বিলেতে কারি-বাণিজ্য

ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের আগে রসুইঘর ঘুরে যেতে ভোলেননি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। পাশে এনাম আলী
ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের আগে রসুইঘর ঘুরে যেতে ভোলেননি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। পাশে এনাম আলী

২৬ নভেম্বর, ২০১২। লন্ডনের বেটারসি পার্ক মিলনায়তনে সাজ সাজ রব। ব্রিটেনের ‘কারি অস্কার’ হিসেবে পরিচিত ‘ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড’ অনুষ্ঠান শুরু হলো বলে। মিলনায়তনজুড়ে ব্রিটেনের মন্ত্রী, এমপি, লর্ড আর তারকাদের ভিড়। মঞ্চে পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে চলছে খাবার পরিবেশনা। খাদ্য তালিকা বেশ লক্ষ করার মতো—পোলাও রাইস, মুর্গ কোরমা, গোশত নওয়াবি, চিংড়ির ঝাল ফ্রেজি। হ্যাঁ, মোটামুটি আমাদের চেনা খানাই। আর সেই চেনা খাবারই ব্রিটেনের নামীদামি লোকজন খেলেন, যাকে বলে ‘ধন্যি ধন্যি’ করে। বিলেতের অভিজাত মহলে আমাদের দেশি ঘরানার খানাপিনার কদরের কথা বহু শুনেছি, কিন্তু চোখের সামনে এমন উচ্ছ্বাস দেখলে কোন বাঙালির বুকটা না গর্বে একটুখানি উঁচু হয়?
বিলেতে আমাদের উপমহাদেশীয় কারির এই রমরমা অবশ্য এক দিনে হয়নি। ব্রিটিশদের মন জয় করতে কারিকেও পাড়ি দিতে হয়েছে দুস্তর পথ। একটা সময় খোদ ব্রিটিশরাই নাক সিটকাত কারির গন্ধে। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। আজ ব্রিটিশদের রসনা বিলাসে কারি অপরিহার্য এক নাম। বিলেতে কারির এই অগ্রযাত্রার পুরোভাগে আছেন এবং ছিলেন বাংলাদেশিরাই।
গল্পটা শুরু হতে পারে ১৮১০ সাল থেকে। সে বছরে লন্ডনের পোর্টম্যান স্কয়ারে দ্য হিন্দুস্তান কফি হাউস নামে একটি রেস্টুরেন্ট চালু হয়। এর মালিক ভারতের পাটনা থেকে আসা দীন মোহম্মদ। নামে কফি হাউস থাকলেও মূলত ভারতীয় খাবারই পরিবেশন করা হতো। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটেনে কারি ব্যবসার ব্যাপক প্রসার শুরু হয় বাংলাদেশিদের হাত ধরেই। সেই ১৯৩৬ সালে যুক্তরাজ্যে ম্যানচেস্টারে কারি রেস্টুরেন্ট চালু করেছিলেন বাংলাদেশের মৌলভীবাজার থেকে আসা বাংলাদেশি তরুণ নাজির উদ্দিন।
বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন পাউন্ডের কারি ব্যবসার সিংহভাগ বাংলাদেশিদের হাতে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যা লাখের ওপরে।
অনেকেই হয়তো জানেন না, লন্ডনে রেডফোর্ট রেস্টুরেন্টে বসেই আইফোন নামের যুগান্তরী মোবাইল ফোনটির কথা প্রথম ভেবেছিলেন অ্যাপল কম্পিউটারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস। সেন্ট্রাল লন্ডনের ব্যস্ততম এই রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেতে খেতেই জবসের মাথায় আসে আইফোনের ধারণা। ২০১১ সালে মারা যান তথ্যপ্রযুক্তির এই দিকপাল। সে বছরই এই তথ্য প্রকাশ পায় ডেইলি ইনডিপেনডেন্ট ও টেলিগ্রাফ-এর মতো পত্রিকায়। আর আমাদের জন্য আসল খবরটা হলো রেডফোর্ট রেস্টুরেন্টের মালিক যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশি আমিন আলী। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের দপ্তরে খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রেডফোর্ট। সাবেক দুই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও গর্ডন ব্রাউন রেডফোর্টের নিয়মিত খদ্দের; তালিকায় আরও রয়েছেন ডেভিড বেকহাম দম্পতি, শচীন টেন্ডুলকার, ঐশ্বরিয়া রাইসহ অনেকেই। রেডফোর্টের প্রতিষ্ঠাতা আমিন আলী বলেন, ব্রিটেনে কারিশিল্পের প্রসার বাংলাদেশিদের হাতেই। ব্রিটেনের অর্থনীতিতে কারি শিল্পের অবদান অনেক বেশি। কারি শিল্প ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের গর্বের প্রতীক।
ব্রিটেনে কারি শিল্পের প্রসারে আরেক দিকপাল এনাম আলী এমবিই। ‘কারিগুরু’ এনাম আলী ১৯৮৯ শুরু করেন তাঁর লে রাজ রেস্টুরেন্ট। সেটি এখন কারি শিল্পের অন্যতম এক গর্বের নাম। ১৯৯২ সালে ৫০ থেকে ৬০ জন অতিথি নিয়ে লন্ডন সিটি এয়ারপোর্ট থেকে দুই ঘণ্টার জন্য আকাশে ওড়ে ‘লে রাজ এভিয়ন’। সপ্তাহের প্রতি রোববার ইংলিশ চ্যানেলের ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে এই উড়ন্ত রেস্টুরেন্টে চিতল মাছের কোপ্তা ও কাচ্চি বিরিয়ানি খেতেন যাত্রীরা।
কারি শিল্পে অবদানের জন্য ২০০৯ সালে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দেওয়া এমবিই (মোস্ট এক্সিলেন্ট অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার) খেতাবপ্রাপ্ত এনাম আলী ২০০৫ সালে ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করেন। আয়োজন ও পরিবেশন-বৈচিত্র্যে অল্প কদিনে যুক্তরাজ্যে মূলধারায় আলোচনায় চলে আসে অনুষ্ঠানটি। ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডের ২০১৩ সালের আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের নিয়ন্ত্রণাধীন কারি শিল্প ব্রিটেনের জাতীয় রসনার প্রতীক।
কারি শিল্পে অবদানের জন্য ২০১২ সালে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রদত্ত এমবিই খেতাব পান বাংলাদেশ ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি বজলুর রশীদ। তাঁর মন্তব্য, ‘কারি শিল্পটি বিলেতে আমাদের বাংলাদেশিদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। আমাদের পূর্বসূরিরা বাঙালি সম্প্রদায়ের বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসার মাধ্যমে।’
১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়েশন ইউকে কারি শিল্পের উন্নয়নে রেখে চলেছে বিরাট ভূমিকা। ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সংগঠনটি।
ব্রিটেনে ইন্ডিয়ান কারি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া রেস্টুরেন্টগুলোর বাংলাদেশি মালিকেরা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট না লিখে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট হিসেবে পরিচিত করে তুলতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ডাইন বাংলাদেশ ক্যাম্পেইন’ কার্যক্রম। স্টার অব ইন্ডিয়া থেকে স্টার অব বেঙ্গল, দ্য রোজ অব ইন্ডিয়া করা হয়েছে দ্য রোজ; তাতে বাংলাদেশিদের কারি ব্যবসা থেমে থাকেনি, ভাটাও পড়েনি; সবাই যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে বাংলাদেশের নাম তুলে ধরেছেন।
ব্রিটেনে কারি শিল্প নিয়ে রয়েছে কারি লাইফ, স্পাইস বিজনেস, তান্দুরি ইত্যাদি সাময়িকীও। বছরের সেরা শেফ কারি কিং এবং সেরা রেস্টুরেন্ট নির্বাচনে রয়েছে ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড, বিসিএ অ্যাওয়ার্ড ও কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডের মতো সম্মাননা।

একনজরে ব্রিটেনে কারি বাজার
* বছরে ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন পাউন্ড ব্রিটিশ অর্থনীতিতে কারিশিল্পের অবদান
* ব্রিটেনে প্রতি সপ্তাহে ১৮ টন চিকেন টিক্কা মসালা খাওয়া হয়
* একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্রিটিশ বছরে এক হাজার ১৪৫ পাউন্ড ব্যয় করেন কারি রেস্টুরেন্টে, যা তাঁদের বার্ষিক বেতনের প্রায় ৫ শতাংশ
* জরিপে দেখা যায়, এক-তৃতীয়াংশ ব্রিটিশ কারি খেতে উদ্গ্রীব থাকেন সব সময়
* রানি ভিক্টোরিয়ার দুজন ভারতীয় পাচক ছিলেন অতিথিদের কারি পরিবেশনের জন্য
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএ)
সহযোগিতায়: উজ্জ্বল দাশ
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: সাংবাদিক