দিম দিম দিম চং দাদিচং...। জওহরলাল নেহরু স্পোর্টস কমপ্লেক্সের সাউন্ড সেটে বাজছে গানটি। স্থানীয় জনপ্রিয় ব্যান্ড শিলং চেম্বার কয়ারের গানের তালে নাচছে একদল ছেলেমেয়ে। কারও হাতে দামা, আদুল। কারও হাতে সেপ্পি-মিলাম। মহড়ায় ব্যস্ত সবার হাতে শিলংয়ের ঐতিহ্যবাহী সব বাদ্যযন্ত্র।
গুয়াহাটি আর শিলংয়ে এবার বসেছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞ। ‘দক্ষিণ এশিয়ার অলিম্পিক’খ্যাত এসএ গেমসের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সবাই। শহরের ওয়ার্ডস লেকের পাড়ের সাজানো রাস্তা বা রাজ্য জাদুঘরের বারান্দা—সবখানেই ডিজিটাল ব্যানার। হাতে বিশাল মশাল নিয়ে গেমসের মাসকট টিখর (শিশু গন্ডার) দাঁড়িয়ে অ্যাথলেট, কর্মকর্তাসহ সব অতিথিকে স্বাগত জানাতে।
গুয়াহাটিতে আজ গেমসের উদ্বোধন করবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে শিলংয়ে শুধু খেলোয়াড়দের নিয়ে একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে আগামীকাল। শিলংয়ের জওহরলাল নেহরু স্পোর্টস মাঠে কাল চলছিল এসবেরই প্রস্তুতি।
সর্বশেষ এসএ গেমস হয়েছিল ঢাকায় ২০১০ সালে। ছয় বছর পর এবার বসেছে গেমসের ১২তম আসর ভারতে। ২৩টি খেলার ২২৮টি ইভেন্টে অংশ নেবেন ২৬৭২ জন অ্যাথলেট। লড়াই হবে ২২৮টি সোনার পদকের জন্য। রুপা ২২৮টি এবং ব্রোঞ্জ পদকও থাকছে ৩০৮টি। সব মিলিয়ে ২৩টি খেলা হলেও বাংলাদেশ শুধু ট্রায়াথলনে অংশ নিচ্ছে না।
আজ বিকেল সাড়ে ৫টায় গুয়াহাটিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলেও শিলংয়ে খেলা শুরু হচ্ছে সকালেই। মহিলা ফুটবল দিয়ে শুরু। পাশাপাশি আর্চারির র্যাঙ্কিং রাউন্ডও রয়েছে। ভলিবলের প্রথম রাউন্ডের খেলাও আজ থেকেই।
সকাল সাড়ে ৯টায় গ্রুপের প্রথম ম্যাচেই বাংলাদেশ খেলবে নেপালের সঙ্গে। পরশু বিশেষ বিমানে অন্য দলগুলোর সঙ্গে ভারতে এসেছে বাংলাদেশ ক্রীড়াবহরের প্রথম দল। মেয়েদের ফুটবল দল গুয়াহাটি বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর প্রায় ৮ ঘণ্টা বসে ছিল সেখানেই। অপেক্ষায় ছিল গাড়িতে করে শিলংয়ে আসার। উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা ঠেলে যখন শিলংয়ের হোটেলে ওঠে মেয়েরা, সবার চোখেমুখে ছিল ক্লান্তির ছাপ। তবে কাল দুপুরে অনুশীলনে তাঁদের পাওয়া গেল বেশ ফুরফুরে মেজাজেই। অনুশীলন শেষে হোটেলের সামনেই একটু হাঁটাহাঁটি করলেন সাবিনা-মিরোনারা। জয় দিয়েই টুর্নামেন্ট শুরু করতে চান দলের কোচ গোলাম রব্বানি ছোটন, ‘নেপালের বড়দের সঙ্গে আমরা কখনো জিতিনি। এবার সেই ব্যর্থতা ঘোচাতে চাই।’ সম্প্রতি এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ মহিলা ফুটবলে নেপালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। ছোটনের কাছে ওই সুখস্মৃতি এক বাড়তি অনুপ্রেরণা, ‘নেপালের জুনিয়রদের আমরা হারিয়েছি। এবার আশা করছি সিনিয়রদেরও হারাতে পারব। আগে যেমন মাঠে নেমেই মেয়েরা ভারত, নেপালের কাছে গোল খেয়ে বসত, এবার আশা করি তেমনটা হবে না। ওরা মাঠে নামার জন্য উন্মুখ।’
কাল বিকেলে শিলংয়ের পুলিশ বাজারের টিম হোটেলের সামনে বাংলাদেশের মেয়েরা যখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে ঘুরছিলেন, নেপালিরা তখন অনুশীলনে ছিলেন জওহরলাল নেহরু স্পোর্টস কমপ্লেক্সের পোলো গ্রাউন্ডে। গেমস উপলক্ষে পুরো এলাকায় নেওয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা। তারপরও স্টেডিয়ামের সীমানাপ্রাচীরের ওপর বাবার কোলে চড়ে ছোট্ট পৃথ্বীরাজ ফুটবলের অনুশীলন দেখছিলেন। উৎসুক স্থানীয় জনতার চোখেমুখেও ছিল খুশির আভা।
১৯৮৭ কলকাতা গেমসের পর ১৯৯৫ মাদ্রাজে বসেছিল এসএ গেমসের আসর। তৃতীয়বারের মতো ভারতে আবার দক্ষিণ এশীয় গেমস। শিলংয়ের ট্যাক্সিচালক সোহন বিশওয়া থেকে শুরু করে গেমসের স্বেচ্ছাসেবক থ্রিসলার সাংমার চোখেমুখে গেমস নিয়ে রোমাঞ্চের ছোঁয়া। সাইবার ক্যাফেতে আসা যুগলরাও জানতে চাইলেন, কোথায় পাওয়া যাবে গেমসের টিকিট। শিলং বিশাও কলেজের ছাত্র থ্রিসলারের কাছে গেমসে কাজ করাটা বিরাট ব্যাপার, ‘আমি প্রথমবার গেমসের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছি। এখানে কাজের সুযোগ পেয়ে ভীষণ রোমাঞ্চিত।’
‘এই পৃথিবী এখন ক্রীড়াঙ্গন, ক্রীড়া হলো শান্তির প্রাঙ্গণ’—ভূপেন হাজারিকার বিখ্যাত গানটি এবারের গেমসের থিম সং। খেলা দিয়েই অশান্তির পৃথিবীতে শান্তি ফেরাতে চান অ্যাথলেটরা। সেই আশায়ই তো এক পতাকার নিচে দক্ষিণ এশিয়ার সব অ্যাথলেট। সবকিছু ভুলে আগামী ১২ দিন নাহয় মেতে উঠুন শুধু খেলার আনন্দেই।