টেস্টে টাই - অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী ভারত-অস্ট্রেলিয়া

এই সেই মুহূর্ত, সেই আলোচিত আম্পায়ার! ফাইল ছবি
এই সেই মুহূর্ত, সেই আলোচিত আম্পায়ার! ফাইল ছবি

৪৫ বছরের ক্যারিয়ারে কতবারই তো তর্জনী তুলেছেন ভি বিক্রমরাজু। কতবারই তো শরীরটা টান টান করে ঋজু ওই ভঙ্গিতে ব্যাটসম্যানকে ড্রেসিংরুমের পথটা দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ক্যারিয়ারের মাঝপথে দেওয়া একটা সিদ্ধান্তই ইতিহাসে নাম উঠে গেল তাঁর। ক্রিকেটের দ্বিতীয় ও সর্বশেষ টাই টেস্টের ফলাফলটা লেখা হয়েছিল এই ভদ্রলোকের সিদ্ধান্তেই!

প্রায় ৩১ বছর আগের মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই) টেস্টের শেষ বিকেল। দিনের শেষ ওভার, ম্যাচ শেষ হতে আর দুই বল বাকি। দুই দলের স্কোর সমতায়। জয় দিয়ে সিরিজ শুরু করতে ভারতের অপেক্ষা মাত্র ১ রানের। বোলিংয়ে অফ স্পিনার গ্রেগ ম্যাথুজ। ব্যাটসম্যান মনিন্দর সিং, নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে রবি শাস্ত্রী। বল করলেন ম্যাথুজ। বলটা মনিন্দর সিংকে ফাঁকি দিয়ে লাগল প্যাডে। তাঁকে ঘিরে ধরা অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ডারদের এলবিডব্লুর আবেদনে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আঙুল তুলে দিলেন আম্পায়ার ভি বিক্রমরাজু! আউট, ১ বল বাকি থাকতেই ‘টাই’ হয়ে গেল মাদ্রাজ টেস্ট।
ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় ‘টাই’ টেস্ট। শুধু এ কারণেই এই টেস্টটা ক্রিকেট ইতিহাসে আলাদা জায়গা পাওয়ার দাবি রাখে। ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ২২৪৯টি টেস্ট হয়েছে। এখান থেকেই বোঝা যায়, মাত্র দুটি টেস্টের ফল ‘টাই’ হওয়া মানে কতটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। সম্ভাবনার সূত্রে এমনটা ঘটার শতাংশও কত।
চেন্নাইয়ে ১৯৮৬ সালের ওই টেস্টটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে আরও অনেক কারণে। ওই টেস্টেই অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে ডিন জোন্সের ডাবল সেঞ্চুরিটাকে এখনো টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সাহসী ইনিংস বলে মানা হয়। প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্রতার মধ্যে করা যে সেঞ্চুরি তাঁর ক্যারিয়ারেরও মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সেঞ্চুরি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডার, ওপেনার ডেভিড বুন ও ভারতীয় অধিনায়ক কপিল দেবও। ম্যাচের ভাগ্য বদলে দেওয়া ম্যাথুজ পেয়েছিলেন ২৪৯ রানে ১০ উইকেট। ক্যারিয়ারে ওই একবারই টেস্টে ১০ উইকেট পেয়েছিলেন ম্যাথুজ।
চেন্নাই টেস্ট অনেকেরই ক্যারিয়ার গড়ে দিয়েছিল। আবার দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওই ম্যাচ দিয়েই শেষ হয়ে গিয়েছিল একজনের টেস্ট ক্যারিয়ার। না, খেলোয়াড় নন তিনি। ওই যে ইতিহাসে নাম লেখানো মুহূর্তের জন্ম দেওয়া ভি বিক্রমরাজু! চেন্নাই টেস্টের পরে আর কোনো দিন টেস্টে আম্পায়ার হিসেবে দাঁড়ানোর সুযোগই পাননি! ওটাই ছিল তাঁর মাত্র দ্বিতীয় টেস্ট।
টেস্টে নিরপেক্ষ আম্পায়ারের দিন শুরু হয়েছে বেশি দিনকার কথা নয়। মাদ্রাজ টেস্টের দায়িত্ব পড়েছিল দুই ভারতীয়র কাঁধে। স্বাগতিক দলের পক্ষে আজে বাজে সিদ্ধান্তের অভিযোগই ওঠে সাধারণত। কিন্তু ওই টেস্টের পর ভি বিক্রমরাজু সমালোচনার হয়েছে, নিজেকে বেশি নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে গিয়েই এমন ‘বাজে’ একটা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন আম্পায়ার!
এখনো মনিন্দরের দাবি, বল তাঁর প্যাডে লাগার আগে ব্যাটে লেগেছিল। আবার ভি বিক্রমরাজুও পাল্টা জবাব দিয়েছেন, তিনি সঠিক সিদ্ধান্তই দিয়েছিলেন। তিন দশক পরেও তাঁর উত্তর বদলায়নি, ‘শুধু মাত্র ভারত খেলছে, এ কারণেই আমি ওদের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। নিরপেক্ষ হিসেবে আমার তো সঠিক বিচার করা উচিত, তাই না? ওর (মনিন্দর) ব্যাট প্যাডের ধারে-কাছেও ছিল না, ব্যাট বলের কাছেই যায়নি। সুতরাং আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম, আর সে-ও উইকেটের সোজাসুজিই ছিল।’
বোলার ম্যাথুজ অবশ্য পরে ভি বিক্রমরাজু সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে সাহসী আম্পায়ার।’ ভি বিক্রমরাজুর ওপর রাগ পুষে রাখেননি মনিন্দর কিংবা শাস্ত্রীর কেউই। তবে বল যে মনিন্দরের ব্যাটে লেগেছিল আগে, এই দাবি থেকেও কখনো সরেননি তাঁরা।
১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বরের সে ম্যাচের পর পেরিয়ে গেছে ৩০ বছর। তবু যখনই আরেকটা ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ শুরু হয়, এই টেস্টের গল্পটা ফিরে আসেই। তিন দশক পেরিয়ে সেদিনের সে জমজমাট লড়াইটা যে এখন ক্রিকেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দ্বৈরথে রূপ নিয়েছে। দিনের ১ বল বাকি থাকতে যে টেস্ট টাই হয়ে যায়, এর চেয়ে বড় রোমাঞ্চ আর কী হতে পারে!
ভারত-অস্ট্রেলিয়া বহুবারই এমন রোমাঞ্চ উপহার দিয়েছে। এবার?