মন চাইত শুধু খেলাধুলা করতে

ছবি: খালেদ সরকার
ছবি: খালেদ সরকার

ছোটবেলায় আমার লেখাপড়ায় মন বসত না। খুব ঝোঁক ছিল ফুটবল খেলার প্রতি। ইচ্ছা ছিল ঢাকায় গিয়ে ফুটবল খেলব ভালো কোনো দলে। জাতীয় দলেও খেলার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু মা-বাবা বলতেন, ‘আকবর, খেলাধুলায় কোনো ভবিষ্যৎ নাই। লেখাপড়ায় মন দাও।’ আর দশজন বাবা-মায়ের মতো তাঁদেরও ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শিখে ছেলে ‘মানুষ’ হবে, চাকরি করবে।
কিন্তু আমার মন শুধু চাইত খেলাধুলা করতে। পড়ালেখায় ফাঁকি দিয়ে ফুটবল খেলতাম। সে জন্য এসএসসির পর আর পড়ালেখা হয়নি। কিন্তু বাড়ির প্রতিকূল পরিবেশ আর সুযোগ-সুবিধার অভাবে ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবেও বেশিদূর যেতে পারিনি, সাতক্ষীরার গণ্ডিই পেরোনো সম্ভব হয়নি। কিন্তু মনের মধ্যে একটা ভাবনা রয়েই গেল: নিজে না পারলেও একদিন এলাকার ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা শেখাব। তাদের নিয়ে বড় কিছু করব।
এর মধ্যে ঘটে অন্য ধরনের একটা ঘটনা। ২০০০ সালে সাতক্ষীরায় ব্যাপক বন্যা হয়। মানুষ ডুবে যাওয়া ঘরবাড়ি ছেড়ে স্কুল-কলেজ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ও উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নেয়। স্কুলঘর, বারান্দা কিংবা খোলা আকাশের নিচে নারী, শিশু, বৃদ্ধ—সব বয়সী মানুষের সীমাহীন কষ্ট ও দুর্ভোগ দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। বিশেষ করে শিশু আর বৃদ্ধদের কষ্টের কথা বর্ণনা করার মতো নয়। বন্যার পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, একটা প্রবীণ নিবাস ও অনাথ আশ্রম গড়ে তুলব।
ওই বছর বাটকেখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার কক্ষবিশিষ্ট একটা পুরোনো ভবন কর্তৃপক্ষ ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। ভাঙা ভবনটির ইট, রড, কাঠ ইত্যাদি বিক্রি করা হবে। আমি টেন্ডারের মাধ্যমে ভবনটা কিনে নিলাম। তাদের সঙ্গে মৌখিকভাবে বোঝাপড়া হলো, ১০ বছর পর্যন্ত ভবনটা না ভেঙে ব্যবহার করতে পারব। সেখানেই শুরু করলাম প্রবীণ নিবাস ও অনাথ আশ্রমকেন্দ্র। জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন চৌধুরী সেটা উদ্বোধনও করলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে এলাকার কেউ কেউ অসহযোগিতা শুরু করে। শেষে ২০০৪ সালে স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে পুরোনো ভবনটা ভেঙে নিতে বাধ্য করে। ফলে প্রবীণ নিবাস ও অনাথ আশ্রমটি আর চালাতে পারিনি।
আবার ফিরে এল খেলাধুলার ভাবনা। ২০০৫ সালের প্রথম দিকে ভাবলাম, মেয়েদের খেলাধুলার দিকে টানলে কেমন হয়। কিন্তু কাজে নেমে দেখতে পেলাম সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারগুলো তাদের মেয়েদের খেলাধুলায় আসতে দিতে চায় না। তখন দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মেয়েদের কথা ভাবলাম। কিন্তু সাতক্ষীরার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ অনুকূল ছিল না। মেয়েদের খেলার মাঠও ছিল না। স্থানীয় কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রস্তাব দিলাম বিদ্যালয়ের গরিব মেয়েদের খেলাধুলা শেখাতে চাই। তারা সরাসরি ‘না’ বলে দিল। কিন্তু হতাশ হলাম না, হাল ছাড়লাম না। ঠিক করলাম, নিজের দুই মেয়েকে দিয়েই শুরু করব। আমার দুই যমজ মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস রিক্তা ও ফতেমাতুজ জোহরা মুক্তা ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠল।
২০০৬ সালে সাতক্ষীরা শহরের শেষ প্রান্তে বাগানবাড়ি এলাকায় নিজের বাড়িতেই খুললাম খেলাধুলার একটা পাঠশালা। নাম দিলাম ‘জ্যোতি ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’। সেই পাঠশালার প্রথম দুই শিক্ষার্থী আমার দুই মেয়ে রিক্তা ও মুক্তা। কিছুদিনের মধ্যে তাদের সঙ্গে যোগ দিল তাদের ১১ জন বান্ধবী, তারাও স্কুলে পড়ত। তাদের প্রথমে হ্যান্ডবল খেলা শেখানো দিয়ে শুরু করলাম। ওই বছর কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হয়ে খেলে হ্যান্ডবলে জেলা চ্যাম্পিয়ন হয় আমার দল। সেই থেকে হ্যান্ডবলে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জেলা চ্যাম্পিয়ন কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
সিদ্ধান্ত নিলাম আমার পাঠশালায় খেলাধুলা শিখতে ইচ্ছুক গরিব মেয়েদের খাওয়া ও থাকার পাশাপাশি লেখাপড়া শেখাব। পাঠশালার এখন ১১ জন নারী খেলোয়াড় আছে। তাদের চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয়। বাড়িতে তাদের পরিচর্চা করে আমার স্ত্রী রেহেনা আক্তার আর মাঠে আমি। যখন সবাই বলে, ওরা আকবরের মেয়ে, তখন আমার খুব ভালো লাগে। এখন জাতীয় ফুটবল দল, বয়সভিত্তিক ফুটবল, ভলিবল, কাবাডি, সাইকেল চালানো ও অ্যাথলেটিকসে জাতীয় পর্যায়ে ১৫ জন খেলছে। তার মধ্যে বিজিএমসি, নেভি ও আনসারে ১৩ জন চাকরি করছে। আমার পাঠশালায় জাতীয় মহিলা ফুটবল দলে খেলে সেরা স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুন, সেরা মিডফিল্ডার মিরোলা ছাড়াও রয়েছে রওশনারা, সুরাইয়া ও মাসুরা। বয়সভিত্তিক ১৯ দলে রয়েছে রিক্তা, মুক্তা, রুমা ও লিজু। ১৬ দলে রয়েছে রাজিয়া ও সারমিন। জাতীয় মহিলা কাবাডি দলে রয়েছে পাখি, তাসলিমা, মাসুরা ও রওশনারা। দেশের দ্রুততম মানবী শিরিনা আক্তারও আমার পাঠশালার ছাত্রী। ফুটবলে আক্রমণভাগে রাজিয়া, রক্ষণভাগে মাসুমা ও শারমিন এবং মধ্যমাঠে আফিয়াদের গড়ে তোলা সাবিনার আদলে। সাইক্লিংয়ে নাসরিন ও মৌসুমী ভালো করছে। মেয়েদের অনুশীলন করাই সাতক্ষীরা শহরের পাঁচিলঘেরা পিটিআইয়ের মাঠে।
সাতক্ষীরার মতো জায়গায় মহিলা খেলোয়াড় তৈরি করার স্বপ্ন দেখা ছিল একটা কঠিন ব্যাপার। খেলাধুলা তো ছেলেদের কাজ। মেয়েরা কেন খেলাধুলা করবে—এটাই হচ্ছে সমাজের সাধারণ মনোভাব। কিছু লোক বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বলত, যেন মেয়েদের খেলার মাঠে না পাঠানো হয়। একসময় মেয়েরা মাঠে আসা বন্ধ করে দেয়। এমনও দিন গেছে, যখন আমার প্রশিক্ষণ পাঠশালায় শুধু আমার নিজের দুই মেয়ে ছাড়া আর কেউ ছিল না।
কিন্তু আমি হাল ছাড়লাম না। আমার স্ত্রী ও আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের মা-বাবাদের বোঝাতে লাগলাম। শিক্ষিত, ধনী বা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে কোনো সাড়া পেলাম না। গরিব ও অশিক্ষিত অভিভাবকদের বোঝালাম, একদিন তোমাদের মেয়েরা খেলাধুলা শিখে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে। কারণ, খেলাধুলায় সাফল্য দেখাতে পারলে কিছু অর্থও পাওয়া যায়। এভাবে কয়েক দিন ঘোরাঘুরি করার পর কাজ হলো। অভিভাবকেরা আবার তাঁদের মেয়েদের মাঠে পাঠানো শুরু করলেন।
২০০৬ সালে মেয়েদের থাকার জন্য বাড়ির পাশে একটি আধা পাকা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলাম। ২০১০ সালের পর আর্থিক অনটনের কারণে বাড়িটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। বর্তমানে বাবার ভিটায় তৈরি করা একটি জীর্ণ ঘরে মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা করেছি। আমিও থাকি স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে একটি জীর্ণ ঘরে। শ্বশুরবাড়ি থেকে বছর বছর চাল দেয়। বড় ভাই আইয়ুব আলী ও বাবা মো. ফজর আলীও নানাভাবে সহযোগিতা করেন। দুই মেয়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, পাশাপাশি খেলোয়াড় হিসেবে বিজিএমসিতে চাকরি করে। আমিও মেয়েদের ফুটবল প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি করি বিজিএমসিতে। তিনজনে মিলে ২৪ হাজার টাকা বেতন পাই। এখানে-ওখানে দল নিয়ে খেলতে গেলে কিছু টাকা পাই। সব মিলিয়ে হাজার ত্রিশেক টাকায় চলে জ্যোতি ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
পাঠশালায় সুনির্দিষ্ট একটি খেলার মধ্যে কাউকে সীমাবদ্ধ রাখি না। ফুটবল, হ্যান্ডবল, ভলিবল, অ্যাথলেটিকস, খোখো—সব খেলার চর্চা করাই। যার মধ্যে যে খেলার ব্যাপারে সম্ভাবনা দেখি, তাকে সেই খেলায় দক্ষ করে তোলার চেষ্টা করি। সাবিনা শুরু করেছিল ভলিবল দিয়ে। সে ভলিবল ও কাবাডি ভালো খেলত। কিন্তু ওর মধ্যে সম্ভাবনা দেখেছিলাম ফুটবলের। ওর ফুটবলের ওপর জোর দিলাম বেশি। সফলও হলাম। সাবিনা এখন দেশের এক নম্বর নারী ফুটবল তারকা। সে এ বছর মালদ্বীপে গিয়ে ফুটবল লিগে পুলিশ দলের হয়ে খেলে ছয় খেলায় করেছে ৩৭ গোল। সেরা গোলদাতার সম্মান পেয়েছে। পাঁচটি ম্যাচে পরপর সেরা খেলোয়াড় হয়েছে। একটা গোল করে সাবিনা, আর আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠি।
আমার এখন খুব আনন্দ হয়, যখন দেখি সাতক্ষীরায় প্রচুর ছেলেমেয়ে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে অজস্র ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান। সাতক্ষীরাকে এখন খেলাধুলার শহর বললে ভুল হবে না। অথচ একসময় মেয়েদের খেলাধুলায় টানতে গিয়ে কত বাধার সম্মুখীন হয়েছি। আমার বিরুদ্ধে মিছিল পর্যন্ত হয়েছে, অনেক হুমকি দেওয়া হয়েছে আমাকে। আজ আর সেই অবস্থা নেই। তবে অভিজাত ও শিক্ষিত পরিবারগুলো এখনো মেয়েদের খেলাধুলায় আসতে দেয় না। কিন্তু সেটা নিয়ে আমার তেমন চিন্তা নেই। আমি সব সময় ভেবেছি গরিব ঘরের মেয়েদের কথা। খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা, একই সঙ্গে মাথা উঁচু করে চলতে শেখানো। এই কষ্টকর দীর্ঘ সংগ্রামে সব সময় পাশে থেকেছে আমার স্ত্রী। মেয়েদের নিয়ে আমার সঙ্গে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যায়। আমি দলের কোচ আর সে ম্যানেজার। পুরো পরিবার খেলাধুলার সঙ্গেই আছি।
আমি স্বপ্ন দেখি জ্যোতি ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আরও বড় করার। একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলতে চাই। সাংস্কৃতিক চর্চা ছাড়া জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। তাই আগামী দিনে ক্রীড়ার পাশাপাশি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো আমার একমাত্র লক্ষ্য। (অনুলিখন)
আকবর আলী, ক্রীড়া উদ্যোক্তা, সাতক্ষীরা