'জমিদার'দের পক্ষে বিসিবি!

সভা শুরু হওয়ার কথা বেলা ১১টায়। কিন্তু যাঁর সভাপতিত্বে সভা হবে, সেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান বিসিবি কার্যালয়ে এলেন নির্ধারিত সময়ের পৌনে তিন ঘণ্টা পর। সভায় কী হবে, সেটা অনুমান করতে পারছিলেন বলেই কি তাঁর এমন বিলম্বিত আগমন!
তবে সভা শেষে সভার সিদ্ধান্ত গোপনই রাখতে চাইলেন বোর্ড সভাপতি। আইসিসিতে তোলা ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার ‘জমিদারি’র প্রস্তাবটির ব্যাপারে বিসিবির অবস্থান পরিষ্কার না করে সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘যেহেতু বিষয়টা জটিল এবং এ-সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তরই আমাদের জানা দরকার, সে জন্য আমাদের যে মনোভাবই থাক না কেন, সেটা এখন প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। এ ব্যাপারে অন্য দেশগুলোর অবস্থান জেনে আমরা আমাদের মতামত দেব।’ ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি দুবাইয়ে আইসিসির সভা বসবে। সে সভায় ‘ঝোপ বুঝে কোপ মারা’র নীতি নিয়েছে বিসিবি—এমনটাই বোঝাতে চাইলেন নাজমুল হাসান।
সভাপতি চেপে যেতে চাইলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিতর্কিত প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার বিস্ময়কর সিদ্ধান্তই হয়েছে কালকের বোর্ড সভায়। সভাপতিসহ উপস্থিত ২৩ পরিচালকের মধ্যে ২০ জনই এর পক্ষে মত দিয়েছেন। প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার দাবি ছিল শুধু আহমেদ সাজ্জাদুল আলম এবং নবীন দুই পরিচালক শওকত আজিজ ও তানজিল চৌধুরীর। সাজ্জাদুল আলম তো প্রতিবাদে ওয়াকআউটই করেছেন সভা থেকে। বোর্ড রুম থেকে বের হয়ে আসার আগে তিনি নাকি এমনও বলেছেন, বিসিবির চিন্তাভাবনায় সর্বাগ্রে থাকা উচিত ক্রিকেটের স্বার্থ। কিন্তু এই সভায় যা হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের মৃত্যুদণ্ডের রায়ই লেখা হয়ে যাচ্ছে।
এর আগে যেসব পরিচালক সভায় প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেবেন বলে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, কাল তাঁরাও ডিগবাজি খেয়েছেন। আরও বিস্ময়কর, বর্তমান বোর্ডে পরিচালক হিসেবে থাকা জাতীয় দলের তিন সাবেক অধিনায়কও টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে ওঠার প্রস্তাবের বিপক্ষে দাঁড়াননি।
সভার শুরুতে তিন ‘জমিদার’-এর প্রস্তাবটি পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে তুলে ধরা হলেও ২১ পৃষ্ঠার প্রস্তাবনার কপি সরবরাহ করা হয়নি পরিচালকদের। বিসিবি পরিচালক মাহবুবুল আনাম ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী ব্যাখ্যা করেছেন প্রস্তাব মেনে নেওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা। পরিচালকেরা সেটুকু দেখেই মতামত জানিয়েছেন এবং তাতে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হয়েছে ‘হ্যাঁ’র পক্ষ। প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেওয়াদের যুক্তিগুলোও অদ্ভুত। তাঁদের বক্তব্য যে কাউকে ধন্দে ফেলে দেবে—ক্রিকেট বোর্ড ক্রিকেট খেলারই সংস্থা, নাকি টাকা কামানোর! প্রস্তাবটি মেনে নিলে বিসিবি আর্থিকভাবে লাভবান হবে, এটাই মূল যুক্তি তাঁদের। সর্বশেষ অর্থবছরে আইসিসি যেখানে ১.৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে, নতুন প্রস্তাব অনুমোদন হলে নাকি ভবিষ্যতে সেটি ৩.৫ বিলিয়নও ছাড়িয়ে যেতে পারে। তখন ভাগে বিসিবিও এখনকার চেয়ে বেশি টাকা পাবে। এ ছাড়া ভারতসহ ক্রিকেটের বড় তিন দেশের বিপক্ষে যাওয়ার ঝুঁকিটাকেও বড় করে দেখেছেন তাঁরা। পরিচালকদের শঙ্কা, বিসিবি এর বিপক্ষে অবস্থান নিলে ‘বড় ভাই’দের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। তখন অন্যরাও ‘বড়’দের রোষানলে পড়ার ভয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে খেলা এড়িয়ে যাবে।
বিসিবির অবস্থান না জানালেও প্রস্তাবের ব্যাপারে নাজমুল হাসানের মনোভাব বুঝতে অসুবিধা হয়নি। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে নানাভাবে এর পক্ষে থাকার যৌক্তিকতাই যেন তুলে ধরতে চাইলেন তিনি। একবার বললেন, ‘টেস্টে আমাদের রেটিং পয়েন্ট ১৮। আগামী ১০ বছর টেস্ট খেললেও হয়তো আমাদের ৮ নম্বরে ওঠা হবে না। কিন্তু এই পদ্ধতিতে ৮ নম্বরকে হারাতে পারলেই আমরা ৮-এ উঠে যাব। এখন তো নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েও লাভ হচ্ছে না।’ পরে আবার বলেছেন, ‘সার্বিকভাবে এই প্রস্তাব গ্রহণ করার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। এটা খারাপ মানছি। কিন্তু ভালোটা কোথায় হচ্ছে? র্যাঙ্কিংয়ের বর্তমান অবস্থান থেকে বের হওয়ারও তো কোনো সুযোগ পাচ্ছি না!’ নাজমুল হাসান অবশ্য এ-ও স্বীকার করেছেন, ‘এটা হয়ে গেলে আইসিসির ক্ষমতা বলে কিছু থাকছে না। ওরা বলছে, এখন আইসিসি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, তখন সদস্যদেশগুলো তা করবে।’
আইসিসির আগামী সভায় বিসিবির সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কেও সরাসরি কিছু বলেননি বিসিবি সভাপতি, ‘আমরা ঝুঁকি নিতে পারব না। যদি দেখি আমরা হ্যাঁ বললে যা, না বললেও তা, তখন একরকম সিদ্ধান্ত নেব। আবার যদি দেখি, আমাদের অবজেকশনের ওপর প্রস্তাবের পাস-ফেল নির্ভর করবে তখন আরেক রকম।’