মিরপুর শত্রুমুক্ত করার অভিযান

মুক্তিযোদ্ধারা অভিযানে যাচ্ছেন, ১৯৭১
মুক্তিযোদ্ধারা অভিযানে যাচ্ছেন, ১৯৭১

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের পরপর মিরপুর এলাকায় বিহারি রাজাকার ও লুকিয়ে থাকা বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈন্যের সংগঠিত প্রতিরোধ সদ্য স্বাধীন দেশের নিরাপত্তা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। পাকিস্তানিদের সরবরাহ করা বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ মিরপুরের বিহারিদের হাতে ছিল। বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈন্য, ইপিসিএএফ ও মুজাহিদ সদস্য বিহারিদের বাসাবাড়িতে লুকিয়ে থেকে তাদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছিল। মিরপুরের বিহারিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে এই অবস্থা মেনে নেওয়ার কোনো কারণ ছিল না। বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী মিরপুরের অচলাবস্থা কাটাতে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল, চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে মিরপুরে মোতায়েনের আদেশ দিলেন।
আমি তখন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক। আমার ব্যাটালিয়ন ছিল জয়দেবপুর রাজবাড়িতে। আদেশ পেয়ে আমি জয়দেবপুরে ব্যাটালিয়নের একটি ক্ষুদ্র অংশ বা রিয়ার পার্টি রেখে বাকি ব্যাটালিয়ন নিয়ে মিরপুরে গেলাম। মিরপুরের ১০, ১১ ও ১২ নম্বর সেকশনের দায়িত্ব দেওয়া হলো দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলকে। ৫ ও ৬ নম্বর সেকশনের দায়িত্ব দেওয়া হলো নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আর আমার ব্যাটালিয়নের দায়িত্বে দেওয়া হলো ১ ও ২ নম্বর সেকশন।
দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন যথাক্রমে মেজর মইনুল হোসেন (পরে মেজর জেনারেল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) ও মেজর আইনুদ্দীন (পরে মেজর জেনারেল)। আমাদের স্ব স্ব এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মিরপুরের চলমান অরাজক অবস্থার অবসান ঘটিয়ে সেখানে বাংলাদেশ সরকারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব দেওয়া হলো।

রেকি ও সৈন্য মোতায়েন
মিরপুর পৌঁছে সেখানকার বিজ্ঞান একাডেমির একটি ভবনে আমাদের সদর দপ্তর স্থাপন করলাম। প্রথম দিনেই চেষ্টা করলাম ১ ও ২ নম্বর সেকশন এলাকা নিজে রেকি করে বিহারিদের অবস্থান কতটা শক্ত সেটা আন্দাজ করতে। আমি আশ্চর্য হলাম যে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই বিহারিরা স্বয়ংক্রিয়, আধা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, এলএমজি ও স্টেনগান নিয়ে বেশ শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। আমি ১ নম্বর সেকশনে মিরপুর মাজারে দুটি কোম্পানি এবং ২ নম্বর সেকশনে একটি পরিত্যক্ত পুকুরের চারপাশে দুটি কোম্পানিকে অবস্থান নিতে নির্দেশ দিলাম। আমার কোম্পানিগুলোর অবস্থান তদারক করার সময় আমি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালিদের ওপরে চালিত বিহারিদের নিষ্ঠুর গণহত্যার কিছু নিদর্শন স্বচক্ষে দেখতে পেলাম।
মাজারের পাশেই ছিল একটা মজা পুকুর। দেখতে পেলাম, পুকুরপাড়ের নানা জায়গায় মাটি খোঁড়া। ওই আলগা মাটি সরালেই দু-একটা মানুষের লাশ পাওয়া যেতে লাগল। একটি জায়গায় দেখলাম, মাটির নিচ থেকে একটা মহিলার কাচের চুড়িপরা হাত বেরিয়ে আছে! মাটিগুলো সরিয়ে ফেলার পর তাঁর মৃতদেহটি বেরিয়ে এল। শুধু ব্লাউজ পরা নগ্ন মৃতদেহ। তাকে জবাই করা হয়েছিল। বীভৎস দৃশ্য!
সেই হতভাগিনীর লাশ কবর থেকে ওঠাতেই ছোট্ট শিশু কোলে কাছের টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোক ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘স্যার, এটা আমার স্ত্রীর লাশ। আমার কোলের শিশুটির মা।’ আমি তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলাম না।
আমার সৈনিকদের আরও লাশের সন্ধান করতে বললাম। মজা পুকুরটির প্রায় মাঝখানের তলদেশে মাটি খুঁড়ে একটি গণকবর থেকে আমরা পাঁচ-ছয়টি নর-নারীর লাশ উদ্ধার করলাম। তাদের প্রত্যেকের শরীরে নিষ্ঠুর নির্যাতন ও আঘাতের চিহ্ন ছিল সুস্পষ্ট।

বিহারিদের সঙ্গে প্রথম সংঘর্ষ
২ নম্বর সেকশনে প্রবেশের সময় আমরা শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলাম। রাস্তার পাশে একটা পাকা একতলা বাড়ি থেকে আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো এলএমজির স্বয়ংক্রিয় গুলি আসছিল। রাইফেল দিয়ে বাড়িটির জানালায় বহুক্ষণ ধরে গোলাগুলি করেও ওই গুলিবর্ষণ বন্ধ করতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে আমি ৭৫ মিলিমিটার রিকয়েললেস রাইফেল ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সাপোর্ট কোম্পানি থেকে একটি রিকয়েললেস রাইফেল এসে ফায়ারে অবস্থান নিল।
আমি মাইক লাগিয়ে প্রতিপক্ষকে সতর্ক করে দিলাম, তারা গোলাগুলি বন্ধ করে আত্মসমর্পণ না করলে তাদের ধ্বংস করে দিতে বাধ্য হব। প্রত্যত্তুরে ওই বাড়িতে থাকা বিহারিরা অশ্রাব্য ভাষায় আমাদের গালাগাল করতে লাগল। এরপর জানালাটি লক্ষ্য করে রিকয়েললেস রাইফেলের গোলা দাগার সঙ্গে সঙ্গে সব গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। আমি আমার একটি প্লাটুনকে ওই বাসায় তল্লাশি করতে পাঠালাম। তারা ফিরে এসে জানাল, ওখানে কয়েকজন আহত বিহারি ছাড়া আর কোনো সক্ষম শত্রু নেই। সেখানে বিহারিদের দুটি এলএমজি সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
আহত বিহারিদের আমার ব্যাটালিয়নের এমআই রুমে চিকিৎসা দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশের হাতে সোপর্দ করলাম। এই ঘটনার পর ২ নম্বর সেকশনের দখল বিনা বাধায় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের হাতে চলে এল। বিহারিরা একটিবারের জন্যও আর আমার সৈন্যদের ওপরে গুলি করার সাহস দেখায়নি।
এক সৈনিক কোথা থেকে আমার কাছে একটি কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে এল। আমি হতবাক হয়ে দেখলাম, তাতে অনেকগুলো মানুষের চোখ জড়ো করে রাখা হয়েছে! গণহত্যার শিকার বাঙালিদের চোখ। আমার সৈন্যদের উত্তেজনা ফেটে পড়ার জোগাড় হলো। অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তাদের কিছুটা শান্ত করলাম।
আমি আমার একজন নায়েব সুবেদারের নেতৃত্বে ৪০ জন সদস্যের একটা টিম করে তাদের ওপরে সন্দেহভাজন বাঙালি হত্যাকারীদের শনাক্ত করার দায়িত্ব দিলাম; বাকি সেনাদের সরাসরি বিহারিদের ওপরে কোনো প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ দিলাম না। এভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করলাম।

লে. কর্নেল (অব.) এইচ এম এ গাফফার প্রকাশিতব্য গ্রন্থ থেকে
লে. কর্নেল (অব.) এইচ এম এ গাফফার: সাবেক সেনা কর্মকর্তা