পণ্ডিতের উদারনীতি

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (৬ ডিসেম্বর ১৮৫৩—১৭ নভেম্বর ১৯৩১) প্রতিকৃতি এঁকেছেন মাসুক হেলাল
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (৬ ডিসেম্বর ১৮৫৩—১৭ নভেম্বর ১৯৩১) প্রতিকৃতি এঁকেছেন মাসুক হেলাল

হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী যে পণ্ডিত ছিলেন এবং তা শব্দটির খাঁটি অর্থেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ছোট্ট শ্রদ্ধাঞ্জলিতে আমরা ‘উদারনীতি’ কথাটার ওপরই বেশি জোর দিতে চাই। উদারনীতির উৎসভূমি ইউরোপের উদারনীতিচর্চা যে খুব একটা খাঁটি ছিল না, সে কথা কয়েক দশক ধরে নথিপত্রযোগে জোরেশোরে বলা হচ্ছে। ইউরোপের অনুসরণে উপনিবেশিত কলকাতায় যে লিবারালিজম চর্চিত হয়েছে, তাতেও যথেষ্ট খাদ ছিল। ইউরোপীয় লিবারেলরা দুনিয়ার সব মানুষের অমিত সম্ভাবনায় আস্থাবান ছিলেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরাই যে শ্রেষ্ঠ, আর অন্যদের উন্নতির একমাত্র পথ তাঁদের অনুসরণ, সে বিষয়েও তাঁরা নিঃসন্দেহ ছিলেন। এ ধরনের মেকি জিনিসের অনুকরণ করে কলকাতায় খুব ভালো কিছু পয়দা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। কলকাতার সংকট ছিল সম্প্রদায়গত, শ্রেণিগত আর বর্ণগত বিভাজন। এসব ব্যাপারে উপনিবেশিত ভদ্রলোকেরা খুব একটা কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিতে পারেননি। শাস্ত্রীমশায় ছিলেন বিরল ব্যতিক্রম। তাঁর অন্য অসংখ্য গুণের সঙ্গে এ বৈশিষ্ট্যের কথাও তাই বারবার বলা দরকার।
আচার্য সুকুমার সেন জানাচ্ছেন, পশ্চিমা আর প্রাচ্যবিদ্যায় উঁচু মাপের পাণ্ডিত্যের ক্ষেত্রে সমকালীনদের মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তুলনা চলতে পারে কেবল কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের সঙ্গে। কিন্তু কৃষ্ণকমলের পাণ্ডিত্য ফলপ্রসূ হয়নি। অন্যদিকে হরপ্রসাদ সংস্কৃত কলেজ থেকে এমএ পাস করেই সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন সে কালের বিদ্যাচর্চার প্রধান ধারা প্রাচ্যবিদ্যার সঙ্গে। সারা জীবনের নিরলস সাধনায় এ ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে অতুলনীয় উচ্চাসনে উন্নীত করতে পেরেছিলেন। পুরোনো সংস্কৃত আমল থেকে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন পুঁথির জগৎ পর্যন্ত ছিল তাঁর সমান পদচারণ। তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিল কয়েকটি ভাষার প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত, সহজপ্রাপ্য ও দুর্লভ পুঁথির জগৎ। তিনি পুঁথি সংগ্রহ করেছেন, প্রকাশ করেছেন, বিশ্লেষণমূলক বিবরণী তৈরি করেছেন। ফলে ভারতবিদ্যা আর বাংলাবিদ্যা—যুগপৎ এই দুই শাস্ত্রে তাঁর বিকল্পহীন প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীই সম্ভবত ভারত আর বাংলার সাংস্কৃতিক-ভাষিক-নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস প্রণয়নের ক্ষেত্রে এককভাবে সবচেয়ে কৃতী ব্যক্তিত্ব।
শাস্ত্রী-রচনাবলি কলকাতার সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের চমৎকার নমুনা। লেখকের দিক থেকেও, সম্পাদনার দিক থেকেও। এর সম্পাদনা পর্যদ, বিশেষত সত্যজিৎ চৌধুরী যথার্থই লক্ষ করেছেন, পাণ্ডিত্যেরও রাজনীতি আছে, ইতিহাস ও ধারাক্রম আছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী উপনিবেশ আমলে উপনিবেশক-নির্দেশিত শাস্ত্রেই পাণ্ডিত্যের চর্চা করেছিলেন। কিন্তু পাণ্ডিত্যের সীমা অতিক্রমী শক্তিও থাকে। দেশ ও কালের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের বলে পণ্ডিত ছাড়িয়ে যেতে পারেন গবেষণার নির্দিষ্ট সীমা। হরপ্রসাদের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল। তখন ভারতের পূর্বাঞ্চলের বৌদ্ধ শাস্ত্র চর্চার কাল। শাস্ত্রীর কাছে এই চর্চা কেবল গবেষণা ছিল না। ছিল নিজেকে জানা-বোঝার তুরীয় আকাঙ্ক্ষা। তিনি যে বার কয়েক নেপাল গিয়েছিলেন, তল্লাশি চালিয়েছিলেন পুরোনো পুঁথির সম্ভাব্য আস্তানায়, সেটা আত্ম-আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষারই প্রকাশ। এ ধরনের এক অভিযানেই ১৯০৭ সালে তিনি খুঁজে পান চর্যাপদের পুঁথি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এটাই তাঁর মহত্তম অর্জন। বলার কথাটা হলো, চর্যাপদ আবিষ্কার কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। ধারাবাহিক চর্চার ফল। এ আবিষ্কার শুধু বাংলা ভাষা-সাহিত্য নয়, সমগ্র পূর্ব-ভারতীয় ভাষা-সাহিত্যের বয়সই কয়েক শ বছর বাড়িয়ে দিয়েছিল। আবার ১৯১৬ সালে তিনি যখন চর্যাপদ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন, তখনো পাণ্ডিত্য ও নিষ্ঠার প্রভূত স্বাক্ষর রেখেছিলেন। বলা যায়, চর্যাপদকেন্দ্রিক দীর্ঘ গবেষণার যথার্থ পথনির্দেশ তিনি করতে পেরেছিলেন।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর এই প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য কখনোই ভার হয়ে ওঠেনি। তাঁর অনুসন্ধানের গভীরতা ছিল, ব্যাপ্তিও ছিল। কিন্তু তা কখনোই নিজেকে আবিষ্কারের আন্তরিক ইচ্ছাকে ছাড়িয়ে যায়নি। আমাদের কথিত উদারনীতির উৎস এই আন্তরিকতা আর অন্তরঙ্গতা। আমি এখানে দুটো দিকের উল্লেখ করব, যা তাঁর উদারনীতির স্থায়ী চিহ্ন হয়ে আছে।
প্রথমটি সম্প্রদায়-নিরপেক্ষতা। উনিশ শতকের বাঙালি বিদ্বৎসমাজ গভীরভাবে সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত ছিল। এর দুই রূপ। একদিকে ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দুর সঙ্গে বিপুল অধিকাংশ নিম্নবর্ণ মানুষের ঘোরতর বিচ্ছেদ। বাংলার পরবর্তী ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমানসংকট এতটাই গুরুতর হয়ে ওঠে যে ওই বিভাজনের ভয়াবহতা আমরা আর মনে রাখিনি। কিন্তু বিভাজন কার্যকরভাবেই ছিল। শাস্ত্রী নিজে ব্রাহ্মণ ছিলেন। নিজের ব্রাহ্মণত্ব তিনি উপভোগ করতেন। অন্য ব্রাহ্মণরা কেবল ব্রাহ্মণ হিসেবেই যে শ্রদ্ধা আর ভক্তির অধিকারী, এ ব্যাপারেও তাঁর সংশয় ছিল না। কিন্তু তাঁর এ

>১৯১৬ সালে তিনি যখন চর্যাপদ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন, তখনো পাণ্ডিত্য ও নিষ্ঠার প্রভূত স্বাক্ষর রেখেছিলেন। বলা যায়, চর্যাপদকেন্দ্রিক দীর্ঘ গবেষণার যথার্থ পথনির্দেশ তিনি করতে পেরেছিলেন

অবস্থান নিম্নবর্ণের বিপুল অধিকাংশ মানুষের প্রতি তাঁর প্রীতি ও শুভকামনায় কোনো বিঘ্ন তৈরি করেনি। ঔদার্যের এই রূপে তাঁর সহগামী ছিলেন আরেকজন—দীনেশচন্দ্র সেন। দীনেশ সেনের আত্মজীবনী পরিষ্কার সাক্ষ্য দেয়, তিনি ভক্তিমান হিন্দু সন্তান। দেব-দ্বিজে তাঁর অচলা ভক্তি। বেদ-ভাগবত তাঁর কাছে পবিত্র। কিন্তু একই সঙ্গে জসীমউদ্দীন এবং সোজন বাদিয়ার ঘাট ও তাঁর কাছে পবিত্র। কারণ, এ পুস্তকে ‘বাংলাদেশের মাটির মানুষগুলোর কাহিনি আছে’।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আর দীনেশ সেনের এই বর্ণভিত্তিক অসাম্প্রদায়িকতা উনিশ-বিশ শতকের এক বিরল গুণ। অন্য বেশির ভাগ গুণী মানুষ নাস্তিক হয়েও কিংবা ধর্মাচারী না হয়েও এ গুণ আত্মস্থ করতে পারেননি। কারণ, তাঁরা এঁদের মতো ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণ্যবাদকে আলাদা করতে শেখেননি। ফলে যথেষ্ট পশ্চিমায়িত হয়েও তাঁরা বর্ণবাদী আচরণ এড়াতে পারেননি। বলে রাখা দরকার, এ অবস্থাকে ব্যক্তিবিশেষের স্বভাবের সঙ্গে একাত্ম করে পাঠ করা হবে ঐতিহাসিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক বিপত্তি। উপনিবেশিত বাংলার সামগ্রিক গড়নের সঙ্গেই একে মিলিয়ে পড়তে হবে। আর সে কারণেই যে দু-চারজন এই ঘেরাটোপের বাইরে আসতে পেরেছিলেন, তাঁদের ঔদার্য আরও বেশি মূল্যবান।
সাম্প্রদায়িকতার অন্য যে ধরনটির কথা বলতে চাই তা অনেক বেশি প্রকাশ্য আর বহুচর্চিত। উনিশ শতকের বাংলার প্রভাবশালী বুদ্ধিবৃত্তিক-সাংস্কৃতিক ময়দানে বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের কোনো লেনদেন ছিল না। বস্তুত, হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে বাঙালি সম্বোধনের কোনো রেওয়াজও ছিল না, কোনো ভাষাও গড়ে ওঠেনি। শাস্ত্রী এ অবস্থার ঘোরতর পরিণাম সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি নিজে এ সম্পর্কে লিখেছেন, কাজ করেছেন; অন্যদেরও সতর্ক করেছেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘বাঙালি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য যে-সকল সংস্কৃত গ্রন্থ লিখিয়া গিয়াছেন, তাহার ওপর বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের অধিকার বিস্তার করিতে যাইতেছেন, তবে বাংলায় বসিয়া যাঁহারা ফারসি, উর্দু ও মুসলমানি বাংলায় বহুসংখ্যক পুস্তক লিখিয়াছেন, তাঁহাদিগকে বাদ দেন কী করিয়া? সেও তো বঙ্গীয় সাহিত্য!’ শাস্ত্রীর এসব প্রচারণায় সম্ভবত অবস্থার বিশেষ হেরফের হয়নি। কিন্তু তাঁর নিজের উদারতার শক্ত ভিতের কথা ভাবলে অবাক হতে হয়।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উদ্ধারকৃত চর্যাপদ–এর পাণ্ডুলিপির এক​টি অংশ
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উদ্ধারকৃত চর্যাপদ–এর পাণ্ডুলিপির এক​টি অংশ

দ্বিতীয় উদাহরণটি দিতে চাই ভাষা ও গদ্যের এলাকা থেকে। আমরা জানি, উনিশ শতকের গদ্য ও ভাষাচর্চার মহাযজ্ঞে সাম্প্রদায়িকতার চর্চাটাও প্রকাশ্যেই হয়েছিল। দুটো তার রূপ। একদিকে অতি প্রচলিত আরবি-ফারসি ঝেঁটিয়ে বিদায় করার ইনতেজাম চলছিল, অন্যদিকে আমজনতার কথ্যরূপ থেকে দূরে সরে ভাষাচর্চা আশ্রয় নিয়েছিল নিরাপদ উঁচু মিনারে। স্বভাবসুলভ ঔদার্যবশেই শাস্ত্রী মশায় এ দুই ধরনের বর্ণবাদ থেকে নিজেকে হেফাজত করতে পেরেছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি দীক্ষা পেয়েছিলেন সংস্কৃত কলেজের ওস্তাদ শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে, নিজেকে যাঁর ‘চ্যালা’ বলে পরিচয় দিতেই তিনি পছন্দ করতেন। অনুজদের মধ্যে এ ক্ষেত্রে তাঁর নিকটাত্মীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। হরপ্রসাদ বাংলা ভাষার মহত্তম গদ্যশিল্পীদের একজন। আর ‘খাঁটি বাংলা’ নামে যে বস্তুর চর্চা তিনি সারা জীবন ধরে করেছেন, তা বহুস্বর জনবোধ্য কথ্য বাংলাই বটে। পাণ্ডিত্যের গভীরতা আর দূরদৃষ্টি ছাড়া ভাষাচর্চায় এ ঔদার্য দেখানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না।
শাস্ত্রীর পাণ্ডিত্য আর উদারনীতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিলাম। এবার এ দুইয়ের সমন্বয় করা যাক। ভাষা ও সম্প্রদায় প্রশ্নে তাঁর যে অবস্থান, একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, তার মূলে আছে বর্তমানলিপ্ততা আর উপযোগবাদ। দৃষ্টিগ্রাহ্য বর্তমানের মানচিত্র পরিচ্ছন্ন করার প্রয়োজনেই তিনি অতীতে গেছেন, অবদমিত এলাকাগুলোতে তল্লাশি চালিয়েছেন। আর সব ক্ষেত্রেই তাঁর বিবেচনার কেন্দ্রে ছিল মানুষের বাস্তব উপযোগিতা। পাণ্ডিত্যের জ্ঞানতত্ত্ব আর পদ্ধতিগত দিক থেকে ব্যাপারটা গভীর মনোযোগের দাবি রাখে। যদি কোনো অতীত বা সুদূর ‘আদর্শ’ প্রণয়ন পাণ্ডিত্যের লক্ষ্য হয়, যদি বিদেশাগত বা আরোপিত মতাদর্শ প্রতিপাদন পাণ্ডিত্যের কাজ হয়ে ওঠে, তাহলে তার অনিবার্য পরিণতি হবে সংকীর্ণ অভিজাতপনা। উপনিবেশিত বাংলার উনিশ শতকে এ বস্তুরই আধিপত্য দেখতে পাই। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে অব্যাহত দ্বান্দ্বিক সম্পর্কই এ অবস্থাকে সহনীয় করে তুলতে পারে। শাস্ত্রীর প্রশিক্ষণটা উপনিবেশকের জ্ঞানতত্ত্বেই হয়েছে। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও তা অনুপস্থিত নয়। কিন্তু যাপিত জীবনকে চোখ খুলে দেখার এবং গভীরভাবে মূল্য দেওয়ার স্বভাব তাঁকে সরিয়ে এনেছে অনেক দূর। সে কারণেই তাঁর পাণ্ডিত্য আর উদারনীতি—দুটোই এতটা খাঁটি হতে পেরেছে।
মোহাম্মদ আজম: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।