সেই সব নির্ভার উদ্যাপনের দিন

ছোটবেলা কেটেছে চট্টগ্রামে। বাবার চাকরিসূত্রে আমরা থাকতাম সিডিএ কলোনিতে। আমি বড়ও হয়েছি সেখানে। লাভ লেনে একটা মন্দির ছিল। এখনো আছে। মা-বাবাসহ সবাই সেই মন্দিরে যেতেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে সেই মন্দিরে যেতাম। তখন তো জীবন এত আধুনিক আর এত বেশি ব্যস্ত ছিল না। সেই সময়ে মানুষ অনেক নির্ভার জীবন কাটাত। বুদ্ধপূর্ণিমা আমাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। বেশ ঘটা করে এটা উদ্‌যাপন করা হতো। এখনো উৎসবটা সেভাবে উদ্‌যাপন করা হয়। তখন এই উৎসবের সঙ্গে প্রাণের সম্পর্কটা বেশি থাকত। সকাল সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মধ্যে মন্দিরে চলে যেতাম। পরিচিতজন, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন—সবার সঙ্গে দেখা হতো। সারা দিন অনুষ্ঠান চলত। বিকেলে একটু বিরতি দিয়ে সন্ধ্যায় আবার অনুষ্ঠান হতো। দুই বেলা আমরা সেখানে যেতাম।

এ দিনে আমরা নতুন পোশাক কিনতাম। আমি কলোনিতে থাকতাম, ওখানে ৫০টা পরিবার থাকত। সবার সঙ্গে সবার দারুণ একটা মিল ছিল। যেকোনো উৎসবে আমরা বেশ মজা করতাম। হোক না তা বুদ্ধপূর্ণিমা কিংবা ঈদ। আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদও ছিল না। ধর্মীয় বিধিনিষেধের কথা তো ভাবাই যেত না। দেখা যেত, ঈদের সময়ও আমরা অনেক মজা করতাম। দারুণ একটা পরিবেশ ছিল। আশপাশের সবাই জানত বুদ্ধপূর্ণিমা। উদ্‌যাপনটা দারুণ হতো।

আমার গ্রামের বাড়ি রাঙ্গুনিয়া থানার ইছামতী গ্রামে। শহর থেকে গ্রামে বুদ্ধপূর্ণিমায় মজা হতো সবচেয়ে বেশি। তবে বুদ্ধপূর্ণিমার চেয়ে প্রবারণা পূর্ণিমায় আমরা বেশি মজা করতাম। এই উৎসবে ফানুস ওড়ানোর একটা ব্যাপার ছিল। এটা ভীষণ জমজমাট একটা ব্যাপার। কেউ ফানুস বানাচ্ছে। কয়েক দিন আগে থেকে এর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

আমাদের গ্রামটা খুবই সুন্দর। কর্ণফুলীর তীরে তো। আরেক পাশে ইছামতী নদী। এখন গ্রামটা ভেঙে অর্ধেক হয়ে গেছে। গ্রামের বুদ্ধপূর্ণিমার উৎসবটা খুব মিস করি। সেই সময়টাতে গ্রামে উৎসবমুখর একটা পরিবেশ তৈরি হতো। একটা সময় পর আমাদের গ্রামের লোকজনের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজনের অনেকে শহরে চলে আসে। শহরে বসবাস শুরু করে তারা। আমি নিজেও তো বছর দশেক আগে শেষবারের মতো গ্রামে গিয়েছিলাম।

অনেক বছর ধরে ঢাকায় আছি। এখন বুদ্ধপূর্ণিমায় খুব একটা বাইরে যাওয়া হয় না। বাসায় রান্নাবান্না হয়। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব আসে। বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। নগরজীবনে কাজের চাপটা খুব বেশি। মাঝেমধ্যে ঢাকায় মন্দিরে যাই। তবে উৎসবের দিনটাতে যাওয়া হয় না। আমি একটু নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করি। কিন্তু বিশেষ দিনে লোকজন সবাই এত বেশি ভিড় করে, তখন আর আনন্দটা ঠিকমতো উদ্‌যাপন করতে পারি না। আমার বাবা এখনো নিয়ম করেই মন্দিরে যান।

আগে জীবন অনেক সোজা ছিল। নির্বিঘ্নে যেখানে খুশি চলে যেতে পারতাম। এখন কোথাও যাওয়ার আগে কয়েকবার চিন্তা করতে হয়। আদৌ যাব কি না। আমি তো ঢাকা শহরের মধ্যে একমাত্র মগবাজার এলাকায় অবাধে চলাফেরা করতে পারি। অনেক বছর ধরেই এখানে আছি। এখানকার মানুষজন আমাকে দেখলে ওইভাবে ঝামেলা করেন না। তাঁদের কাছে আমি সাধারণ একজনই হয়ে গেছি। সব সময় তাঁরা দেখছেন আমাকে। এই এলাকার বাইরে গেলে একটু ঝামেলায় পড়ে যাই। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, জনপ্রিয় সব মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে। এটা সব সময় যে উপভোগ করি, তা-ও কিন্তু নয়।

ঢাকায় বাড্ডা আর কমলাপুরে আমাদের ধর্মীয় উৎসবটা বেশ বড় পরিসরে হয়। আমি কমলাপুরে উদ্‌যাপন করতে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ওখানকার অনেককেই আমি চিনিও। কিন্তু এবারও এই দিনে সেখানে যাওয়া হবে না। বাবা-মায়ের সঙ্গে এদিন দেখা করব। বাসায় রান্নাবান্না হবে। আড্ডাবাজি হবে বন্ধুদের সঙ্গে। এভাবেই কেটে যাবে আরকি।

পার্থবড়ুয়া: সংগীতশিল্পী।