মহাতারকার 'মর্মান্তিক' বিদায়

৪^১০০ মিটার রিলের শেষ লেগে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়ে ট্র্যাকে পড়েই গেলেন উসাইন বোল্ট! বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে এই প্রথম দৌড় শেষ করতে পারলেন না। জ্যামাইকান মহাতারকার শেষটা হলো মর্মান্তিক। পেছনের ব্যাটনটার মতোই পড়ে থাকল সব কীর্তি, উদ্‌যাপনের রাজকীয় ভঙ্গি। অতীত হয়ে গেল সবকিছু। অতীত? মনে হয় না। যে রেকর্ড রেখে গেলেন, কে তা ভাঙবে? কোন অনাগতকালে? l রয়টার্স
৪^১০০ মিটার রিলের শেষ লেগে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়ে ট্র্যাকে পড়েই গেলেন উসাইন বোল্ট! বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে এই প্রথম দৌড় শেষ করতে পারলেন না। জ্যামাইকান মহাতারকার শেষটা হলো মর্মান্তিক। পেছনের ব্যাটনটার মতোই পড়ে থাকল সব কীর্তি, উদ্‌যাপনের রাজকীয় ভঙ্গি। অতীত হয়ে গেল সবকিছু। অতীত? মনে হয় না। যে রেকর্ড রেখে গেলেন, কে তা ভাঙবে? কোন অনাগতকালে? l রয়টার্স

শেষটা এমন বিয়োগান্ত হবে কে জানত!

চোটের হানায় ক্যারিয়ারের শেষ দৌড়টা শেষ করতে পারবেন না উসাইন বোল্ট, কষ্টকল্পনাতেও কি এমনটা ভেবেছিলেন কেউ!

যা হওয়ার নয়, যা অপ্রত্যাশিত, তা হয় বলেই তো খেলা কোটি কোটি মানুষকে টানে। তবু নিশ্চিত করে বলা যায় উসাইন বোল্টের এমন শেষ কেউ চায়নি। তবু তা-ই হলো। মর্ত্যের দ্রুততম মানব লুটিয়ে পড়লেন ট্র্যাকে, এরপর যন্ত্রণাকাতর মুখ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বের হয়ে গেলেন লন্ডন অলিম্পিক স্টেডিয়াম থেকে। এই যাওয়াটাই শেষ যাওয়া, অ্যাথলেটিকসকে ‘শূন্য’ করে চলে যাওয়ার ঘোষণাটা যে আগেই দিয়ে রেখেছিলেন ইতিহাসের সেরা স্প্রিন্টার।

পরশু লন্ডনে শেষবারের মতো ট্র্যাকে নেমেছিলেন জ্যামাইকান মহাতারকা। সকালে নিজেদের হিটে প্রথম হয়েই পুরুষ ৪^১০০ মিটার রিলের ফাইনালে ওঠে বোল্টের জ্যামাইকা। শেষ লেগে অসাধারণ দৌড়ে যাতে বড় অবদান রেখেছিলেন বোল্ট। তখন কে জানত রাতটা এমন বিয়োগান্ত আর মর্মান্তিক হবে।

ফাইনালের শেষ লেগে বোল্ট যখন ইয়োহান ব্লেকের হাত থেকে ব্যাটনটা নিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনের চেয়ে পেছনে ছিল জ্যামাইকা। বোল্টের ক্যারিশমা দেখার এটাই তো সময়! এই সময়েই তো পেছন থেকে উঠে এসে সবার আগে সমাপ্তিরেখা পেরোবেন ‘বজ্রবিদ্যুৎ’! এর আগে কতবারই তা করে দেখিয়েছেন বোল্ট। কিন্তু নিয়তি এবার মুচকি হাসল।

সমাপ্তিরেখার ৫০ মিটার আগেই খলনায়ক হয়ে এল চোট। বাঁ পায়ের হ্যামস্ট্রিংয়ে টান পড়ায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে কয়েক কদম এগোলেও ট্র্যাকেই লুটিয়ে পড়লেন বোল্ট। ২০০৫ সালে বিশ্ব অ্যাথলেটিকসে বোল্টের প্রথম ফাইনালটাই যেন ফিরে এল লন্ডনে। সেবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও সমাপ্তিরেখা পেরিয়েছিলেন, এবার তা-ও হলো না। আর কী কাণ্ড! লন্ডন অলিম্পিক স্টেডিয়ামে তখন তুমুল গর্জন। না, বোল্টের জন্য নয়। ৪^১০০ মিটার রিলেটা যে জিতে নিয়েছে স্বাগতিক গ্রেট ব্রিটেন।

বোল্ট যখন ট্র্যাকে লুটিয়ে পড়েছেন, তখন তুমুল লড়াই যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিস্টিয়ান কোলম্যান ও ব্রিটেনের নেথানিয়েল মিচেল-ব্লেকের মধ্যে। যা ০.০৫ সেকেন্ডের ব্যবধানে জিতলেন ব্রিটিশরা। বিশ্ব অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ৪^১০০ মিটার রিলেতে ব্রিটেনের এটাই প্রথম সোনা।

এই ডামাডোলের মধ্যেই আয়োজকেরা হুইলচেয়ার নিয়ে আসেন বোল্টকে উঠিয়ে নিতে। যন্ত্রণাকাতর বোল্ট অবশ্য হেঁটে হেঁটেই বেরিয়েছেন মাঠ থেকে।

শেষটা নিজের করে নিতে পারলেন না, তা নিয়ে পরশু কোনো দুঃখ করেননি বোল্ট! ৪^১০০ মিটার রিলের সঙ্গীরা জানিয়েছেন, তাঁর কারণে সতীর্থরা বঞ্চিত হলো এই দুঃখই নাকি পুড়িয়েছে অলিম্পিকে তিনবার স্প্রিন্ট ‘ডাবল’জয়ী বোল্টকে। সতীর্থ জুলিয়ান ফোর্টে বলেছেন, ‘সে বারবার আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে। তবে আমরা তাঁকে বলেছি দুঃখ প্রকাশ করার কিছু নেই। চোট তো খেলারই অংশ।’

আরেক সতীর্থ ওমর ম্যাকলাউড এই পরাজয়ের পরও কুর্নিশ করেছেন বোল্টকে, ‘এ রকম হতেই পারে। উসাইন বোল্টের নাম চিরদিন বেঁচে থাকবে।’

তবে বোল্টের চোটের পেছনে আয়োজকদের দায় দেখেছেন ম্যাকলাউড-ব্লেকরা। রিলে শুরুর আগে অ্যাথলেটদের নাকি ওয়েটিংরুমে প্রায় ৪৫ মিনিট আটকে রেখেছিলেন আয়োজকেরা। দু-দুটি পদক বিতরণী অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গিয়েই এই ভজকট।

বোল্ট-সতীর্থ ইয়োহান ব্লেক তো সরাসরিই আঙুল তুলেছেন আয়োজকদের দিকে, ‘তারা আমাদের “কলরুমে” অনেক বেশি সময় আটকে রেখেছে। উসাইনের ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল। উসাইন আমাকে এও বলেছিল “ইয়োহান, এটা তো পাগলামি।” আমাদের প্রস্তুতিতে সমস্যা হয়েছে এ কারণে।’

গত এক যুগে ট্র্যাকে বোল্টের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জাস্টিন গ্যাটলিনও একমত ব্লেকের সঙ্গে, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি স্টেডিয়ামে আমাদের একটু বেশি সময় আটকে রাখা হয়েছিল। ওই জায়গাটা ছিল আবদ্ধ। আমি প্রচণ্ড ঘেমেছি, শরীর তাপও হারিয়েছে বেশ।’

বোল্ট কি এ কারণেই চোটে পড়েছেন এমন প্রশ্নে গ্যাটলিনের ঝটপট উত্তর, ‘আমি তা-ই মনে করি। খারাপ লাগছে সে এই চোটে পড়ল।’

টানা পাঁচটি বৈশ্বিক আসরে দ্বিতীয় হওয়া গ্যাটলিনও আবেগাপ্লুত বোল্টের বিদায়বেলায়, ‘আমি আবেগ সামলাতে পারিনি। ওয়ার্মআপ জোনে আমরা পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানিয়েছি। উসাইন বোল্ট এক গ্রেট অ্যাথলেট।’

প্রশ্ন উঠে গেছে, বোল্ট কি ২০১৬ রিও অলিম্পিক শেষেই বিদায় নিলেই ভালো করতেন না? এবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আসার কোনো কারণই ছিল না জ্যামাইকান মহাতারকার। নতুন করে নিজেকে প্রমাণের আর কীই-বা ছিল।

কিন্তু তিনি এলেন শেষবারের মতো। এবং এসে বাজিতে হারলেন। একবার নয়, দুবার। গত ৯ বছরে বিশ্ব আসরে অজেয় বোল্ট তৃতীয় হলেন ১০০ মিটার স্প্রিন্টে। এরপর রিলেতে ঘাতক হয়ে এল চোট।

২০১২ সালে যে লন্ডনে ট্রেবল জয়ের পর নিজেকে ‘কিংবদন্তি’ ঘোষণা করেছিলেন, সেই লন্ডনই এবার সাক্ষী হলো বোল্ট-ট্র্যাজেডির। তথ্যসূত্র: এএফপি, রয়টার্স, গার্ডিয়ান।