আমরা এখন এক নম্বর

গজারিয়ার পোশাকশিল্প পার্কে ব্যস্ত সময় কাটছে পোশাককর্মীদের
গজারিয়ার পোশাকশিল্প পার্কে ব্যস্ত সময় কাটছে পোশাককর্মীদের

২০২৫ সালে কেমন হবে বাংলাদেশ? বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলে সেটাই দেখার চেষ্টা করেছে প্রথম আলোর তরুণ কর্মীদল। প্রথম আলোর ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যা থেকে বাছাই করা কিছু লেখা নিয়ে এই আয়োজন।
শীতের সকাল। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার পোশাকশিল্প পার্কের মূল ফটকের সামনে অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলেন জেসমিন বেগম। ৪৪ বছর বয়সী এই নারী কাজ করেন এখানকার এক কারখানায়। শিল্পপার্কে পা রাখতেই চোখ আটকে গেল বিশাল এক ইলেকট্রনিক বোর্ডে। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি, ২০২৪-২৫ অর্থবছর। মোট ১১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে পোশাকশিল্পের রপ্তানিই ৮০ শতাংশ, আট হাজার ৯৬০ কোটি ডলার। স্থির হয়ে দাঁড়ালাম, পাশে তাকাতেই দেখি, জেসমিন তাঁর স্মার্টফোন বের করে কী যেন হিসাব করছেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে নিজেই বললেন, ‘সাত লাখ ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।’ একটু থেমে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘বিশ্বে আমরাই এখন নম্বর ওয়ান’।

‘নম্বর ওয়ান’ কথাটা কানে বাজতে বাজতে নিজের ভাবনার জানালাটা খুলে দিলাম। ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড, পরের বছর সাভারে রানা প্লাজা ধসে পোশাকশিল্পের ভিতটা নড়ে গিয়েছিল। তখন ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় কারখানার মালিকেরা ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন ইতিবাচকভাবে। সরকারের পাশাপাশি সহযোগিতার হার বাড়িয়ে দিয়েছিল বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। শ্রমিকদের নিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলো তাৎক্ষণিক বন্ধ করে, রুগ্ণ কারখানাগুলো ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করেছিলেন মালিকেরা। গজারিয়ায় হয়েছে পোশাকশিল্প পার্ক। শ্রমিকদের নিরাপত্তায় নিশ্চিত হয়েছে, প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও বেড়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। ফলে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতাও বেড়েছে একই ধারায়। ধীরে ধীরে ইতিবাচক এসব কর্মকাণ্ডের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে রপ্তানি। প্রতিযোগিতায় হেরে যায় ভিয়েতনাম, তুরস্ক ও ভারতের মতো দেশ। শেষ পর্যন্ত চীনকে হারিয়ে বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ মুকুটটি ছিনিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ।
শুধু পোশাক নয়, অন্যান্য খাতেও এগিয়েছে বাংলাদেশ। বোর্ডে তারও হিসাব আছে। হাজারীবাগ ছেড়ে চামড়াশিল্পে এখন সাভারে। ঢাকার একাংশের দূষণ বন্ধ হয়েছে। ওষুধ ও প্লাস্টিকশিল্প চলে গেছে আলাদা শিল্পপার্কে। চামড়াশিল্পের রপ্তানি এখন ২৭৪ কোটি ডলার। ২০৪ কোটি ডলার চিংড়িতে।
পোশাকশ্রমিকেরা কেমন আছেন জানতেই সাতসকালে এখানে আসা। আগেই ঠিক করা ছিল, পুরো শিল্পপার্কটি ঘুরে দেখব। জেসমিনের পাশাপাশি হাঁটি আমরা। সড়কের দুই পাশে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে আছে একেকটি কারখানা। জানতে চাইলাম, কেমন আছেন শ্রমিকেরা।
জেসমিন বললেন, ‘শিল্পপার্কের পাশেই শ্রমিকদের জন্য আছে আধুনিক আবাসনব্যবস্থা। বিনা মূল্যে চিকিত্সাসেবার জন্য আছে হাসপাতাল। সরকার ১০ বছরে তিন দফা মজুরি বৃদ্ধি করেছে। সব মালিকই সেটি মানছেন। এখন নিম্নতম মজুরি ২০ হাজার ৫০০ টাকা (সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার ওপরে দাঁড়ায়)। প্রতি মাসে অগ্নিনিরাপত্তার প্রশিক্ষণ হয়। নৈশবিদ্যালয় আছে। প্রতিটি কারখানাই দুপুরে পুষ্টিকর খাবার দেয় শ্রমিকদের। কর্মকর্তাদের আচরণও পরিবর্তন হয়েছে। মালিকদের অধিকাংশ প্রতি মাসে একবার করে শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন।’
নিজের পরিবারের কথা বলুন। জেসমিনের চোখে–মুখে তৃপ্তির ছটা। বললেন, ‘আমার এক ছেলে। ফারহান হোসেন। ফ্যাশন ডিজাইনে পড়ে। আগামী বছরেই পড়াশোনা শেষ করবে। আমরা মা–ছেলে তখন একসঙ্গেই কাজ করব।’
এতটুকু এসে জেসমিন কী মনে করে যেন থামলেন, বললেন, ‘কিছু মনে না করলে আমি আমার ছেলের সঙ্গে একটু কথা বলব। একটু পরই ও ভার্সিটি চলে যাবে। আমিও কাজে ঢুকে যাব, সারা দিনে আর কথা হবে না।’
কথা শেষে জেসমিনের এগাল–ওগাল হাসি, ‘আগের কথা মনে পড়লে হাসি পায়, বুঝলেন! আগে তো একটা মুঠোফোন ঠিকমতো চালাতেই পারতাম না! এখন অবশ্য আমাদের এখানে প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রযুক্তি তার মধ্যে একটা। এখন সব শ্রমিকই নতুন সব প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত।’
হঠাৎ পেছন থেকে অনেক মানুষের কোলাহল এল কানে। পেছনে তাকিয়ে দেখি, শ্রমিকেরা বাইরে আসছেন। হাতঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। অগত্যা জেসমিনকে বিদায় বলতে হলো। সারা দিন কয়েকটি কারখানা ঘুরে দেখে, শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকার ট্রেনে চাপলাম। আসতে আসতে কানে বাজতে লাগল, ‘আমরা এখন এক নম্বর। এক নম্বর...!’