রাশিয়ার প্রতিরোধমূলক প্রতিবিপ্লব

২০১৪ সালে ইউক্রেনের উত্থানকে পুতিন ‘বিপ্লবী মহামারির’ মতো ভয় পান। ছবি: এএফপি
২০১৪ সালে ইউক্রেনের উত্থানকে পুতিন ‘বিপ্লবী মহামারির’ মতো ভয় পান। ছবি: এএফপি

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২০১৪ সালে তাঁর দেশকে একনায়কত্বে

আলেকসান্দর এৎ​​িকন্দ
আলেকসান্দর এৎ​​িকন্দ

ফিরিয়ে আনেন। ক্রেমলিন থেকে ক্রিমিয়ায় রুশ নাগরিকেরা এখন নিশ্চয়ই লোভ, আতঙ্ক ও একনায়কত্বের বাধ্যবাধকতার সঙ্গে লড়াই করবেন, যে একনায়ক এ বছর তাঁর কর্তৃত্বের নাড়িভুঁড়ি চূড়ান্তরূপে বের করে এনেছেন।
নানা বিবেচনাতেই পুতিনের একনায়কত্ব আদিম। এর ভিত্তিমূলে সোভিয়েত-যুগের আদর্শিক প্রণোদনা নয়, রয়েছে আবেগময়তা। যদিও ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তকরণ ও পূর্ব ইউক্রেনে হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যের জন্য জনপ্রিয় বাসনায় জ্বালানি সরবরাহের চেষ্টা করেছেন পুতিন। তাঁর এ ধরনের তত্পরতা গভীর রাতে মুখোশ পরা একদল মানুষের প্রকাশ্য চুরি করার চেয়ে বেশি কিছু নয়। এই চোরদের জন্য টেকসই গৌরব লাভের সুযোগ সামান্যই।
আমার অনেক সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদ সহকর্মী দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁরা বরং জোর দিয়ে বলেন, পুতিনের সরকার রুশ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতারই একটি রূপ। তাঁদের বিশ্বাস, রাশিয়া উত্তরাধিকারসূত্রে সাংস্কৃতিক ডিএনএ পেয়েছে, যা বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যায়, যেন কিছু দূষিত জিন ইউক্রেনে (এবং, যদি পুতিনের হুমকি বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে শিগগিরই এর পরবর্তী লক্ষ্য হবে কাজাখস্তান) ক্রেমলিনের বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে তাড়িত করছে। আরেক দল বিশ্বাস করে, জাতীয় চরিত্রের মধ্য দিয়েই এই ধারাবাহিকতা কাজ করছে। ভিন্ন মত প্রকাশ করে তাঁরা বলেন, রুশরা বিশেষ চরিত্রের কারণেই পুতিনকে সমর্থন দেন। যেমন করে তাঁরা স্তালিন ও রোমানভদেরও সমর্থন দিয়েছিলেন।
এ ধরনের তীব্র মতানৈক্য নিজের মতকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে না। কারণ, সাম্রাজ্য যেমন আসে আর যায়, তাঁদের ঐতিহ্যও সেভাবেই আসা-যাওয়া করে। প্রত্যেক বিস্তারবাদী জার কিংবা কমিসার, দ্বিতীয় ক্যাথেরিন থেকে পুতিননেতা পশ্চাদপসরণের জন্য প্রস্তুত। দ্বিতীয় আলেক্সান্দর আলাস্কা বিক্রি করেছিলেন, জার্মানির সঙ্গে শান্তিচুক্তির বিনিময়ে ইউক্রেন থেকে সরে এসেছিলেন লেনিন, আর স্নায়ুযুদ্ধের ইতি টানার প্রচেষ্টা হিসেবে মধ্য ইউরোপ থেকে সেনা প্রত্যাহার করেছিলেন গর্বাচভ।
রুশরা কর্তৃত্ববাদী নেতা আকাঙ্ক্ষা করেন, এ ধরনের ধারণা ভুল। নিশ্চিত হতে, যতই বছরগুলো ঘনিয়ে আসে, পুতিনের অনুমোদন হার থাকে উচ্চ (যদিও রাশিয়ার বাজেট, রাজনৈতিক ঘোষণা বা গ্যাস সরবরাহের চেয়ে এগুলো নির্ভরযোগ্য সূচক নয়)। কিন্তু এমন যদি হয় যে জনমত জরিপগুলো সঠিক, এরপরও তাঁর জনপ্রিয়তার বিষয়ে বড় ধরনের অসংগতি ধরা পড়ে: একনায়কেরা সামাজিক চুক্তি অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করেন না, না তাঁর অবস্থান কিংবা বৈধতা জনপ্রিয় আবেদন থেকে উত্সারিত হয়।
রাষ্ট্র ও জনগণের স্বাতন্ত্র্য রাশিয়ার প্রতি পশ্চিমা নীতি নিরূপণ করেছে। ১৯৪৬ সালে তাঁর দীর্ঘ টেলিগ্রামে, যেটিকে স্নায়ুযুদ্ধের শুরু বলে গণ্য করা হয়। মার্কিন কূটনীতিবিদ জর্জ এফ কেনান বুঝেছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টি ‘রুশ জনগণের স্বভাবের প্রতিনিধিত্ব করে না।’
কোনো বিচারেই এ কথা বলা যাবে না যে, পুতিন রাশিয়ার সাবেক নেতা ইয়োসেফ স্তালিনকে অনুসরণ করছেন। স্তালিনের শাসনকালে, অত্যুত্সাহী আত্মত্যাগ ও বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদিতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। শিল্পোন্নয়ন ও সামরিক বিজয় যদিও আসছিল অগ্রহণযোগ্য মানুষের প্রাণের বিনিময়ে, কিন্তু সেটাই ছিল বাস্তব। শাসনব্যবস্থা তখন নির্ভরশীল ছিল লোক দেখানো শুনানি এবং গুলাগ (বল প্রয়োগে কাজে বাধ্য করা) শ্রমিকদের ওপর। শক্তি সংহত করতে সরকার নজিরবিহীন সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছিল ও আমলাদের ব্যবহার করেছিল। দুর্নীতি ছিল এমন এক অপরাধ, যাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।
এ যুগে দুর্নীতি হয়ে উঠেছে নিয়ম। দুর্নীতি চলছেই, তাও স্তালিনের শিল্পসংক্রান্ত মানদণ্ডে নয়। পুতিন ও তাঁর চক্রের সদস্যরা প্রধানত টিকে থাকা ও উন্নতিসাধন নিয়ে উদ্বিগ্ন। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের উত্থানকে পুতিন ‘বিপ্লবী মহামারির’ মতো ভয় পান। এর একমাত্র কারণ মস্কোর চত্বরগুলোতেও যদি একই ধরনের গণ-অভ্যুত্থান দেখা যায়, এই আশঙ্কা। ক্রেমলিনের কঠোর হস্তক্ষেপের পক্ষে প্রতিরোধমূলক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চান পুতিন।
পুতিনের সরকার পৃষ্ঠপোষকবাদের রুশ সংস্করণ ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁর সরকার রাজনৈতিক আনুগত্য বিবেচনায় সম্পদ ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। রাশিয়ায় বছরের পর বছর ধরে পদ্ধতিগত অপরাধ দেখা গেছে। দুঃখের বিষয় হলো, কোনো আন্তর্জাতিক শক্তি একে শাস্তি দিতে সক্ষম হয়নি। পশ্চিমারা—যাঁরা ভিন্নতর কিছু ভাবেন—তাঁরাও ইউক্রেনে রুশ হস্তক্ষেপকে বিনা আপত্তিতে মেনে নিয়েছেন। এর পেছনে তাঁদের নিজেদের লোভ, ভয় কিংবা আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া অন্য কোনো কারণ নেই।
বস্তুত, রাশিয়া ও এর নাগরিকদের সম্পদ ও অর্থ আত্মসাতের পর পুতিন ও তাঁর আজ্ঞাবহ গোষ্ঠীকে অবৈধ উপায়ে ইউরোপ ও মার্কিন ব্যাংক, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। মোটা অঙ্কের ফি পেয়ে পশ্চিমা কারখানাগুলোর মুনাফা বেড়েছে।
পশ্চিমাদের এই মুনাফার মুখ দেখার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ রুশদের। তাঁরা পড়েছেন অস্বস্তিতে। প্রায় ২৫ বছরের তথাকথিত ‘উদারনৈতিক’ অর্থনৈতিক নীতির পর আমদানি পণ্য থেকে ব্যাংক-বন্ধকিসহ সবকিছুই এখন পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি ব্যয়বহুল। সাম্প্রতিক অবরোধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা গোপন আঁঁতাতের কারণে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ মূলতত্ত্বগুলো কীভাবে ক্রমে দুর্বল হয়েছে, ইউক্রেন–সংকটের ফলে তা ফাঁস হয়ে গেছে। এ তো প্রায় সবাই জানেন, প্রয়োজনের তুলনায় দীর্ঘদিন ধরে অতি কম বিনিয়োগ, অতিরিক্ত প্রতারণা ও আইনের শাসনহীনতা পুতিনের রাশিয়াকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। শুধু ২০১৪ সালে যখন পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে রাশিয়া চৌর্যতন্ত্র থেকে উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেয়, তখনই পুতিন সরকারের শাসনপদ্ধতি আন্তর্জাতিক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নিজ দেশের চেহারা পাল্টে দিয়ে দেশের মানুষ, ইউরোপ ও সমগ্র বিশ্বকে সুফল পাইয়ে দেওয়ার জন্য রাশিয়া দুই দশকেরও বেশি সময় পেয়েছে। কিন্তু এর পরিবর্তে দেশটি সোভিয়েত-উত্তর মৃত্যুপুরীতেই আটকে থেকেছে। কারণ, দেশের অভিজাত গোষ্ঠীটি ঐক্যবদ্ধভাবে উত্পাদনশীল ও আইনশৃঙ্খলামুখী একটি রাষ্ট্রের উত্থান ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। অনিবার্য না হলেও ২০১৫ সালেও এ ধারাটি চলতে থাকবে বলে মনে হচ্ছে।
আলেকসান্দর এৎিকন্দ: ফ্লোরেন্সে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের ইতিহাসের অধ্যাপক। কেমব্রিজের কিংস কলেজের রুশ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাবেক রিডার।