সেই বড়দিন এই বড়দিন

লিটন অধিকারী
লিটন অধিকারী

সবার জীবনেরই ছোট্টবেলার বড়দিনের চিন্তা আর ভাবনা প্রায় একই অথবা খুব কাছাকাছি। নতুন কাপড়ের গন্ধ শোঁকার প্রবল আগ্রহ, এর রং বা ডিজাইন নিয়ে স্বপ্নে বিভোর, সঙ্গে নানান পিঠা ও ভালো ভালো খাবারের লোভ আর বড়দের কাছ থেকে সেলামি আদায়ের হিসাব তো থাকবেই।
এগুলোর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় ছিল, যা আমার একান্ত নিজের। বরিশাল থেকে পাঠশালার পাঠ শেষ করে স্বাধীনতার সাত বছর আগে খুব ছোটবেলায় মা-বাবাকে ছেড়ে ঢাকায় এসেছি। বড় ভাই স্মিথ আর অধিকারী এবং আমি এক ঘরের বাসায় থাকতাম। দাদা খুব ভালোবাসতেন আমাকে। তাই তিনি বড়দিনের সময় আমার পছন্দের পোশাকটাই দিতেন, অর্থাৎ হাল ফ্যাশনের কিছু।
মনে পড়ে সেদিনের সেই বড়দিনের সময় ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা। তখন স্টিমারঘাট ছিল নারায়ণগঞ্জে। সদরঘাট থেকে শুধু ছোট ছোট লঞ্চ ছাড়ত।
বড়দিনের ছুটিতে গুলিস্থান থেকে লাল রঙের স্টেইটবাস, যার ধোঁয়া বের হওয়ার সিলিন্ডারের পাইপটি ছিল বাসের ছাদে। অর্থাৎ কালো ধোঁয়া যা বের হতো, সব সরাসরি আকাশেই ভেসে যেতে, এখনকার মতো রাস্তা অন্ধকার করত না। সেই বাসে চড়ে চলে যেতাম নারায়ণগঞ্জে, সেখান থেকে বরিশাল। তবে এই বরিশাল যাওয়ায় ছিল নানা আনন্দ, দুঃখ ও কষ্ট। যেমন কুয়াশার কারণে স্টিমার ঠিক সময়ে যেতে পারত না। সেখানে ছিল অপেক্ষার জ্বালা, কখন বাড়ি গিয়ে আমার মায়ের হাতের রান্না খাব। আবার এমনও হয়েছে, স্টিমার নষ্ট হয়ে বড়দিন নদীর মধ্যে কাটাতে হয়েছে। সেখানে দুঃখ, ইশ্, বন্ধুদের আমার নতুন জামার ডিজাইনটা দেখানো গেল না। কেননা, আমি বড়দিনের সময় ঢাকা থেকে লেটেস্ট ডিজাইনের কাপড় নিয়ে আমার মফস্বলের বন্ধুদের দেখিয়ে একটা ভাব নিতাম এবং ঢাকা আর বরিশালের মধ্যে একটা পার্থক্য বজায় রাখতাম। এখন তো সে বয়স নেই। চিন্তাভাবনার পরিবর্তন তো স্বাভাবিক ব্যাপার।
বড়দিনের আসল মানে তো তখন বোঝার বয়স নয়। এখন বুঝি বড়দিন আসলে কী।
সময়ের পরিমাপ অনুযায়ী ২৫ ডিসেম্বর দিনটি আসলে কিন্তু অন্য সব দিন অপেক্ষা বড় নয়। তাহলে বড়দিন বলি কেন? উত্তরটা জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি আর জেনেও যাই।
প্রভু যিশুখ্রিষ্টের জীবনের পাঁচটি ব্যতিক্রমী ঘটনা আছে। একটি তাঁর জন্ম, একটি তাঁর মৃত্যু, একটি তাঁর পুনরুত্থান, একটি তাঁর স্বর্গে আরোহণ এবং সর্বশেষ তাঁর পুনরাগমন। এই পাঁচটি জীবনের ঘটনায় তিনি অনবদ্য অতুলনীয়, কারণ যেমন ধরুন জন্ম হয়েছিল গোয়ালঘরে কুমারী মরিয়মের গর্ভে আর তৎকালীন তিনজন জ্ঞানী গণনা করে এক নতুন তারা আকাশে আবিষ্কার করল এবং সেই তারা অনুসরণ করে বহু পথ পাড়ি দিয়ে জেরুজালেমের বেথলেহেম নগরীতে এসেছিল তাঁকে সম্মান জানাতে। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল ক্রুশে ঝুলিয়ে এবং তিনি মৃত্যুর তিন দিন পর আবার জীবিত হয়ে উঠেছিলেন। নানা অলৌকিক কাজ করেছেন। তাঁর শিষ্যদের দেখা দিয়েছেন। তাদের নানা উপদেশ দিয়েছেন। তিনি পুনর্জীবিত হয়ে ৪০ দিন পৃথিবীতে ছিলেন। বিভিন্নজনকে দর্শন দিয়েছেন এবং পরে সবার সামনেই স্বর্গে সশরীরে উঠে গেছেন। যিশুর সব শেষ বিষয়টি হলো তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি দ্বিতীয়বার আবার পৃথিবীতে আসবেন, যা দুটি বৃহৎ ধর্মের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে। এই কারণে যিশুর জীবনী অতুলনীয়।
বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখতে পাব, বড়দিনকে কেন্দ্র করে যত আয়োজন, তাতে ঐশ্বরিক বিষয়ের চেয়ে মানুষ জাগতিক বিষয়ের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি জাগতিক অনুষ্ঠান কোথাও কোথাও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, কিন্তু প্রকৃত আনন্দ কোথায়? পৃথিবীর মানুষ বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত। জাতীয়, আন্তর্জাতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত, তবে সবারই উচিত পাপের পথ থেকে জীবনের পথে ফিরে আসা, মানুষকে ভালোবাসা, দান করা, সেবা করা, সর্বোপরি শেষ বিচার সম্পর্কে সচেতন থাকা, যা ছিল যিশুর প্রচারের মূল বিষয়।
মনে রাখতে হবে যে শেষ বিচারে আমাদের রায় কী হবে? স্বর্গবাস নাকি নরকের সর্বনাশ।
সবার বড়দিন পালন উপযুক্তভাবে হোক, সুন্দর ও আনন্দের হোক।
লিটন অধিকারী: গীতিকবি