এমন খেলাপাগল মানুষটাকে খুন করেছিল পাকিস্তানিরা!

এস এ মান্নান লাডু ভাই: সৌম্যদর্শন, ব্যক্তিত্ববান, খেলাপাগল এক মানুষ
এস এ মান্নান লাডু ভাই: সৌম্যদর্শন, ব্যক্তিত্ববান, খেলাপাগল এক মানুষ

তিনি ছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিক। খেলাধুলাই ছিল ধ্যানজ্ঞান। রাজনৈতিক আলোচনাতেও সেভাবে অংশ নিতেন না। একমাত্র ভাবনা ছিল, কীভাবে খেলার মান বাড়ানো যায়; সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ কীভাবে বাড়ানো যায় জাতীয় পর্যায়ে। ইংরেজি দৈনিক অবজারভারের ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে পত্রিকাটির খেলার পাতার ভালো-মন্দই ছিল তাঁর ভাবনা। রাজনীতির সাতপাঁচে না থাকা সাদাসিধে মানুষটিকেই নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানিরা!
শেখ আবদুল মান্নান নামটি খুব পরিচিত না হলেও এস এ মান্নান (লাডু ভাই) হিসেবেই তিনি পরিচিত। তিনি সেই যুগে ক্রীড়া সাংবাদিকতা করতেন, যখন সংবাদপত্রে খেলার খবর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাই বোধ করতেন না সম্পাদকেরা। পুরো পত্রিকায় হয়তো একটি কলাম ‘দিতে হবে বলে’ ছেড়ে দিতেন খেলার খবরের জন্য। তা–ও সেটিকে খেলার প্রতিবেদন না বলে ‘খেলার খবর’ বলাটাই বোধ হয় ভালো শোনাত। খেলার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট কোনো সাংবাদিকও সে সময় পত্রিকাগুলোতে ছিল না।
বিভিন্ন প্রতিবেদক ঘুরতে ঘুরতে বিকেলের দিকে স্টেডিয়ামে গিয়ে নোট বাইয়ে লিখে নিতেন ফুটবল লিগের ম্যাচের স্কোরলাইন। কে কয় মিনিটে গোল করেছে, ব্যস এ-ই! এস এ মান্নানেরা ঠিক এই জায়গাটিতেই পরিবর্তন এনেছিলেন নিজের প্রতিভা দিয়ে। ষাটের দশকে এস এ মান্নানের মতো সাংবাদিকেরা প্রথম সম্পাদকদের বোঝাতে পেরেছিলেন, খেলাও পত্রিকার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর একটি মাধ্যম হতে পারে। যে খেলা দেখতে মাঠে হাজার বিশেক দর্শকের সমাগম হচ্ছে, যে খেলার টিকিট পেতে স্টেডিয়ামে মারামারি হচ্ছে, সে খেলা কোনোমতেই পত্রিকার পাতায় অবহেলার শিকার হতে পারে না। স্টেডিয়ামে ২০ হাজার দর্শক হলে এই খেলার খবর পড়তেও নিশ্চয়ই কয়েক হাজার মানুষ অপেক্ষা করে থাকবে। 

এস এ মান্নানকে ষাটের দশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অবজারভার পত্রিকার খেলার পাতার। সে সময় অবজারভারই অন্যতম পত্রিকা, যারা খেলাকে গুরুত্ব দিয়ে গোটা একটি পাতা ছেড়ে দিয়েছিল খেলার খবর, ফিচারের জন্য। এস এ মান্নান নিষ্ঠার সঙ্গে অবজারভারের খেলার পাতাকে নিয়ে গিয়েছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ​বেড়েছিল পত্রিকাটির প্রচারসংখ্যা। রাজনীতি তাঁর প্রিয় বিষয় না হলেও অবজারভারের খেলার পাতাকে দিয়েই তিনি বুঝিয়ে ​দিয়ে​ছিলেন, কীভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান জাতীয় দলে পাঞ্জাবি খেলোয়াড়দের আধিক্য, বাঙালি খেলোয়াড়দের প্রতি অবহেলার তথ্য অনুসন্ধানী লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরতেন অবজারভারের খেলার পাতায়। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি খেলোয়াড়দের প্রতি এই ভালোবাসা আর সোচ্চার ভূমিকা তাঁকে শত্রু করে তুলেছিল পাকিস্তানি শাসকদের চোখে।
এস এ মান্নান জন্মেছিলেন ১৯২৮ সালে, কলকাতায়। সেখানেই বেড়ে ওঠা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর ছিল না। কিন্তু ছিল প্রচুর পড়াশোনা। প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসা আত্মজীবনী ‘আমার বেলা যে যায়’-এ লিখেছেন, ‘আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না লাডু ভাইয়ের, বস্তুত কলেজের গণ্ডিও পার হননি। তাঁকে একটি ইংরেজি পত্রিকার স্পোর্টস এডিটর করা হচ্ছে, এটা অনেকেরই মনঃপূত হয়নি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আড্ডা মারার সময় কথাবার্তা বলে আমার মনে হয়েছে, ডিগ্রি না থাকলেও ইংরেজি তিনি জানেন। কারণ, প্রচুর পড়াশোনা করতেন। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যা, খেলার জগতের খবরাখবর ও জ্ঞান ছিল তাঁর অনেক।’
এস এ মান্নান সোচ্চার ছিলেন ক্রীড়াক্ষেত্রে দুই পাকিস্তানের বৈষম্য নিয়ে। সে সময় পাকিস্তানের সব ক্রীড়া ফেডারেশনের দপ্তর ছিল হয় লাহোর কিংবা করাচিতে। অর্থ যা বরাদ্দ হতো, ৯০ শতাংশই ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে এক টিনের বেড়ার ঢাকা স্টেডিয়াম ছাড়া তেমন কোনো ক্রীড়া অবকাঠামোই গড়ে ওঠেনি। ছিল না কোনো সুইমিংপুল। ঢাকা স্টেডিয়ামেই ফুটবল, ক্রিকেট, হকি থেকে কাবাডিও অনুষ্ঠিত হতো।
পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন খরচ করার জন্য পেত নামমাত্র অর্থ। অবজারভারের পাতায় এসব নিয়েই লেখালেখি করতেন এস এ মান্নান। প্রতিবেদকদের দায়িত্ব দিতেন এসব অবিচার ও অন্যায় নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির। ইংরেজি পত্রিকা হওয়ার কারণেই হয়তো অবজারভারের লেখাগুলো পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দৃষ্টিতে পড়ত ভালো করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এরই মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে, বুকের রক্তে।
ক্রীড়া সাংবাদিকদের মাঠের মানুষ হতে হবে, নিয়মিত খেলা দেখতে হবে, সারা দুনিয়ার খেলার খবর রাখতে হবে—ক্রীড়া সাংবাদিকদের অপরিহার্য কাজগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন এস এ মান্নান। ক্রীড়া সম্পাদক হয়েও প্রতিটি বিকেল কাটাতেন স্টেডিয়াম পাড়ায়। লিগ, টুর্নামেন্টের খেলাগুলো দেখতেন। খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলতেন। তাঁদের সুবিধা-অসুবিধা জানতেন। নিজে একটা সময় কলকাতার ময়দানে খেলেছেন, ঢাকায় এসেও খেলেছেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবলে—আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। খেলার মাঠের অভিজ্ঞতা, সেই সঙ্গে খেলাধুলার জ্ঞান ও প্রচুর পড়াশোনা তাঁকে গড়ে তুলেছিল দুর্দান্ত এক ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে।
প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী এস এ মান্নান সম্পর্কে লিখেছেন তাঁর ‘আমার অগ্রজপ্রতিম’ রচনায়। দেশমাতৃকার জন্য জীবন দেওয়া এই ক্রীড়া সাংবাদিককে তিনি সম্বোধন করেছেন ‘প্রিয় লাডু ভাই’ হিসেবে। তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন ‘সৌম্যদর্শন’, ‘দীর্ঘদেহী’ ‘প্রশান্ত’ শব্দগুলো ব্যবহার করে। বলেছেন, ‘...তিনি যখন ধীর পদক্ষেপে অফিসে ঢুকতেন, তখন সবাই সহকর্মী হিসেবে তাকিয়ে থাকতাম। তাঁর চলার ভেতর ছিল গাম্ভীর্য, যা সবাইকে শ্রদ্ধাবনত করে দিত। তিনি কখনো গম্ভীর হয়ে বসতেন। আবার কখনো মিষ্টি হেসে কুশল বিনিময় করতেন। তারপর কাজ শুরু করতেন।’
এই মানুষটিকেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের কোনো একসময় পুরানা পল্টনের নিজের ফ্ল্যাট থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে অপহরণ করেছিল মুখোশধারী কিছু যুবক—নিশ্চিতভাবেই আলবদর, আলশামস কিংবা রাজাকার। এরপর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি হারিয়ে যান কোনো বধ্যভূমিতে অসংখ্য শহীদের ভিড়ে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে এই ভূখণ্ডের ক্রীড়া সাংবাদিকতার এই পথিকৃৎ​কে বিনম্র শ্রদ্ধা।