আগস্টের একরাত

শিল্পী: শাহাবুদ্দিন আহমেদ
শিল্পী: শাহাবুদ্দিন আহমেদ

চোখের জলের সেদিনের কথা ভুলবার নয়। তারিখটা ছিল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল।
আমরা থাকতাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজের পেছনের দিকে কলেজ স্ট্রিট নামের গলিতে, একটি ভাড়াবাড়িতে। আমি আর আনোয়ার বাংলা একাডেমিতে চাকরি করি। আমার দুই মেয়ে মুনা ও সারা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়ে। আমার মায়ের মৃত্যুর পরে আমার আব্বা সেই সময়ে আমাদের কাছে ছিলেন। আমার বড় ভাই পেশোয়ারের ওয়ারস বন্দিশিবির থেকে ফিরে সেই সময়ে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। পাঁচজন শিশুসহ বাড়িতে আমরা দশ-বারোজন ছিলাম।
বেশ ভোরে ওঠা আমার অভ্যাস। মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতিরও তাড়া থাকত। প্রতিদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আমি রেডিওর খবর শুনতাম।
১৫ আগস্ট রেডিও ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পাই মেজর ডালিমের সদম্ভ কণ্ঠস্বর, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হইয়াছে।’
আমি তাত্ক্ষণিকভাবে হকচকিয়ে গিয়ে পরক্ষণে চিত্কার করে কাঁদতে শুরু করি। আব্বা আব্বা বলে ডাকতে থাকি। আব্বা নিজের ঘরে নামাজ পড়ছিলেন। জায়নামাজ ছেড়ে উঠে আসেন। জিজ্ঞেস করেন, কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে? বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হয়েছে। অ্যাঁ, শব্দ করে আমার আব্বা ঘরের একটি চেয়ারে বসে পড়েন। দুহাতে মাথা চেপে ধরে রেডিও থেকে ভেসে আসা যাবতীয় কথা শোনেন।
দশটা-এগারোটার দিকে আমি আর আনোয়ার গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার ধারে যাই। রাস্তায় আর্মির গাড়ি ছাড়া অন্য যানবাহন নাই। নিউমার্কেটের দিক থেকে একটি খোলা জিপ আমাদের সামনে এসে থামে। দেখতে পাই কালো পোশাকধারী পাঁচ-ছয়জন বসে আছে। হাতে রাইফেল। আমাদের ধমকের স্বরে বললেন, রাস্তায় এসেছেন কেন? যান, বাড়ি যান।
শহরে কী হচ্ছে তা বোঝার জন্য আমরা বের হয়েছিলাম। বুকভরা আতঙ্ক আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমরা ফিরে আসি। তারপর কত দিন আর রাত চলে গেছে। সময়ের হিসাব ফুরিয়েছে। কিন্তু ফুরোয়নি বুকের ভেতরের সেই ভোরের আর্তনাদ। অনেক ভেবেছি আমার হাতে কীভাবে রূপায়িত হবে সে রাতের ঘটনা! কিন্তু না, কিছুই করতে পারিনি। করা সম্ভবও ছিল না। তারপরও অপেক্ষা করেছি নিজেকে তৈরি করার জন্য। একসময় মন স্থির করি যে একটা কিছু লিখতেই হবে। পনেরোই আগস্টের রাতকে পটভূমি করে উপন্যাস লেখার স্বপ্ন আমার ভেতরে ঘুণপোকার মতো কাটে।
তারপর একদিনের ঘটনা।
২০০৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। একটি অনুষ্ঠানে আমার দেখা হয়েছিল অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাহেবের সঙ্গে। অনুষ্ঠানে আমি আর আনোয়ার এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি কাছে এসে বললেন, আপনার কাছে আমার একটি অনুরোধ আছে। একটি উপন্যাস লেখার জন্য কিছু উপাদান আমি আপনাকে দিতে চাই। আপনি সময় করে হাইকোর্টে আমার অফিসে আসবেন।
কিছুদিন পরে আমি আর আনোয়ার একদিন হাইকোর্টে অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেবের অফিসে গেলাম। তিনি রুমে ছিলেন না। অফিসে যাঁরা ছিলেন তাঁরা বললেন, স্যার এজলাসে। আপনারা বসুন, উনি ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে আসবেন। অল্পক্ষণেই তিনি এলেন। আমাকে দেখে তিনি তাঁর লোককে বললেন, ওনার জন্য যে ফাইলটা রেখেছি ওটা নিয়ে এসো।
ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে একটি বড়সড় ফাইল নিয়ে এল। তিনি বললেন, এই ফাইলটি হলো বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের জবানবন্দি। ১৫ আগস্ট রাতে কী ঘটেছিল তার বিবরণ এখানে পাবেন।
ফাইলের ওপরে লেখা আছে Additional Paper Books of Death Reference No. 30 of 1998 বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট In the Supreme Court of Bangladesh আপিল বিভাগ (Appeallate Division)। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৯৫। ৬১ জন সাক্ষীর জবানবন্দি। পুরো ফাইল পড়তে যেমন সময় লেগেছে, তেমনই চোখ জলে ভরেছে। পড়তে কষ্ট হয়েছে। চোখ মুছে শেষ করতে পারতাম না। তারপর একদিন শুরু করি লেখার কাজ।
শুরু করেছি এভাবে: ‘রাতের শেষ প্রহর। বাইরে প্রবল গুলির শব্দ। চৌচির হয়ে ফেটে যাচ্ছে দিনের প্রথম প্রহর।’
সাক্ষীদের জবানবন্দি ব্যবহার করেছি একটি অধ্যায়ে। অন্য অধ্যায়ে আছে মৃত মানুষদের চালচলন। এভাবে উপন্যাস এগিয়েছে।
একজন সাক্ষীর জবানবন্দিতে সে রাতের ঘটনা এভাবে উঠে এসেছে:

.
.

‘আন্দাজি ৫৮ বয়স্ক হাবিলদার (অব.) কুদ্দুস সিকদার ১০ আইনের বিধানমতো শপথ বা প্রতিজ্ঞাপূর্বক আমি কাজী গোলাম রসুল, জেলা ও দায়রা জজ, ঢাকা সমক্ষে অদ্য সন ১৯৯৭ সালের ২৮/৭ তারিখে গৃহীত হইল।...
‘১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে মেজর শরিফুল হক ডালিমকে চাকরি হইতে অব্যাহতি দেওয়া হয়। চাকরি যাইবার পর মেজর শরিফুল হক ডালিমকে ওই আর্টিলারিতে দেখিয়াছি। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে ওয়ান ফিল্ড রেজিমেন্ট হইতে এক কোম্পানি রেজিমেন্ট ফোর্স ঢাকা গণভবনে এবং তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে ডিউটির জন্য পাঠায়। ওই কোম্পানিতে আমিও ছিলাম। ইতিমধ্যে আমি হাবিলদার পদে উন্নীত হই। ক্যাপ্টেন আবুল বাশারের নেতৃত্বে জুলাই মাসের শেষের দিকে আমরা ঢাকা আসিয়া গণভবনে পৌঁছি। ক্যাপ্টেন আবুল বাশার সাহেব আমাদের ডিউটি বণ্টন করিয়া দেন। নায়েব সুবেদার আবুল মোতালেব, হাবিলদার আবদুল গণি, নায়েক আবদুল জলিল, সিপাহি সেরাব হোসেন ও আমি হাবিলদার মো. কুদ্দুস সিকদার ও কয়েকজন এনসিও সিপাহিসহ ২৫ জনের একটি দলকে ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর রোডে ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে অর্থাৎ তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ডিউটিতে পাঠায়।...
‘এই সময় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দক্ষিণে লেকের দিক হইতে লাগাতার গুলি আসিতে থাকে। তখন আমি এবং আমার গার্ডসহ দেয়ালের আড়ালে লাইন পজিশনে যাই। গুলি বন্ধ হওয়ার পর পাল্টা গুলি করার জন্য আমার পূর্ববর্তী গার্ড কমান্ডারের নিকট গুলি খোঁজাখুঁজি করিতে থাকি। এ সময় কালো ও খাকি পোশাকধারী সৈনিক হ্যান্ডস আপ বলিতে বলিতে গেটের মধ্য দিয়ে বাড়িতে ঢুকে। তখন ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর বঙ্গবন্ধুর বাড়ির বারান্দায় আসিয়া সেখানে কামালকে দাঁড়ানো দেখিয়াই ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা হাতের স্টেনগান দ্বারা শেখ কামালকে গুলি করে। শেখ কামাল গুলি খাইয়া রিসিপশন রুমে পড়িয়া যায়। ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা পুনরায় শেখ কামালকে গুলি করিয়া হত্যা করে। ইহার পর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর বাড়ির পুলিশের ও কাজের লোকদেরকে গেইটের সামনে লাইনে দাঁড় করায়। ইহার পর মেজর মহিউদ্দিন তাহার ল্যান্সারের ফোর্স লইয়া গুলি করিতে করিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দোতলার দিকে যায়। তারপর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর কয়েকজন ফোর্স লইয়া বাড়ির বারান্দা দিয়া দোতলার দিকে যায়।
‘এই সময় আমাদেরকে তাহাদের সাথে যাইতে হুকুম দিলে আমি তাহাদের পিছনে পিছনে যাই। ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর সিঁড়ি দিয়া চৌকির (slap) উপরে গেলে মেজর মহিউদ্দিন ও তাহার সঙ্গীয় ফোর্সকে বঙ্গবন্ধুকে নিচের দিকে নামাইয়া আনিতে দেখি। আমি ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূরের পিছনে দাঁড়ানো ছিলাম। এই সময় মেজর নূর ইংরেজিতে কী যেন বলিলেন। তখন মহিউদ্দিন ও তাহার ফোর্স এক পাশে চলিয়া যায়। এই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, তোরা কী চাস? এরপরই ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর নূর হাতের স্টেনগান দ্বারা বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু সিঁড়ির মধ্যে পড়িয়া মৃত্যুবরণ করেন। তখন বঙ্গবন্ধুর পরনে একটা লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি, একহাতে সিগারেটের পাইপ, অন্য হাতে দিয়াশলাই ছিল। অতঃপর মেজর মহিউদ্দিন, মেজর নূর, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদাসহ সবাই নিচে নামিয়ে আসিয়া দক্ষিণ দিকে গেইটের বাহিরের রাস্তায় চলিয়া যায়।
‘কিছুক্ষণ পরে মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মোসলেউদ্দিন ও ল্যান্সারের ফোর্স এবং টু-ফিল্ড আর্টিলারির ফোর্স গেইটের সামনে আসে। তারপর মেজর আজিজ পাশা তাহার ফোর্স লইয়া গেইটের মধ্যে দিয়া বাড়ির দোতলার দিকে যাইতে থাকে। আমিও তাহাদের পিছনে পিছনে যাই।... তারপর মেজর আজিজ পাশা তার ফোর্সসহ দোতলায় বঙ্গবন্ধুর রুমের দরজা খোলার জন্য বলে। দরজা না খুলিলে দরজায় গুলি করে। তখন বেগম মুজিব দরজা খুলিয়া দেন।...
‘একদল ফোর্স রুম হইতে বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও একজন বাড়ির চাকরকে রুম হইতে বাহির করিয়া নিয়া আসে। বেগম মুজিব সিঁড়ির নিকট আসিয়া শেখ মুজিবের লাশ দেখিয়া কান্নায় ভাঙ্গিয়া পড়েন। এরপর বেগম মুজিবকে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে নিয়ে যায়। মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মোসলেউদ্দিন হাতের স্টেনগান দ্বারা বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে থাকা সবাইকে গুলি করে।...
‘তাহার পর তাহারা নিচে চলিয়া আসে। আমিও তাহাদের পিছনে চলিয়া আসিয়া রিসিপশনের বাথরুমের মধ্যে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শেখ নাসেরের লাশ দেখি। এরপর গেইটের সামনে লাইনে সাদা পোশাক পরিহিত একজন পুলিশের লাশ দেখি। তারপর মেজর আজিজ পাশা গেইটের বাহিরে গিয়া ওয়ারলেসে কথাবার্তা বলে। কথা বলিয়া গেইটের সামনে আসে। তখন শেখ রাসেল তাহার মায়ের কাছে যাইবে বলিয়া কান্নাকাটি করিতেছিল। মেজর আজিজ পাশা ল্যান্সারের একজন হাবিলদারকে হুকুম দিলেন, শেখ রাসেলকে তাহার মায়ের কাছে নিয়ে যাও। ওই হাবিলদার শেখ রাসেলের হাত ধরিয়া দোতলায় নিয়া যায়। কিছুক্ষণ পর দোতলায় গুলির আওয়াজ ও কান্নাকাটির চিত্কার শুনিতে পাই। তারপর ওই হাবিলদার নিচে গেটের কাছে আসিয়া মেজর আজিজ পাশাকে বলে, স্যার, সব শেষ। এরপর গেইটের সামনে একটা ট্যাংক আসে। মেজর ফারুক সাহেব ওই ট্যাংক হইতে নামিলে মেজর আজিজ পাশা, মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা তাহার সহিত কথাবার্তা বলে। তারপর মেজর ফারুক ট্যাংক নিয়া চলিয়া যায়।’
পরের অধ্যায় আমি এভাবে লিখি:
‘বঙ্গবন্ধু এখন মরদেহ।
ভূখণ্ডের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর শরীরটির নান্দনিক শিল্প এখন আশ্চর্য নীরবতায় মহাকালের খেরোখাতায় ভরে ওঠার জন্য অপেক্ষমাণ। নিথর শরীরও যে কত বাঙ্ময় হতে পারে ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে শায়িত তাঁকে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। প্রাণস্পন্দনে কল্লোলহীন শরীর থেকে প্রবাহিত হচ্ছে রক্ত।
‘কিছুক্ষণ আগে কতিপয় উদ্ধত সেনাসদস্যের আঠারোটি গুলি তাঁর শরীরকে বিদ্ধ করেছে। গুলির প্রতিটি ক্ষত থেকে তিন শত নদীর মতো বেরিয়ে আসছে রক্ত। যেন ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিন শত নদী। প্রতিজ্ঞার মতো উচ্চারণ করছে, বঙ্গবন্ধু, আপনার রক্তের স্রোতকে আমরা বুকে করে নিয়ে যাব সাত সমুদ্র তেরো নদীর পথে।
‘তাঁর শরীর এখন আর বত্রিশ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে নেই। এই শরীর ক্রমাগত বিস্তৃত হয়েছে—দীর্ঘায়িত হয়েছে। ঢেকে দিয়েছে বাংলাদেশের সবটুকু জমিন।’
এভাবে উপন্যাসে নানাকিছু যুক্ত হয়েছে। একটি অধ্যায়ে বিশ্বের নেতাদের নিয়ে এসেছি বঙ্গবন্ধুর কফিনের পাশে। তাঁরা তাঁকে স্মরণ করছেন। কফিনের ওপর রেখে গেছেন ফুল। বলতে পারি এ উপন্যাস মোহগ্রস্ত কষ্টের সৃষ্টি।
বইটি প্রকাশ করেছে সময় প্রকাশন। প্রকাশকাল ২০১৩।