময়ে আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে লাগল। দাঁড়িয়ে থাকাই সম্ভব হচ্ছিল না। পুরোনো সেসব বগিতে এখনকার মতো চেয়ার থাকত না। পাতা থাকত বেঞ্চি। শট থাকলে শট দিই। তারপর এসে সেই বেঞ্চিতে মরার মতো শুয়ে থাকি। ছবির পরিচালক বাচ্চু ভাই, মানে নাসির উদ্দীন ইউসুফ খুব ঘাবড়ে গেলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, শুটিং বন্ধ করে দেবেন।

এত কষ্টে গড়ে তোলা একটা ট্রেন, এত বেশুমার খরচ হচ্ছে এর পেছনে, আমার কারণে শুটিং ভেস্তে যাবে? হতেই পারে না। আমার জবরদস্তিতে বাচ্চু ভাই পরাস্ত হলেন। আমার সে অবস্থা নিয়েই শুটিং চলতে লাগল।

গেরিলার শুটিং করতে গিয়ে আরও এক ভয়ংকর কাণ্ড ঘটেছিল। ছবির একটা অংশে দেখানো হবে, একটি শুঁটকির গুদামে আমি আটকে আছি কয়েকটা দিন ধরে। খিদের তাড়নায় এক সময়ে আধাকাঁচা শুঁটকি চিবিয়ে খেতে শুরু করব আমি।

শুঁটকির গুদামঘর বানানো হয়েছে। শুঁটকি যেন পচে না যায়, সে জন্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অঢেল ডিডিটি। শুটিংয়ের আগে সেটে সময় কাটানো আমার অভিনয়–প্রক্রিয়ার অংশ। এতে ছবির আবহের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার পথ খোলে। চরিত্রের সেই অবস্থাটার মধ্যে ঢোকার অবকাশ হয়। শুটিংয়ের দু–এক দিন আগে থেকেই ওই গুদামঘরে গিয়ে বসে থাকতে শুরু করলাম। দীর্ঘক্ষণ ধরে। গোসল করাও বাদ দিয়ে দিলাম, যাতে গুদামঘরে আটকে থাকার অভিব্যক্তিটা আমার অবয়বে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

গুদামঘরের শুটিংয়ের শেষ দিকে দেখা গেল, ক্যামেরায় আমার মুখ কেমন বড় বড় দেখাচ্ছে। গায়েও শুরু হয়েছে অসম্ভব চুলকানি। যত দিন যাচ্ছে, সেটা বাড়ছে। এক সময় চোখমুখ আর সারা শরীর ফুলে ঢোল। বুঝতে পারলাম, এটা ডিডিটির বিষক্রিয়া। আরও কিছুদিন পর ইঠতে শুরু করল আমার শরীরের চামড়া। বিভৎস এক অবস্থা! সেবার আমাকে দেশের বাইরে দৌড়াতে হলো চিকিৎসার জন্য।

মাহমুদ দিদারের ‘বিউটি সার্কাস’ ছবিতে চলেছে দিনের পর দিন দড়িতে ঝুলে ঝুলে অভিনয়। সেটি আমাকে দিয়েছে অভিনয়ের স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন।
মাহমুদ দিদারের ‘বিউটি সার্কাস’ ছবিতে চলেছে দিনের পর দিন দড়িতে ঝুলে ঝুলে অভিনয়। সেটি আমাকে দিয়েছে অভিনয়ের স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন।

অভিনয়ের ক্ষত
বিউটি সার্কাস ছবিতে আমার চরিত্র একটি সার্কাস–কন্যার। এর শুটিং করতে গিয়ে তাই কত অবিশ্বাস্য কাণ্ডই যে করতে হলো। হাতির পিঠে চড়া থেকে শুরু করে ৬০ ফুট উঁচু থেকে দড়িতে বাঁধা অবস্থায় সারা দিন ঝুলে থাকার মতো দুঃসাহসিক সব কাজকারবার।

হাতির পিঠে চড়ব, বেশ আনন্দ। কিশোর বয়সে চিড়িয়াখানায় হাতির পিঠে চড়ার অভিজ্ঞতার মতোই হবে নিশ্চয়ই। হাসি হাসি মুখ করে ঘুরব, ফিরব, হাত নাড়ব। পরিচালক তাঁর কাজ করে যাবেন, এমনটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু বিধি একেবারেই বাম। মাহুত জানালেন, আজকের এই হাতিটি বড়ই নারীবিদ্বেষী। মেয়েদের তো উনি বিশেষ পছন্দ করেনই না, পারলে পায়ে পিষে মারেন। কিন্তু নতুন হাতি খুঁজে আনার মতো সময় মোটেও হাতে নেই।

মাহুতকে কষ্টেসৃষ্টে বোঝানো হলো হাতিটির হৃদয়ে নারী বিষয়ে কিঞ্চিৎ মমতার অনুভূতিরও যদি উদ্রেক ঘটানো যায়। মাহুত প্রস্থান করলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরে এলে জানা গেল, হাতি মহাশয় প্রস্তুত।

দম নিয়ে বুকে সাহস সঞ্চয় করে হাতির কাছাকাছি পৌঁছালাম। মাহুত আমার কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘কোনোভাবেই কিন্তু হাতির পিঠ থাইক্যা পড়ন যাইব না, ম্যাডাম। গ্যাঁট মাইরা বইস্যা থাকবেন। হাতি আপনেরে ঝাড়া দিয়ে নিচে ফেলতে পারলে কিন্তু পিইষ্যা মাইরা ফেলব।’

কী বলে? আঁটো হয়ে বসে থাকার নিয়ত নিয়ে হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে কোনোক্রমে হাতির পিঠে চড়ে বসলাম। কিন্তু উরেব্বাস, এ তো তারকাঁটার আসনে পিড়ি পেতেছি। বসামাত্র মনে হলো আমার সারা শরীরে ইঞ্জেকশন বিঁধে গেল। হাতির লোম যে এমন শক্ত কাঁটার মতো, কোনো ধারণাই ছিল না। হাতির পায়ে পিষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচলাম। কিন্তু সারা দিনের শুটিং শেষে দেখি, হাতির লোম বিঁধে বিঁধে আমার কোমরের নিচ থেকে সারা গা ক্ষতবিক্ষত।

এ ছবির আরেকটি দৃশ্যের জন্য আমাকে হেঁটে যেতে হবে দড়ির ওপর দিয়ে। ১০ ফুট ওপরে টানটান করে দড়ি বাঁধা হলো। নিচে নিরাপত্তা–জাল নেই। তাই আমার পেছনে লোহার একটা তার শক্ত করে আটকে দেওয়া হলো। পা ফসকে পড়ে গেলে শক্ত এই তার আমাকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখবে।

সার্কাসের তাঁবু বলে কথা। চারপাশে লোহার কাঠামো। চড়া আলোর জন্য হাই ভোল্টেজ বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দড়ির ওপরে হাঁটার শট দিয়ে নামতেই অ্যাকশন কোরিওগ্রাফার দৌড়ে এলেন। বললেন, ‘প্রাণে বেঁচে গেছেন। এখানে তো ইলেকট্রিসিটির কোনো আর্থিং করা নেই। উল্টোপাল্টা কিছু হয়ে গেলে এসব লোহালক্করের মধ্যে পুড়ে একেবারে খাক হয়ে যেতেন।’

এ ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে শক্ত দড়ি শরীরে পেঁচিয়ে এত ঝোলাঝুলি করতে হয়েছে যে চামড়ার ভেতরে তা এঁটে বসে গভীর ক্ষত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বহু দিন আমি আঁটো হাতার কামিজ, ব্লাউজ বা পাজামা পরতে পারিনি। পায়ের পেছন দিকটায় দড়িতে কেটে যাওয়ার দাগ তো অভিনয়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে চিরস্থায়ী হয়েই থেকে গেছে।

আবির চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত বিসর্জন ছবিতে।
আবির চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত বিসর্জন ছবিতে।

অশ্রুর স্বাদ মিষ্টি
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত বিসর্জন ছবির শেষ পর্যায়ে আছে নাসিরের সঙ্গে পদ্মার বিচ্ছেদময় রাতের পর্ব। নাসির নিজের দেশে চলে যাবে। পদ্মা পড়ে থাকবে ওর বঞ্চনার জীবন নিয়ে পেছনে। খুবই আবেগপূর্ণ দৃশ্য। চিরবিচ্ছেদের আগে পরস্পরকে চুমু খাবে তারা, কিন্তু দুজনারই চোখ থাকবে অশ্রুতে আকুল। আবির চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেই দৃশ্যে আমার অভিনয়।

এ রকম দৃশ্য নিয়ে বাড়তি কোনো চাপ বা অস্বস্তি আমার ছিল না। কারণ আবির আমার খুব কাছের বন্ধু। ওর সঙ্গে বোঝাপড়া চমৎকার। কিন্তু কী কারণে যেন সেদিন আবিরের চোখে পানি আসছিল না। চোখে পানি আনার জন্য আবিরকে গ্লিসারিন নিতে হলো।

আর তাতেই ঘটে গেল বিপত্তি। গ্লিসারিনের প্রভাবে আবিরের চোখে অশ্রুর বান ছুটল। অশ্রুর সঙ্গে গ্লিসারিন মিশে নোনতা–মিষ্টি সেই চোখের পানি ঠোঁটে লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনোযোগ একেবারে লোপাট। মুখ টিপে আবিরকে গালাগাল করতে করতে ‘কাট’ শোনার অপেক্ষায় পার হতে থাকল সেদিনের শুটিংপর্ব।

ছবিতে আবেগঘন সেই চুম্বনদৃশ্য পর্দায় যেমনই দেখাক, আদতে পুরো ব্যাপারটা ছিল একদমই উল্টো।

সৌকর্য্য ঘোষাল পরিচালিত ‘ভূত পরী’ ছবির একটি মুহূর্তে।
সৌকর্য্য ঘোষাল পরিচালিত ‘ভূত পরী’ ছবির একটি মুহূর্তে।

চিতা বহ্নিমান
আগস্ট মাস। রুক্ষ লাল মাটির বর্ধমানে খাড়া দুপুর। তাপমাত্রার কাঁটা ৪৫ ডিগ্রিতে। পুরো অঞ্চলটা যেন তপ্ত কড়াই। ঝাঁ ঝাঁ করছে চারপাশ। এরই মধ্যে পড়েছে সৌকর্য ঘোষালের ছবি ভূতপরীর লোকেশন। দমবন্ধ করা অসহনীয় সেই গরমের মধ্যে আমি পরেছি ভারী কাতানের লাল শাড়ি। তার ওপর একগাদা গয়না। মুখে প্রচুর মেকআপ। রোদের ঝাঁজে চারপাশ কেমন ধোঁয়ার মতো কাঁপছে।

মড়া পোড়ানোর কারণে শ্মশানঘাটের মাটি আরও উত্তপ্ত। সেই নিষ্ঠুর গরমে দুটি চিতা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাকে আর আমার বাবার চরিত্র দুটিকে সে চিতায় পোড়ানো হবে। চিতার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি আমি। পায়ের তলায় গরম মাটি। মাথার ওপরে গনগনে সূর্য। পাশে চিতার লেলিহান শিখা। পিপাসায় আমার বুক চৌচির হয়ে যাচ্ছে। আশপাশে বাথরুমের সুবিধা নেই বলে পানিও বেশি খেতে পারছি না।

চিতার আগ‌ুনের হল্কা এসে চোখেমুখ প্রায় পুড়িয়ে দেওয়ার জোগাড়। এক সময় মনে হলো, আমার চোখ দুটি গলে যাবে, চামড়া কুঁচকে আসছে। তপ্ত বাতাসে শ্বাসও নিতে পারছি না। আমার বাবার চরিত্র যিনি করছিলেন, গরমে তিনি মূর্ছা গেলেন।

কিছুক্ষণ পর আমার চেতনা কেমন লুপ্ত হয়ে গেল। পরিচালকের যে কখন ‘কাট’ বলেছেন, কানেই ঢোকেনি।

আত্মহত্যা প্রায়
অনিমেষ আইচের জিরো ডিগ্রি ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে প্রায় মরতে বসেছিলাম। ছবিতে আমার চরিত্রের নাম সোনিয়া। নিজের প্রাণ দেওয়ার জন্য ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়বে সে। একটা রেললাইনের পাশে ক্যামেরা দাঁড় করানো হয়েছে। আশপাশে ঝোপঝাড়ের মতো। ঠিক করা হয়েছে, আমি ট্রেনলাইন ঘেঁষে দাঁড়াব। দুই হাত দিয়ে বন্ধ করে রাখব চোখ। তবে আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকব, ট্রেন কতটা কাছে এল। ট্রেন কাছে চলে এলেই আমি ঝুপ করে বসে পড়ব। ক্যামেরা এমনভাবে দৃশ্যটা ধরবে, যাতে মনে হবে আমি ট্রেনের চাকার নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েছি।

টেক শুরু হলো। আমি দাঁড়িয়ে আছি ট্রেনলাইনে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে ট্রেন দেখছি ঠিকই, কিন্তু মোটেই ঠাহর করতে পারিনি যে সেটা কত কাছে চলে এসেছে। বিপদ দেখে লোকেশনের সবাই তো অস্থির। সবাই আমাকে সরে যাওয়ার জন্য চিৎকার শুরু করল। ট্রেনের আওয়াজে সে চিৎকার কি আর আমার কানে আসে? হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, ট্রেন আমার চোখের সামনে। ভয়ে আমি দিলাম বেমক্কা এক লাফ। পা খন্দে পড়ে তালহারা হয়ে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম।

আমার করুণ পরিণতির কথা ভেবে সিনেমাটোগ্রাফার এমনই দিশাহারা হয়ে পড়লেন যে দৃশ্যটা ধারণই করতে পারলেন না। ঝুঁকি নেওয়া হলো, প্রাণ–সংশয় হলো, কিন্তু দৃশ্যটি ক্যামেরায় অধরাই রয়ে গেল।

এ দিকে আমার কোমরে অসম্ভব ব্যথা। মোটেই নড়াচড়া করতে পারছি না। ব্যথায় শরীর ছিঁড়ে যাচ্ছে। পরে জানা গেল, আমার স্লিপ ডিস্ক হয়েছে। একটা হাড় তার জায়গা থেকে সরে গেছে। পরের বছর আমি আর কোনো কাজ করতে পারিনি।

মৃত্যুদানব
নাটকের শুটিং চলছে গভীর রাতে। লোকেশন আশুলিয়া প্রধান সড়ক। বেশ আগের কথা। আশুলিয়ার রাস্তা তখনো আজকের মতো ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওঠেনি। কালেভদ্রে একটা–দুটো গাড়ি হুট করে ছুটে যাচ্ছে।

নাটকের দৃশ্যটা এমন, ছুটে আসা একটা ট্রাকের নিচে আমার চরিত্রটা নিজের জীবন বিসর্জন করতে যাবে। একদিক থেকে ছুটে আসবে ট্রাক। উল্টো দিক থেকে ছুটে যাব আমি। আমাকে বলা হলো, মোটামুটিভাবে আমার পাঁচ ফুট দূরে এসে ট্রাকটা থেমে যাবে। পরে সম্পাদনা টেবিলে তৈরি করে নেওয়া হবে আমার মৃত্যুদৃশ্য।

শুটিংয়ের জন্য একটা পিকআপ ভ্যান এল। এবার টেক। আক্ষরিক অর্থেই আমাকে মরণদৌড় দিতে হবে। নির্ভাবনায় দিলাম ছুট। রাত। দূরে অন্ধকারে দেখতে চোখে পড়ছে ভ্যানের হেডলাইট। ভ্যানের দিকে আমি ছুটছি। ভ্যানও ছুটে আসছে আমার দিকে। দৌড়াতে দৌড়াতে ভ্যানের বেশ অনেকটা কাছে যাওয়ার পর টের পেলাম, ওটার মধ্যে থামাথামির কোনো লক্ষণই নেই। হঠাৎ কেমন যেন মনে হলো, ওটার আকারও দ্বিগুণ হয়ে গেছে, দশাশই একটা ট্রাকের মতো। আমার আর ওটার দূরত্ব ততক্ষণে প্রায় নেই বললেই চলে। সামান্য সময়ও নেই যে নিজের গতি নিয়ন্ত্রণ করব বা অন্যদিকে সরে যাব। কী করব বুঝতে না পেরে শরীর বাঁকিয়ে ঝপাৎ করে দিলাম একটা ঝাঁপ। রাস্তার ডান পাশটা ঢালু। সেখানে কাদাপানিতে খাবি খেয়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে টের পেলাম, আমার নাকের ডগা দিয়ে হুট করে বেরিয়ে গেল সত্যিই একটা পাঁচটনি ট্রাক।

ব্যাপার কী? তাকিয়ে দেখি, আমাদের ছাপোষা ছোট ভ্যানটা আসছিল আসলে ওই পাঁচটনি ট্রাকের পিছু পিছু। সেটি পৌঁছানোর আগেই আমাদের একরত্তি ভ্যানটিকে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছিল আজদাহা সেই ট্রাকটা। আমি কিনা ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম সেটিরই চাকার তলায়।

অভিনয়ের অতীত
মেজবাউর রহমান সুমনের তারপরও আঙুরলতা নন্দকে ভালোবাসে টেলিফিল্মের জন্য বেশ কয়েক দিন ধরে একটা যৌনপল্লিতে আমাদের শুটিং চলে। যে মেয়েরা সেখানে যাঁরা কাজ করেন, দিনরাত বেশির ভাগই তাঁদের সঙ্গেই কাটে। দেখেছি, যৌনকর্মী হওয়ার দুঃসহ জীবনও ওদের মনের মাধুর্য কেড়ে নিতে পারেনি। কী যে প্রাণোচ্ছল ওঁরা। সামর্থ্য সামান্য, অথচ কত কী যে রান্না করে খাওয়াত। গল্প করত অবসরে, আমার চুল আঁচড়ে দিত। শুটিংয়ে অনেক সাহায্য করত। দিনের পর দিন থাকতে থাকতে কয়েকজনের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

একদিন শুটিংয়ের অবসরে বসে আছি। মিষ্টি দেখতে অল্প বয়সী একটা মেয়ে এসে আমার পাশে বসে গল্প জুড়ে দিল। একপর্যায়ে মেয়েটা হঠাৎ বলল, ‘আপনাকে একটা জিনিস দেখাই আপা?’

‘নিশ্চয়ই।’

সঙ্গে সঙ্গে সে দৌড়ে গিয়ে একটা ছবি নিয়ে এল। ও মা, সেই ছবিটিতে মেয়েটার সঙ্গে আমি আর একটা ছেলে। ছিমছাম মধ্যবিত্ত পরিবারের স্কুলের পোশাক পরা কী নিষ্পাপ মিষ্টি মুখ মেয়েটার।

আমি তো অবাক, ‘তোমার সঙ্গে কি কোথাও দেখা হয়েছিল আমার?’

মেয়েটা তখন ঘটনাটি বলল। ওর সেই ছেলেবন্ধুটির সঙ্গে একদিন বেড়াতে গিয়েছিল সংসদ ভবনে। ওখানে তখন শুটিং চলছিল আমার। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে ওরা টুকটাক কথা বলেছিল আমার সঙ্গে। সুযোগ বুঝে এক ফাঁকে ছবিও তোলে।

‘তুমি তাহলে এখানে এলে কীভাবে? তোমার ওই বন্ধুটি কোথায়?’ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করি।

মেয়েটি বলল, ওই ছেলেটিকে ভালোবেসেই ঘর ছেড়েছিল সে। পরে সেই ছেলেই তাকে এখানে নিয়ে এসে বিক্রি করে দেয়। ওর গল্প শুনে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। আমার বিহ্বলতা কাটাতে তাড়াতাড়ি উঠে গেল মেয়েটা। ওর ঘর থেকে কী একটা খাবার নিয়ে এল। হাসিমুখে এগিয়ে দিল আমার দিকে। কী নিষ্পাপ আর পরিশুদ্ধ সেই হাসি। অনুযোগের বিন্দুমাত্র চিহ্ন সেখানে নেই।

কোনো অভিনয়শিল্পীর পক্ষেই কি অমন হাসি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব!