নারীর নিরাপত্তায় 'নিবেদিতা'

ছবি: সাইফুল ইসলাম
ছবি: সাইফুল ইসলাম

বলতে গর্ব হয়, জন্মই আমার বিমা পরিবারে। বিমাজগতের সব জটিল বিষয় শুনতে শুনতেই আমি বড় হয়েছি। এখন আমি গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। কঠিন দায়িত্ব আমার। আর এই গুরুদায়িত্ব একসময় আমার বাবা নাসির এ চৌধুরী পালন করতেন।
গ্রিন ডেল্টার সঙ্গে আমি জড়িত ১৫ বছরের বেশি সময়। কিন্তু এমডি হিসেবে যোগ দিই ২০১৩ সালে। আমি এমডি হওয়ার আগে দেশে আর কোনো নারী কোনো ইনস্যুরেন্স কোম্পানির এমডি ছিলেন না। প্রথম প্রথম চ্যালেঞ্জিং লাগত। মনে হতো, পারব তো? বাবা সাহস দিয়েছেন। আমার যেকোনো বিপদ বা চ্যালেঞ্জের পাশেই বাবা যেমন দাঁড়ান, এখানেও তাই। আমার ভয়টা ছিল এখানে যে আমাদের সমাজে একজন নারীকে শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়। নারীদের জন্য প্রতি পদক্ষেপেই অপেক্ষা করে বাধা। কিন্তু তা উপেক্ষা করতে হয়। সবার দোয়া আর নিজের আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি এবং কাজে মজা পাচ্ছি। মাথায় নিত্যনতুন ধারণা আসছে। টুকটুক করে বাস্তবায়নও করছি।
এবার একটু পেছনে ফিরতে চাই। গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি দেশের বিমাজগতের একমাত্র এএএ ক্রেডিট রেটিংপ্রাপ্ত কোম্পানি। কীভাবে সম্ভব হলো? সাধারণ মানুষের তো বিমা বিষয়েই নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। গ্রিন ডেল্টার যাত্রা শুরু ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি। শুরু থেকেই সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স। প্রতিষ্ঠাতা এমডি ও সিইও নাসির এ চৌধুরী। নিজের বাবা বলে বলছি না, গুটি কয়েকজনের সঙ্গে তাঁকেও আখ্যা দেওয়া হয় ‘বিমাজগতের কিংবদন্তি পুরুষ’ হিসেবে। এখনো যিনি বিমা খাতের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। গ্রিন ডেল্টার উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর উপদেশ গ্রিন ডেল্টার চলার পথের পাথেয়।

দেশের মোট জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ নারী অথচ নারীরাই জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থে্যর কথা চিন্তা করেই এই পলিসি আনা হয়েছে। নিবেদিতার মাধ্যমে একজন নারী অ্যাসিড-সন্ত্রাস, ধর্ষণ এবং অন্যান্য বিপদে কাভারেজ- সুবিধা পাবেন

দেশের নন-লাইফ বা সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে গ্রিন ডেল্টা কৃতিত্বের সঙ্গে শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে বহু বছর ধরেই। বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সঙ্গে আমাদের ইক্যুইটি পার্টনারশিপ চুক্তি রয়েছে, যা এ দেশে প্রথম। ব্যবসা ভালো। দেশে-বিদেশে মর্যাদাও পাচ্ছি। বড় কোম্পানি। তারপরও এমডির দায়িত্ব নিয়ে ভাবলাম, এখানেই শেষ নয়। আরও বড় হতে হবে। থেমে থাকলে চলবে না। নতুন কিছু করতে হবে। আমাদের অর্থনীতিতে বিমা খাতের গুরুত্ব বেশি, কিন্তু অবদান কম। এই বিষয়টা খুব পীড়া দেয়। সব সময়ই মনে হয় যে বিমা খাতে যথাযথ শিক্ষার খুব অভাব। বিমা সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণা খুবই প্রকট। সবার মাঝেই একধরনের ভয় কাজ করে, নিশ্চয়ই বিমা কোম্পানিগুলো আমাদের টাকা হাতিয়ে নেবে। খেয়াল করি যে সবার মনেই একধরনের অনীহা। অথচ বিমা যে আমাদের কত অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে, আমরা অনেকেই তা বুঝতে পারি না। আমি আমার সহকর্মীদের সঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। বহু গবেষণাপত্র পর্যালোচনা করেছি। ধীরে ধীরে আমি আমার নতুন কিছু চিন্তা নিয়ে আসি এই খাতে।
এটা ঠিক যে দেশের বিমা এখনো অপরিণত। মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ বিমার আওতায় পড়ে। এর বড় কারণ বিমা খাতে জনসচেতনতার অভাব। মোটা দাগে কেউই বিমা পলিসি কিনতে চান না। আমার মাথায় একটাই চিন্তা। নেতিবাচক ধারণা দূর করতে হবে। আমরা এটা উদ্যোগ নিয়ে নাম দিয়েছি ‘সবার জন্য বিমা’। ১৬ কোটি মানুষের দোরগোড়ায় আমরা এ ধারণা পৌঁছে দিতে চাই। উদ্যোগটি বাস্তবায়নে আমরা ‘রিটেইল ইনস্যুরেন্স’ নামে একটি বিভাগ চালু করেছি। এ ধারণাটিও আমাদের দেশে নতুন। সাধারণত এ দেশে করপোরেট ইনস্যুরেন্সকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
গ্রিন ডেল্টার নতুন ও আকর্ষণীয় কিছু প্রোডাক্টের কথা না বললেই নয়। প্রথমেই বলতে হয় নিবেদিতার কথা। নিবেদিতা শুধু নারীদের জন্য একটি সমন্বিত (কম্প্রিহেনসিভ) বিমা পলিসি। বাংলাদেশে এ ধরনের পলিসি এটাই প্রথম। দেশের মোট জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ নারী অথচ নারীরাই জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করেই এই পলিসি আনা হয়েছে। নিবেদিতার মাধ্যমে একজন নারী অ্যাসিড-সন্ত্রাস, ধর্ষণ এবং অন্যান্য বিপদে কাভারেজ-সুবিধা পাবেন। এ ছাড়া গর্ভকালীন অবস্থায় মৃত্যুসহ অন্যান্য দুর্ঘটনায়ও নারীরা বিমার আওতায় আসবেন। নিবেদিতা একজন নারীর সঙ্গী হিসেবে কাজ করে তাঁদের আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়তা করে। নারীদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিয়ে আমরা একটি ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু করতে চাইছি, যার মাধ্যমে নারীরা সব বিপদ-আপদে তাৎক্ষণিক সহায়তা পাবেন। আমি সব সময়ই নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করে আসছি। আজীবন কাজ করে যাব বিমাজগতে, দেশের প্রথম নারী ও কনিষ্ঠতম এমডি হিসেবে এ আমার প্রতিজ্ঞা।
নিবেদিতা ছাড়াও আমি নারীদের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত। আমি বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির একজন পরিচালক। সম্প্রতি নারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদানের জন্য ‘উইংস’ নামে একটি সহায়তা দল গঠন করা হয়েছে। আমি উইংসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। আছে ‘জিডি হেলথ’ নামের আরেকটি উদ্যোগ। ‘নিরাময়’ আমাদের একটি ক্ষুদ্র ইনস্যুরেন্স প্রকল্প, যা দেশের গ্রামাঞ্চলের কথা ভেবে তৈরি। ‘সুদিন’ বাংলাদেশের পোশাককর্মীদের জন্য একটি মাইক্রো ইনস্যুরেন্স পলিসি। সব সময়ই ভাবি, পোশাককর্মীরা এ দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তাঁদের সুরক্ষা দেওয়া আমাদের জন্য সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বিমা পলিসিও বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আমরা নিয়ে এসেছি। ওয়েদার ইনডেক্স বেসড এগ্রি ইনস্যুরেন্স আমাদের একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প। এতে আংশিকভাবে আইএফসি অর্থায়ন করেছে। আমি সব সময়ই দেশের যুবসমাজ এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করতে পছন্দ করি। তাদের কথা মাথায় রেখে একটি বিমা পলিসি নিয়ে এসেছি, যার নাম ‘পিপলস পার্সোনেল অ্যাকসিডেন্ট ইনস্যুরেন্ট পলিসি’। এই পলিসি সর্বনিম্ন প্রিমিয়ামে এক বছরের জন্য বিমা-সুবিধা দিচ্ছে।
আমি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট নির্বাচিত ইন্টারন্যাশনাল উইমেন লিডারস মেন্টরিং পার্টনারশিপ প্রোগ্রামে ১৭ জন নারীর একজন ছিলাম। সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি কনফারেন্সে ছিলাম একজন প্যানেলিস্ট। ওখানে বিমার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমার বক্তব্য তুলে ধরি।
আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্সে দুটি নতুন অঙ্গসংগঠনের সূচনা করি। প্রফেশনাল অ্যাডভান্সমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, যা যুক্তরাজ্যের চার্টার্ড ইনস্যুরেন্স ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। আরেকটি হচ্ছে জিডিএসিস্ট। এর মাধ্যমে আমরা মালয়েশিয়া হেলথ কেয়ার ট্র্যাভেল কাউন্সিলের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছি।
গ্রিন ডেল্টার বর্তমান অবস্থান আমাকে স্বাভাবিকভাবেই গর্বিত করে। আর, যাঁদের ত্যাগ-তিতিক্ষায় এ অবস্থান, তাঁদের প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতা। সততা ও নিষ্ঠা একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবার মধ্যে থাকাটাই জরুরি। আমি বিশ্বাস করি, গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্সে তা আছে। আমি এ-ও বিশ্বাস করি, মেধাবী নারীরা দিন দিন বিমা খাতকে পেশা হিসেবে বেছে নেবেন। কারণ, এ খাতটি এখনো দেশের অর্থনীতির অন্যতম খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার অপেক্ষায়।
ফারজানা চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক
গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি