অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার পর সব সহজ মনে হয়

>
হাবিবুল বাশার
হাবিবুল বাশার

২০০৬ সালের পর ২০১৭। প্রায় এক যুগ পর আবার টেস্ট খেলতে বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়া দল। ১১ বছর আগে ও পরের দুই টেস্ট সিরিজ নিয়ে ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের শেষ পর্বে আজ থাকছেন হাবিবুল বাশার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উৎপল শুভ্র

উৎপল শুভ্র: ফতুল্লা টেস্ট নিয়ে গত ১১ বছরে আপনার সঙ্গে অনেকবারই কথা হয়েছে। আবার এই প্রসঙ্গ তোলায় তাৎক্ষণিকভাবে কী মনে পড়ছে?

হাবিবুল বাশার: আপনি প্রশ্ন করছেন বলে বা অস্ট্রেলিয়া আবার বাংলাদেশে এসেছে বলে বলছি না, ফতুল্লায় ওই টেস্টটার কথা কিন্তু আমার মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে। এই মুহূর্তে কী মনে হচ্ছে? আর কী, সেই আফসোস! অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে রিকি পন্টিংয়ের একটা টপ এজ হয়েছিল, ওই ক্যাচটা নিতে পারলে হয়তো অন্য রকম কিছুও হতে পারত। আরেকটা আফসোসও হয়। এনামের (বাঁহাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র) আঙুলে কী যেন হয়েছিল, ওই ইনিংসে তাই বেশি বোলিং করতে পারেনি। পারলে হয়তো...কে জানে!

সবচেয়ে বড় হুমকি অবশ্যই স্মিথ
সবচেয়ে বড় হুমকি অবশ্যই স্মিথ

শুভ্র: বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসে আপনি যে ৭ রানে রানআউট হয়ে গিয়েছিলেন, সেটি নিয়ে আফসোস নেই? আপনি একটা ভালো ইনিংস খেলতে পারলেই তো ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়ার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেত...

হাবিবুল: আফসোস নেই মানে! প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি মিস করার চেয়েও ওই আফসোস বেশি। প্রথম ইনিংসে আমরা ১৫৮ রানের লিড নিয়েছিলাম, দ্বিতীয় ইনিংসে আমি রান করতে পারলে হয়তো আমাদের আরও ভালো সুযোগ থাকত। আর রানআউটটাও কী! স্কয়ার লেগে দাঁড়ানো মাইকেল ক্লার্ক প্রায় শূন্য ডিগ্রি থেকে স্টাম্পে মেরে দিয়েছিল! ওখান থেকে ও যে থ্রো করবে, এটাই তো ভাবতে পারিনি।

শুভ্র: প্রথম ইনিংসে শাহরিয়ার নাফীসের সঙ্গে আপনার ১৮৭ রানের জুটিটি তো বাংলাদেশের ক্রিকেট-রূপকথার অংশ। রানের চেয়েও বড় ছিল অমন দাপুটে ব্যাটিং। ওই সময়ে যা ছিল রীতিমতো অকল্পনীয়...

হাবিবুল: আসলেই অকল্পনীয়। আমরাও ভাবিনি এমন ব্যাটিং করব। তবে ওরা আরও বেশি ভাবেনি। অস্ট্রেলিয়া তো সব সময়ই আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজায়, অথচ ওরা ডিফেন্সিভ ফিল্ডিং সাজাতে বাধ্য হয়েছিল। অমন বোলিং অ্যাটাক, ওভাবে মেরে খেলব, এটা আমরাও ভাবিনি। তার ওপর শেন ওয়ার্নকে প্রথমবারের মতো খেলেছিলাম। সেই ওয়ার্নকে বোলিং থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল পন্টিং।

হাবিবুল বাশারের বিখ্যাত সেই পুল। ফতুল্লায়ও যা ভালোই খেলেছিলেন
হাবিবুল বাশারের বিখ্যাত সেই পুল। ফতুল্লায়ও যা ভালোই খেলেছিলেন

শুভ্র: শেন ওয়ার্নের কাছ থেকে প্রীতি সম্ভাষণ শুনতে হয়নি?

হাবিবুল: (হাসি) হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘ওয়েল প্লেড’, ‘গুড শট’ কত কিছু...। এটাই লিখুন। এর আগে-পরে যা বলেছিল, সেটি বললেও ছাপতে পারবেন না। (আবার হাসি)।

শুভ্র: ওয়ার্নকে এত ভালো কীভাবে খেলেছিলেন? প্ল্যানটা কী ছিল?

হাবিবুল: সত্যি বললে ওয়ার্নকে নিয়ে একটু ভয়ই ছিল। এর আগে না খেললেও টিভিতে তো দেখেছি, ও কী করতে পারে! এত ভালো লেগ স্পিনারকে আগে খেলিওনি। দানিশ কানেরিয়াকে খেলেছি, কিন্তু কানেরিয়া তো আর ওয়ার্ন নয়। তবে জানতাম, ওয়ার্ন গুগলি করতে পারে না। এটা একটা স্বস্তির দিক ছিল। কয়েকটা বল খেলার পরই অবশ্য ভয়টা কেটে যায়। আসলে ফতুল্লার ওই উইকেটটা ওয়ার্নের জন্য আদর্শ ছিল না। একটু শক্ত উইকেটে ওয়ার্ন সবচেয়ে ভয়ংকর। কিন্তু ফতুল্লার উইকেট সে রকম ছিল না।

শুভ্র: পরের প্রশ্নটা হয়তো অনুমান করতে পারছেন। পরাক্রান্ত ওই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জিততে জিততে হেরে যাওয়াটা কতটা হতাশার ছিল, তার ওপর আপনি ছিলেন অধিনায়ক?

হাবিবুল: সেটা বলে বোঝানো কঠিন। আসলে তখন আমাদের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি ছিল। জয়ের অভ্যাস না থাকলে যেটা হয়। ভালো খেললেও মনে হতো, প্রতিপক্ষ একটা পার্টনারশিপ করে বা অন্য কোনোভাবে ঠিকই জিতে যাবে। তা-ই হয়েছিল। অধিনায়ক ছিলাম বলেই হয়তো আরও বেশি খারাপ লেগেছিল।

শুভ্র: শেষটা তো চরম হতাশার, তারপরও এটাই কি আপনার খেলা সেরা টেস্ট ম্যাচ?

হাবিবুল: বলতে পারেন। মুলতানের কথাও মনে পড়ছে। মুলতানে কেঁদেছিলাম, ফতুল্লায় কাঁদিনি। তবে প্রতিপক্ষ বিবেচনা করলে ফতুল্লারটাই আমার খেলা সেরা টেস্ট ম্যাচ। একবার ভাবুন না, কী দল ছিল অস্ট্রেলিয়া!

শুভ্র: সেই অস্ট্রেলিয়া তো আর নাই, বাংলাদেশও আর আগের বাংলাদেশ নয়। ১১ বছর পর দুই দলই তো বদলে গেছে, তাই না?

হাবিবুল: তুলনাই চলে না। অস্ট্রেলিয়ার ওই দলের মতো দল আবার কবে হবে, আদৌ হবে কি না কে জানে! বাংলাদেশ আবার আগের চেয়ে অনেক ভালো। সেই দল আর এই দলের প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং গড়ের তুলনা করলেই তা বুঝতে পারবেন। আমি নিশ্চিত, ফতুল্লায় আমরা যে পরিস্থিতি থেকে হেরেছিলাম, এই দল তেমন অবস্থায় হারবে না। বিশ্বাসের কথা বলছিলাম না, সেটি এখন আছে।

শুভ্র: এত বছরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ৪টি টেস্ট ম্যাচ। ওদের সঙ্গে আরও খেলতে না পারায় আফসোস হয় না?

হাবিবুল: খুবই হয়। অস্ট্রেলিয়া এমন একটা দল, ওদের সঙ্গে যত খেলবেন, ততই ভালো করবেন। প্রথম যখন (২০০৩ সালে) ওদের সঙ্গে খেললাম, ওরা বিশ্বের সেরা দল। তিন বছরও হয়নি আমরা টেস্ট ক্রিকেটে এসেছি, আর ওরা খেলছে এক শ বছরেরও বেশি সময় ধরে। আমাদের সমালোচনা করার সময় অনেকেই এটা ভুলে গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আরও খেলার সুযোগ পেলে আমরা আরও দ্রুত উন্নতি করতাম।

শুভ্র: অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার এমন কী মাহাত্ম্য?

হাবিবুল: অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার পর কী হয়, জানেন? অন্য সব দলের সঙ্গে খেলাটা খুব সহজ মনে হয়। ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরের পরপরই আমরা পাকিস্তানে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানি বোলারদের কোনো ব্যাপারই মনে হয় নাই। এমনকি শোয়েব আখতারকেও না। ওই সিরিজটা আমরা খুব ভালো খেলেছিলাম। আসলে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলাটা আপনাকে মানসিকভাবে অনেক এগিয়ে দেয়।

শুভ্র: আপনি তো সব দলের বিপক্ষেই টেস্ট খেলেছেন। প্রতিপক্ষ হিসেবে অস্ট্রেলিয়াই তাহলে কঠিনতম?

হাবিবুল: অবশ্যই। মাঠে ওরা একচুল ছাড় দেয় না। ওদের দর্শনটাই অন্যদের চেয়ে আলাদা। আমি এই দর্শনের বড় ভক্তও। মাঠে ওদের চেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ আর হয় না। মাঠের বাইরে ওরাই আবার দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ। অস্ট্রেলিয়ায় ওই সিরিজের পর স্টিভ ওয়াহ আমাদের ড্রেসিংরুমে এসে অনেকক্ষণ কথা বলেছেন। উৎসাহ দিয়েছেন। অন্য দলগুলো এমন হয় না।

শুভ্র: অস্ট্রেলিয়ার এই দলের ব্যাটিং নিয়ে কথা বললে দুটি নাম সবার আগে মনে পড়ে—স্টিভ স্মিথ আর ডেভিড ওয়ার্নার। আর কারও কথা কি বলবেন?

হাবিবুল: তারকা বললে ওই দুজনই। তবে হ্যান্ডসকম্ব-রেনশ ওরাও কিন্তু ভালো। তবে সবচেয়ে বড় হুমকি অবশ্যই স্মিথ। স্মিথকে বোলিং করাটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ ওর শাফলিংয়ের কারণে বোলাররা কোন লেংথে বল করবে, তা নিয়ে সংশয়ে পড়ে যায়।

শুভ্র: বর্তমান ক্রিকেটের ‘ফ্যাব ফোর’ মানে স্মিথ, কোহলি, রুট, উইলিয়ামসনের মধ্যে আপনার এক নম্বর কে?

হাবিবুল: রুট-উইলিয়ামসনের চেয়ে স্মিথ-কোহলিকে আমি এগিয়ে রাখব। এই দুজনের মধ্যে আবার স্মিথকে। অনেকেই হয়তো কোহলির কথা বলবে। কিন্তু আমি স্মিথকে এক নম্বর বলছি, কারণ ও সব জায়গায় রান করেছে। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের উইকেটে যেমন, তেমনি উপমহাদেশেও। বল সুইং করলে কোহলি কিন্তু সমস্যায় পড়ে যায়। ইংল্যান্ডে ওর রেকর্ড দেখুন, একদমই ভালো নয়।

শুভ্র: উইকেট নিয়ে বড় একটা কৌতূহল আছে এবার। ইংল্যান্ড সিরিজের স্পিনিং উইকেট কি বাংলাদেশে টেস্ট উইকেটের একটা ধারা তৈরি করে দিয়েছে?

হাবিবুল: দেখুন, এখন আমরা টেস্ট জয়-সিরিজ জয় নিয়ে ভাবছি। উইকেট বানানোতেও সেটির ছায়া পড়ছে। আমাদের সময় কী হতো! যতটা সম্ভব ফ্ল্যাট উইকেট বানানো হতো, যাতে খেলাটা চার দিন পর্যন্ত নিতে পারি। তাতে কী হতো, প্রতিপক্ষ ৬০০ রান করত আর আমরা দুবার ব্যাটিং করতাম। দলের শক্তি-দুর্বলতা নিয়ে ভাবারই অবকাশ ছিল না। এখন আমাদের চিন্তা অন্য রকম। নিজেদের শক্তি, প্রতিপক্ষের শক্তি—এসব বিবেচনা করে যেটা ভালো হয়, সেটাই করার চেষ্টা করা হয়।

শুভ্র: সেটা চিন্তা করে এবারও কি স্পিনিং উইকেট? আমাদের মূল শক্তি তো স্পিনই...

হাবিবুল: আমাদের ফাস্ট বোলিংও কিন্তু খারাপ না। আর আমাদের ব্যাটসম্যানরাও ফাস্ট বোলিং ভালো খেলে।

শুভ্র: স্পিনিং উইকেট হলে কি একটা ভয়ও আছে? অস্ট্রেলিয়ার স্পিন আক্রমণ তো ইংল্যান্ডের চেয়ে ভালো...

হাবিবুল: অস্ট্রেলিয়ায় নাথান লায়ন আছে, ভালো বোলার। তবে আমার কিন্তু মনে হয়, স্পিনারদের চেয়ে অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলাররাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। আমাদের উইকেটে বাউন্স সব সময় সমান থাকে না বলে ফাস্ট বোলিং খেলা কিন্তু বেশি কঠিন। বল রিভার্স সুইংও করবে। কামিন্স আর হ্যাজলউড তাই সমস্যা করতে পারে।

শুভ্র: ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে মেহেদী হাসান মিরাজকে নামিয়ে দেওয়াটা ছিল একটা মাস্টারস্ট্রোক। ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের ওর সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। নির্বাচক হাবিবুল বাশারকে প্রশ্ন করি, অস্ট্রেলিয়ানদের বিপক্ষেও কি এমন কোনো ‘ফাটকা’ খেলার চিন্তা ছিল?

হাবিবুল: না, না, মিরাজকে খেলানোটাকে ফাটকা বলতে রাজি নই। আমাদের দলে একজন অফ স্পিনার দরকার ছিল। মিরাজ আমাদের সেরা অফ স্পিনার, তাই ওকে নেওয়া হয়েছিল। টেস্ট ক্রিকেট আসলে ফাটকা খেলার জায়গা নয়। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে ফাটকায় কাজ হতে পারে। কিন্তু টেস্টে নয়। আমরা এমন কিছু আসলে ভাবিইনি। ভাবার দরকারই পড়েনি। মিরাজ এখন আরও পরিণত। সাকিব-তাইজুলও টেস্টে পরীক্ষিত।

শুভ্র: এই সিরিজে বাংলাদেশের কোন খেলোয়াড়ের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মনে করেন?

হাবিবুল: একজন-দুজন ভালো খেললে হবে না। এই অস্ট্রেলিয়া ২০০৬ সালের অস্ট্রেলিয়া নয় সত্যি, তারপরও অস্ট্রেলিয়া তো! সবাইকে মিলে খেলতে হবে। আমরা স্পিন-স্পিন করছি, পেসারদেরও কিন্তু ভূমিকা রাখতে হবে। আলাদা করে কিছু বলতে গেলে টপ অর্ডারের কথা বলব। টপ অর্ডার ব্যাটিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে।

শুভ্র: সিরিজের ফল নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী?

হাবিবুল: আগের দুটি ইন্টারভিউয়েই দেখলাম ১-১। আমি বলব, বাংলাদেশের পক্ষে ১-০। তবে প্রথম টেস্টটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। জিততে হলে প্রথমটাই জিততে হবে।

শুভ্র: কেন, ইংল্যান্ডের পর শ্রীলঙ্কা সিরিজেও তো বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট হারার পর দ্বিতীয় টেস্টে জিতেছে?

হাবিবুল: তা জিতেছে। তবে চট্টগ্রামের উইকেটটা একটু কেমন যেন। একেক সময় একেক রকম। মিরপুরেই বাংলাদেশের চান্স বেশি।