নতুন স্নায়ুযুদ্ধ ব্যবস্থা?

স্নায়ুযুদ্ধের অবসান: ১৯৮৯ সালের নভেম্ব​ের বার্লিন প্রাচীরের পতন। ছবি: টাইম
স্নায়ুযুদ্ধের অবসান: ১৯৮৯ সালের নভেম্ব​ের বার্লিন প্রাচীরের পতন। ছবি: টাইম

২০১৪ সাল সবে শেষ হয়েছে। এ অবস্থায় মনে হচ্ছে, ইউরোপীয় ও

মিখাইল গর্বাচভ
মিখাইল গর্বাচভ

আন্তর্জাতিক যে রাজনৈতিক কাঠামো ১৯৮৯ সালের পর থেকে বিরাজ করছে, তা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। স্নায়ুযুদ্ধের পর দুনিয়ায় এমন টানটান ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। একদিকে ইউরোপে রক্তপাত হচ্ছে, অন্যদিকে পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার ফলে দৃশ্যপটে মধ্যপ্রাচ্যের আবির্ভাব ঘটেছে। সব দেখে মনে হচ্ছে, দুনিয়া দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের প্রান্তে উপনীত হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, স্নায়ুযুদ্ধ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
অন্যদিকে দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থা, অর্থাৎ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, গোলাগুলি ও হত্যাকাণ্ড বন্ধে কোনো ভূমিকা পালন করেনি বা সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি বললেই চলে। তারা কেন পরিস্থিতি মূল্যায়নে কোনো সংকল্প নিয়ে কাজ করেনি বা যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করেনি?
আমার ধারণা, এর একটি প্রাথমিক কারণ হতে পারে, স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়ে তারা যে আস্থা অর্জন করেছিল, তা হারিয়ে ফেলেছে। সে রকম আস্থা ছাড়া আজকের বিশ্বায়িত দুনিয়ায় শান্তিপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব নয়।
কিন্তু এ আস্থা তো আর গতকাল ধূলিসাৎ হয়নি। অনেক আগেই হয়েছে। আজকের পরিস্থিতির গোড়াটি নিহিত রয়েছে ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকের ঘটনায়।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের মধ্য দিয়ে আসলে নতুন ইউরোপ ও নিরাপদ বিশ্বব্যবস্থার গোড়াপত্তন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নতুন ইউরোপীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ও ইউরোপের অসামরিকীকরণ না করে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে। ন্যাটোর ১৯৯০ সালের ঘোষণায় এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমা নেতাদের মাথায় মঙ্গল ও বিজয়ের ধারণা জেঁকে বসে। রাশিয়ার দুর্বলতা ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষের অভাবে বৈশ্বিক নেতৃত্বে একক কর্তৃত্ব দাবির কুফল সম্পর্কে যে সতর্কবার্তা তাদের দেওয়া হয়েছিল, পশ্চিম তাতে কর্ণপাত করেনি।
গত কয়েক মাসে যা ঘটেছে, তা আসলে নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ও অংশীদারদের স্বার্থের দিকে দৃষ্টি না দেওয়ার কারণে ঘটেছে। এটা ক্ষীণদৃষ্টি। এ ধরনের যেসব কাজ করা হয়েছে এবং যা আর পাল্টে দেওয়া যাবে না তার সংক্ষিপ্ত তালিকা এ রকম: যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধ (বিশেষত কসোভোয়), ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা এবং ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ার ঘটনা। ফলে যা ছিল ফোস্কা, তা পরিণত হয়েছে গভীর এক ক্ষতে।
এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইউরোপ। পরিবর্তনে নেতৃত্ব না দিয়ে এ মহাদেশটি হয়ে উঠেছে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। প্রভাব বিস্তারে বাসনা ও সামরিক দ্বন্দ্বে মহাদেশটি একেবারে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। ইউরোপ এমন সময়ে দুর্বল হচ্ছে, যখন শক্তির অন্য কেন্দ্রগুলো শক্তিমান হয়ে উঠছে। এটা চলতে থাকলে ইউরোপ বিশ্ব-রাজনীতিতে তার গুরুত্ব হারাবে ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে।
১৯৮০-এর দশকের অভিজ্ঞতা সামনের পথে চলার জন্য আমাদের পাথেয় হয়ে উঠছে, এটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। সে সময়ের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আজকের চেয়ে কম বিপজ্জনক ছিল না। কিন্তু না, সে সময়ে আমরা শুধু সম্পর্কই স্বাভাবিক করিনি, স্নায়ুযুদ্ধের যবনিকা টেনেছিলাম। মুখ্যত, আলোচনার মাধ্যমেই আমরা তা অর্জন করেছিলাম। কিন্তু আলোচনার ভিত্তি হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা।
আজ সবার আগে আলোচনার ওপরই অগ্রাধিকার দিতে হবে। মিথস্ক্রিয়া, অর্থাৎ একে অপরের কথা শোনার মনোবাসনা আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। এখন যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তা বেশ প্রতিশ্রুতিশীল। প্রাথমিক চেষ্টায় অবশ্য খুবই সামান্য ও নাজুক ফলাফল পাওয়া গেছে: যুদ্ধবিরতিতে মিন্স্ক্ চুক্তি, ইউক্রেন থেকে সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার, রাশিয়া, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় গ্যাস চুক্তি এবং পারস্পরিক অবরোধ আরোপের ওপর লাগাম দেওয়া।
তর্কাতর্কি ও পারস্পরিক দোষারোপ থেকে বেরিয়ে এসে ক্রমাগত অবরোধ প্রত্যাহারের এবং একটি মিলনবিন্দুতে পৌঁছানোর জন্য আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বর্তমান সংস্কৃতি উভয় পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংসদেরা তথাকথিত ব্যক্তিগত অবরোধের শিকার হন। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তথাকথিত এই ব্যক্তিগত অবরোধ তুলে নিতে হবে, যাতে তাঁরা পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসতে পারেন। এই সংযোগের একটি ক্ষেত্র হতে পারে ইউক্রেন। ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের পরিণাম থেকে উঠে এসে পুরো এলাকাটি পুনর্গঠনে সহায়তা করা যেতে পারে।
বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ ও প্যান-ইউরোপীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও এটা সত্য। সন্ত্রাসবাদ, দারিদ্র্য, অসমতা, জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন, মহামারি ইত্যাদির মতো আজকের প্রধান প্রধান বৈশ্বিক সমস্যা প্রতিদিনই খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। এগুলো পরস্পরের থেকে আলাদা হলেও তাদের মধ্যে একটি অভিন্নতাও রয়েছে। এগুলোর কোনোটিরই সামরিক কোনো সমাধান নেই। এসব সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক পদ্ধতি হয় কাজ করছে না, অথবা আদতে তা নেই। যদিও চলমান সমস্যার গুরুত্ব আমাদের অবিলম্বে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে টেকসই মডেল গ্রহণে প্ররোচিত করছে।
ইউরোপের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্যান-ইউরোপীয় সমাধানই কেবল কার্যকর হবে। ন্যাটো সম্প্রসারণ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিরক্ষানীতির মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করা হলে তাতে উল্টো ফল হতে পারে। আমাদের আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান ও কার্যসমাধান পদ্ধতি প্রয়োজন, যা অন্তত সবাইকে আশ্বস্ত করতে পারবে।
এ ক্ষেত্রে অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ নামের প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনেক আশাবাদ থাকলেও তা শেষমেশ প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি। তার মানে এই নয় যে, তার বদলে নতুন কিছু আনতে হবে। যেহেতু তা ইউক্রেনে নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটির সংস্কার করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, এই পুনর্গঠনের প্রয়োজন আছে।
বছর কয়েক আগে সাবেক জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হান্স ডিয়েট্রিচ জেনশার, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেন্ট স্কোক্রফ্ট্ এবং অন্যান্য নীতিপ্রণেতারা ইউরোপের জন্য একটি নিরাপত্তা পরিষদ অথবা ডিরেক্টরেট গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একইভাবে, রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ কোনো রাষ্ট্রের প্রতি হুমকির ক্ষেত্রে ইউরোপের নিবৃত্তিমূলক কূটনীতি গ্রহণ ও ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বাধ্যতামূলক পরামর্শের প্রস্তাব করেছিলেন। এ জাতীয় একটি পদ্ধতি গড়ে উঠলে ইউক্রেনে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটল, তা হয়তো এড়ানো সম্ভব হতো।
এসব ‘ইউরোপীয় কল্পনা’ মহাফেজখানায় ফেলে রাখার দায় রাজনৈতিক নেতাদের ঘাড়ে অবশ্যই বর্তাবে। কিন্তু ইউরোপের অন্যান্য রাজনৈতিক শ্রেণি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সংবাদমাধ্যমের ওপরও এই দায়ভার এসে পড়বে।
আমি খুব আশাবাদী মানুষ। তার পরও এ সময়ে এসে নৈরাশ্যবাদী না হওয়া খুব কঠিন। তবু আতঙ্ক ও হতাশার কাছে আমাদের আত্মসমর্পণ করা ঠিক হবে না। নেতিবাচক জড়তায়ও নিমজ্জিত হওয়া যাবে না। গত কয়েক মাসের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আলোচনা ও সহযোগিতার সদিচ্ছা সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন।
আমাদের সব নেতার কাছে এই আমার আবেদন। আসুন, ২০১৫ সালের জন্য আমরা ভাবি, প্রস্তাব দিই ও একসঙ্গে উদ্যোগ নিই।
মিখাইল গর্বাচভ: সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বেশষ প্রেসিডেন্ট; শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী।